জেনজি প্রজন্মের রাজনীতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও চ্যালেঞ্জ
বর্তমান বিশ্বে, বিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জেনজি (এবহ ত) প্রজন্মের রাজনীতি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনায় এসেছে। এই প্রজন্মের সদস্যরা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে এবং তারা ডিজিটাল যুগের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এই প্রজন্মের ব্যক্তিগত ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বেশ পরিবর্তিত হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত তথ্যপ্রবাহ, বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও আদর্শের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই প্রজন্মের রাজনীতির শিকড় কতটা দৃঢ় হবে, তা নির্ভর করবে তাদের নিজেদের সংগ্রাম, চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান খোঁজার ওপর।
ডিজিটাল যুগের রাজনীতি
জেনজি প্রজন্মের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তারা প্রযুক্তির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। সামাজিক মাধ্যমের যুগে বেড়ে ওঠা এই প্রজন্ম রাজনৈতিক তথ্য আদান-প্রদান, মতামত প্রকাশ এবং সংগঠন গঠনে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ইত্যাদি সামাজিক মিডিয়া তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হয়ে উঠেছে। তারা তাদের চিন্তাভাবনা দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পারে এবং এর মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ‘ইষধপশ খরাবং গধঃঃবৎ’ বা ‘গব ঞড়ড়’ আন্দোলনগুলো বিশ্বের নানা প্রান্তে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল, যা জেনজি প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফল। তবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের রাজনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। মিথ্যা তথ্য বা ফেক নিউজ ছড়ানো, সাইবার বুলিং এবং গণমাধ্যমের ভুল প্রপাগান্ডা এই প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে পারে। এ কারণে তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও পরিপক্বতা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
পরিবেশগত সচেতনতা
পরিবেশগত সমস্যা আজকের দিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, প্লাস্টিক দূষণ, বনভূমি নিধন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে জেনজি প্রজন্ম অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এই প্রজন্মের সদস্যরা বিভিন্ন পরিবেশগত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে, যেমনÑ গ্রেটা থুনবার্গের নেতৃত্বে গঠিত ‘ঋৎরফধুং ভড়ৎ ঋঁঃঁৎব’ আন্দোলন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বেড়ে ওঠা যুবসমাজও এই সমস্যাগুলো নিয়ে আন্দোলন করছে। ভবিষ্যতে পরিবেশগত পরিবর্তন এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত রাজনীতি জেনজি প্রজন্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে চলেছে।
বৈষম্য ও সামাজিক ন্যায়
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
জেনজি প্রজন্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তাদের সাম্যের প্রতি আকর্ষণ। লিঙ্গবৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য এবং সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই মুক্তমনা। তারা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার, সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্য প্রায়ই রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়।
বিশ্বব্যাপী জেনজি প্রজন্মের মধ্যে সমকামী অধিকার, নারী অধিকার এবং মানুষের মানবাধিকার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে থেকেও এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে চায়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও চাকরি সংকট
বিশ্বের বহু দেশে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেকটা ধীরগতিতে চলছে। বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রজন্মের সদস্যরা উচ্চশিক্ষা লাভের পরও কর্মসংস্থানের সঠিক সুযোগ পাচ্ছে না, যা তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করছে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে আগামী দিনে এই প্রজন্মের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আরও শক্তিশালী হতে পারে। তবে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং ডিজিটাল শিল্পের বিকাশ, স্টার্টআপ সংস্কৃতি ইত্যাদি জেনজি প্রজন্মকে নতুন চাকরি এবং উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই প্রজন্ম তাদের ক্ষমতা ও উদ্ভাবনশীলতার মাধ্যমে এক নতুন অর্থনৈতিক যুগ সৃষ্টি করতে পারে।
রাজনীতি ও ভোটদান
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
জেনজি প্রজন্মের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রবণতা কম বলে মনে হলেও একাধিক দেশে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে, তারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে শুরু করেছে। তারা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে যোগ দেয়, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তাদের আস্থা খুব বেশি নয়। বাংলাদেশেও এই প্রজন্মের মধ্যে ভোটদান ও রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। তারা রাজনীতির প্রতি সাদৃশ্যপূর্ণ বা আস্থাশীল না হলেও দেশের ভবিষ্যতের জন্য তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বা স্কুলে রাজনীতি বিষয়ে আলোচনার অভাব এবং কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিরোধিতা রাজনীতির প্রতি এই প্রজন্মের অনীহা সৃষ্টি করেছে। তবুও ভবিষ্যতে তরুণ ভোটার হিসেবে তাদের ভূমিকা বহুমুখী হয়ে উঠতে পারে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা
জেনজি প্রজন্মের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, পরিবেশগত সচেতনতা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের ওপর। তারা যে রাজনৈতিক কাঠামো এবং আদর্শ তৈরি করবে, তা তাদের রাজনৈতিক সংহতি, সচেতনতা এবং যুক্তির ওপর ভিত্তি করে হতে হবে। এই প্রজন্মের পক্ষে রাজনীতির ক্ষেত্রটি একেবারে নতুন, তবে সৃজনশীলতা, নতুনত্ব এবং সমাধানের প্রতি আগ্রহ তাদের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
নতুন প্রজন্মের চ্যালেঞ্জগুলো শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্বের জন্যও অনেকটা অভিন্ন। প্রযুক্তি, অর্থনীতি, পরিবেশ এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেবল জাতীয় স্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
জেনজি প্রজন্মের রাজনীতি একটি বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতের বিশ্বরাজনীতির এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। তাদের রাজনৈতিক আস্থাশীলতা, একযোগিতার চিন্তা, পরিবেশের প্রতি যত্ন এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা আধুনিক বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, এই প্রজন্মকে যথাযথ শিক্ষা, সমর্থন ও সুযোগ প্রদান করা একান্ত জরুরি, যাতে তারা নিজেদের রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর উপস্থাপন করতে পারে এবং আগামী দিনের একটি সুস্থ, সমৃদ্ধ ও সমন্বিত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিল্লাল বিন কাশেম : কবি, লেখক ও কলামিস্ট