নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি!
এখানে তিনটা শব্দই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচিত, জন ও প্রতিনিধি! ইতিবাচক অর্থে এগুলোর একটা গুণবাচক বৈশিষ্ট্য আছে। বাস্তবে আছে কি! রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাই ভালো বলতে পারেন। আমার মতো অতিসাধারণ নাগরিক যাই বলি না কেন, কিছু যায় আসে না তাতে। তবু বলা কেন? বলা এজন্য যাতে বারবার চৈতন্যে নাড়া পড়ে। ৫৩ বছর ধরে ঘুমিয়েই আছি।
হঠাৎ-হঠাৎ জাগলেও ঘুমিয়ে যাই। কী যেন এক ‘নেশায়’ নেশাগ্রস্ত আমরা! চৈতন্যে নাড়া পড়ে। কখনও কখনও পড়ে না। এমনি একটা সময়ের মধ্য দিয়েই হাঁটছি। অল্প সততা, পরিশ্রম ও অল্প দেওয়া। এতে অনেক বেশি পাওয়ার প্রবণতা; মোহগ্রস্ত করে রাখছে কি! ভাবায় বৈকি।
বিভিন্ন সময়ে আমাদের রাজনীতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসছেন ও গেছেন। আগামীতেও আসবেন, যাবেন। নিজেকে প্রশ্ন করি, তারা নির্বাচিত হন যাদের দ্বারা কতজন তাদের কথা মনে রাখেন ‘নির্বাচিত’ হওয়ার পর! বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, অধিকাংশই তারা যাদের দ্বারা নির্বাচিত হন, তাদের কথা মনে রাখেন না, কিন্তু ‘যাদের’ দ্বারা সেই নির্বাচন ‘সুনির্ধারিত’ হয়। তার এবং তাদের কথাই মনে রাখেন? ও মনে করেন বেশি।
অভিজ্ঞতা বলে আমরা নির্বাচিত হই যাদের দ্বারা আর নির্বাচন ‘সুনিশ্চিত’ হয় যাদের দ্বারা। এরা দুই ভিন্ন শ্রেণিগোষ্ঠী। ভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী। একদল দৃষ্টির সামনে থাকেন, আরেক দল থাকেন পর্দার অন্তরালে। এভাবেই চলছে বিশ্বের কথিত গণতন্ত্র এবং নির্বাচন ‘খেলা’। কমবেশি কিছু পার্থক্য হতে পারে, সময় ও দেশ-কালের পরিপ্রেক্ষিতে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে তাকালেও দেখা যায়, এখানেও পপুলার ভোট এবং ‘ইলেক্টোরাল’ ভোটের মধ্যে একটা ব্যবধান আছে। বলা যায় শুভঙ্করের ফাঁকি। এই দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন দৃশ্যত জনগণের সরাসরি ভোটে ‘পপুলার’ ভোটের মাধ্যমেই। কিন্তু নির্বাচন চূড়ান্ত হয় ইলেক্টোরাল ভোটের মাধ্যমে। দৃষ্টান্ত, যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প মোট ভোট পেয়েছেন প্রায় ৭৭ মিলিয়ন সরাসরি ভোটারের। কিন্তু তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চূড়ান্ত ঘোষণা দেন, মাত্র ৫৩৮ ইলেক্টোরাল ভোটার। ব্যবধান কয়েক লাখ বনাম কয়েক শতের! গণতন্ত্রের আধুনিক রূপ।
আমাদের দেশেও এটা একটু ভিন্ন ধারায় হয়। সত্যিকারের জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি অধিকাংশ সময়েই নির্বাচনে জিতে আসতে পারেন না। আপনি নির্বাচনে বিজয়ী হবেন কী হবেন না! নির্ধারণ করে প্রথমত, আপনি কোন দলের প্রার্থী এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে তাদের অপশক্তির প্রভাব কী ও কতটা। বিশেষ করে সেই দলের নেতা বা নেত্রীর অন্যায় শক্তির প্রভাব কতটা আছে তার ওপরও। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনেও আমরা এই বিষয়টা দেখেছি। সাম্প্রতিককালে তো এ রকম দৃষ্টান্ত অনেক। তবু তাদের আমরা ‘জনপ্রতিনিধি’ বলেই মনে করি। তারা অধিকাংশ কাজই করেন জনস্বার্থের বিরুদ্ধে। কারণ :
১. ‘জনগণ’ ম্যাটার করে না। ম্যাটার করে অর্থ, দল, দলীয় প্রতীক, দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার।
২. জনগণের জন্য নির্বাচন করি না, দলের জন্য করি। অর্থাৎ দল থাকলে আছি, নইলে নাই।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
৩. দেশের চেয়েও দলের অগ্রাধিকার বেশি।
৪. এখন নির্বাচন মানে এক ধরনের বাণিজ্য। এক ধরনের ‘ইনভেস্টমেন্ট’ উইথ ‘প্রফিট’ গ্রান্টেড। সারা বিশ্বেও এখন এটাই হয় ও হচ্ছে। সেটা যুক্তরাষ্ট্র হোক বা বাংলাদেশ। আর প্রফিট মানেই তো চুরি।
৫. জনগণের চেয়েও বিশেষ শ্রেণি-গোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং নিজ দল ও দলীয় নেতার প্রতিনিধি হতেই বেশি পছন্দ করি ও ভালোবাসি।
এসব কারণ, আরও অনেকগুলো কারণের কিছু কিছু কারণ। এর জন্য আমরা নির্বাচিত বা ইলেক্টেড জনপ্রতিনিধি না হয়ে দলীয় ‘সিলেক্টেড’ প্রতিনিধি হই। ফলাফল, দেশের চেয়েও বড় দল এবং দলীয় স্বার্থ রক্ষা করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই স্বার্থ জনবিরোধী হয়। এই কথাগুলোর বিশদ ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নেই। এর ইতিহাসের বাস্তবতা আমাদের প্রজন্ম এবং বর্তমান প্রজন্মের কাছে এখন সুস্পষ্ট।
২০২৪-এর ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর, আবার এখন আমরা অপেক্ষা করছি আরেকটা দ্রুত নির্বাচনের। রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটা মরিয়াও হয়ে উঠেছেন যত ‘শীঘ্র’ সম্ভব একটা নির্বাচন হওয়া নিয়ে। এতে কি ‘জনপ্রতিনিধিরা’ আসবেন বলে মনে হয়! সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণ এখনও আমরা মানসিকভাবে ব্যক্তি ও দলের ঊর্ধ্বে সাধারণ জনগণকে রাষ্ট্রক্ষমতার মূল শক্তি বলে মনে করি না। জনগণ-জনগণ বলি, চেঁচামেচি করি; কিন্তু আসলে আমরা জনগণের স্বার্থ, দাবি এবং ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে প্রস্তুত আছি কি!
প্রশ্ন আসতেই পারে, ‘প্রস্তুত’ বিষয়টা আপেক্ষিক, এর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা এবং উপযোগিতা ও বাস্তবতা নির্ণয় করা খুব কঠিন। তাই বলে কি আমরা ‘অনাদিকাল’ অপেক্ষা করব একটা নির্বাচনের জন্য! না, তা করব না। তবে নির্বাচন হলে আমরা সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের পুনরায় রাষ্ট্র প্রশাসনে দেখতে পারব বলে কেন জানি মনে করতে পারছি না। কারণ নির্বাচন নিয়ে যাদের চেঁচামেচি করতে দেখি তারা সবাই কমবেশি পরিচিত মুখ ও দল। পরীক্ষিত এবং চিহ্নিত জনশত্রু।
এদের অনেকে এর আগেও ক্ষমতায় ছিলেন, নির্বাচনের মাধ্যমেই। অনেকে ক্ষমতায় ছিলেন অনেক বছর। তাদের অনেকে আবার ক্ষমতায় আসার জন্য অপেক্ষা করছেন। যারা বিগত ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, তারাও ক্ষমতায় আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। নানান ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত। এক সময় এদের যারা দিন-রাত্রী শত্রু ছিলেন। এই শত্রুকেও দলীয় স্বার্থে মিত্র বানানোর চেষ্টা করছেন। উভয়ে একসঙ্গে হয়ে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টাও করছেন। তারা প্রত্যেকেই আমাদের চিহ্নিত জাতীয় শত্রু।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
দুঃখজনকভাবে বাস্তবতা এটাও যে, যারাই ক্ষমতায় আসতে চাচ্ছেন, অতীতে তাদের অধিকাংশই ‘জনপ্রতিনিধি’ ছিলেন, এই দৃষ্টান্ত কম। বলতে গেলে নেই। অতীতে তারা কেউ তাদের কথিত জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালনকালে তাদের দায়িত্বের ব্যর্থতার জন্য কখনই জনগণের কাছে জবাবদিহি হননি, ক্ষমতাও ছেড়ে যাননি। ছাড়তে চাননি। তারা অতীতে যতবার নিজেদের দল এবং নেতার কথা বলেছেন, ততবার দেশের কথা বলেননি। ক্ষমতায় গিয়ে বিভিন্ন সময় দলীয় এজেন্ডা পূরণ করতে গিয়ে দেশের স্বার্থ হয় বিক্রি করে দিয়েছেন বা তার সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেন দেশের শত্রুদের সঙ্গে। জনগণকে একেক সময় একেক ‘দলীয় ট্যাবলেট’ গিলিয়েছেন। বর্তমান সামাজিক যোগাযোগের বাজার ধরতে গিয়ে একেক সময় একেক ধরনের ‘অ্যাপ’ তৈরি করেছেন, পলিটিক্যাল অ্যাপ! চেতনার অ্যাপ। নিজেরা জনস্বার্থে কোনো কিছুই ত্যাগ করেননি।
ঘুরেফিরে তারাই যদি আবারও ক্ষমতায় আসেন নির্বাচন হলে। ‘জনপ্রতিনিধি’ হবেন! তেমন কোনো দৃষ্টান্ত দেখছি না। এমনকি বর্তমান সরকারের মধ্য থেকেও যদি কেউ নির্বাচন করেন, তারাও শেষ পর্যন্ত জনগণের হবেন নাকি আগের কোনো পরাজিত রাজনৈতিক শক্তিদের মতোই নতুন করে নিজেদের অপশক্তি প্রদর্শন করবেন! আশঙ্কা হয়।
এটা আমাদের ব্যর্থতা যে, আমরা কোনোবারই দেশের অভ্যন্তরীণ তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদেরও কোনো সঠিক বিচার করতে পারিনি। তাদের দুর্নীতি এবং ব্যর্থতার কোনো জবাবদিহিতার নিশ্চয়তার বিধান দিতেও পারিনি। আমাদের সংবিধানেও সেই বিচার করার তেমন কোনো সুব্যবস্থা বা দৃঢ় ব্যবস্থা ছিল না। সংশোধিত বা পুনর্লিখিত সংবিধানের ধারায় তেমন সুব্যবস্থা আছে কিনা! জানি না। সেই কারণেই আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আগামীতে কারা হবেন! তাদের চরিত্র কী হবে! তাদের দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতা কী হতে পারে। আদৌ হবে কী কিছু! বিষয়গুলোর প্রতিও সংশয় আছে।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে যদি গণতন্ত্রের সুরক্ষা না হয় এবং গণতন্ত্র নিরাপদে না থাকে। তা হলে তাদের কোন অর্থে জনপ্রতিনিধি বলি, জানি না। একটা নির্বাচনের মাধ্যমে যে কেউ নির্বাচিত হলেই কি সে ‘জনপ্রতিনিধি’ হতে পারে! আলোচনার অবকাশ আছে।
গণযুগ এবং গণতন্ত্র! এই বিষয়টাও আমাদের বোঝা দরকার এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে। অনেকেই আমরা এই সময়টাকে বলি এটা ‘গণযুগের’ সময়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, আমরা যে কোনো গণশক্তির অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের প্রাদেশিকতা বা ভিন্ন সংস্কারের নামে কোথাও কোথাও নতুন শক্তির উদ্ভব দেখতে পারি। তারাও গণযুগের প্রতিনিধি না, গণতন্ত্রেরও না। ইতিহাসে গণতান্ত্রিক জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতার ভিত্তিতে বহু ছোট-বড় রাষ্ট্রের অভ্যুত্থান আধুনিক যুগের আরেক বড় ঘটনা। যেমন, ১৯৭১-এ ঘটেছে আমাদের অঞ্চলে। তৎকালীন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে তার ওপর ভিত্তি করেই একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করি আমরা। এটাকে কেউ কেউ প্রাদেশিক স্বাধীনতার সঙ্গে তুলনাও করেছেন। আমরা সেটা মনে করি না। এটা ছিল আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা। এই অঞ্চলে একটা ‘জাতিরাষ্ট্রের’ উদ্ভব হয় এতে।
সেই জাতিরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকেও আমরা গণযুগে পরিণত করতে ব্যর্থ হই, বিগত ৫৩ বছর। আমাদের সেই ব্যর্থতার ইতিহাস খুব যে ছোট তাও নয়। আমরা জানি, স্বাধীনতা এবং ঐক্য একটা দেশের দুইটা বড় সম্পদ। বিগত ৫৩ বছর আমরা এই সম্পদকে ধরে রাখতে পারিনি। কারণ আমাদের জনপ্রতিনিধিরা মূলত ‘জনপ্রতিনিধি’ ছিলেন না বলেও।
আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম, এখনো আছি, ২০২৪ আগস্টের পর। কারণ তখন যে গণশক্তির নবজাগরণ দেখেছি, জনগণের নতুন আত্মপ্রত্যয় ও নিজ ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতনতা লক্ষ করি। সেগুলো গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। কিন্তু আমরা এই উপাদানগুলোকে কাজে লাগাতে পারছি না, যেভাবে কাজে লাগানোর কথা ছিল। আশা ও স্বপ্ন ছিল।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
আমরা এখনো সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রুর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে আপস করছি। কোথাও কোথাও শত্রুকে সহযোগিতাও করছি। কোথাও পুরনো জনবিরোধী বা গণবিরোধী স্বার্থকেও সুরক্ষা দিচ্ছি। তাই আশঙ্কা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের আসছে নতুন নির্বাচনে আমরা ‘কাদের’ নির্বাচিত করব। যাদেরই করি না কেন, তারা যেন সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি হওয়ার দৃষ্টান্ত দিতে পারেন। কোনো? দলের প্রতিনিধি এবং দলীয় নেতানেত্রীর প্রতিনিধির ওপরে। সে যেই হোন না কেন। দেশের সচেতন মানুষ সতর্ক থাকবেন। ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি’ কথার অর্থ তা হলেই সার্থক হবে।
মাহমুদ রেজা চৌধুরী : লেখক ও সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষক