মাতৃভাষায় শিক্ষা দেশাত্মবোধের সূচনাপাঠ

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
মাতৃভাষায় শিক্ষা দেশাত্মবোধের সূচনাপাঠ

বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বিশাল আত্মত্যাগের মহিমা বাঙালি জাতির জন্য শুধু গৌরবগাথা নয়, এটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করে সমগ্র বিশ্ব আজ গৌরবদীপ্ত হয়েছে। খ্যাতিমান ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে এর প্রকাশকালকে যদি চিহ্নিত করা হয়, তাহলে এই ভাষার সমৃদ্ধির ইতিহাস প্রায় চৌদ্দশ বছর। বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, বিকাশ ও প্রসারে এই মাতৃভাষার অবদান শুধু ঐতিহ্য বা কৃষ্টিম-িত নয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই ভাষার অবদান এক অসাধারণ চেতনায় বিশেষ বৈশিষ্ট্যম-িত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে দীর্ঘ সংগ্রামের পথপরিক্রমায় ঋদ্ধ প্রাণশক্তিতে পরিপুষ্ট হয়ে মাতৃভাষা বাংলা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শক্ত ভিত নির্মাণ করেছে। একুশের চেতনায় ভাস্বর মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক নীতিগুলো জাতিসত্তার সামগ্রিক আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচ্য।

শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। বিশ্বজনীন এই সত্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের যে সাবলীল পদযাত্রা, শিক্ষা সেখানে প্রধান নির্ঘণ্ট হিসেবে চিহ্নিত। এটি শুধু একক রাষ্ট্র বা জাতির উন্নয়ন সূচক হিসেবে নয়, বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে এটি প্রধান নিয়ামক হিসেবে সর্বত্র গৃহীত। এটি সর্বজনবিদিত, যে জাতি যত বেশি শিক্ষায় উন্নত হতে পেরেছে বর্তমান বিশ্বে সে জাতিই সমধিক উন্নত রাষ্ট্র বা জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আর্থসামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষা, বিশেষ করে মাতৃভাষায় শিক্ষার নিবিড় সম্পর্ক বিশ্বের শীর্ষ প্রাগ্রসর জাতিগুলোতে বলিষ্ঠভাবে স্বাক্ষর রেখেছে। প্রতিবছর একুশের আগমনে আমরা মাতৃভাষার প্রতি আবেগতাড়িত হই এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর নির্যাস উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। কিন্তু তার রেশ বেশিদিন বিরাজমান থাকে না, আমাদের অভিজ্ঞতা তারই সাক্ষ্য বহন করে। মাতৃভাষা বাংলাকে প্রায়োগিক অর্থে যথাযথ মূল্যায়ন না করে এবং সর্বত্র এর বিকাশমানতাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি অথবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনে আমাদের তৎপরতা কোনভাবেই জাতির সামষ্টিক উন্নয়নে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না। মাতৃভাষার মাধ্যমে সব স্তরে এবং সব জনপদে শিক্ষাকে যদি কার্যকরভাবে জনপ্রিয় করা না যায় তাহলে শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং এর প্রাসঙ্গিক উন্নয়ন নিয়ামকগুলোর তুলনামূলক প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটিই ইতিহাসস্বীকৃত।

আমাদের দেশে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমকে ঔপনিবেশ শাসনকাল থেকেই নিরুৎসাহিত করা হচ্ছিল। মূলত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে আন্দোলন সূচিত হয়েছিল, তার পেছনে প্রধান রাজনৈতিক যুক্তিটি ছিল যে তৎকালীন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪.৬% মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা, যার বিপরীতে ৬.১% ছিল পাঞ্জাবিভাষী, ২৭.১% পশতুভাষী, ৪.৮% সিন্ধিভাষী, ১.৪% ইংরেজিভাষী। তখন উত্তর ভারত থেকে পাকিস্তানে স্থানান্তরিত মাত্র ৬% জনগণের মাতৃভাষা ছিল উর্দু। বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি, ঐতিহ্যে ও সাংস্কৃতিক সব উপাদানের যে মূলভিত্তি তথা বাংলা ভাষাকে চরম অবহেলা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে উদ্যোগ সে সময়কার শাসকদের মধ্যে কাজ করছিল, তা ছিল সুদূরপ্রসারী এবং গভীর ষড়যন্ত্রের অংশবিশেষ। প্রায় ৫৫% জনগণের সামগ্রিক উন্নয়ন যে ভাষাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর নির্ভরশীল এবং এটি যে এই অঞ্চলকে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে এই উপলব্ধি থেকেই পশ্চিমা শাসকরা প্রথম থেকেই বাংলা ভাষাকে পদদলিত করার সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।

বাংলা ভাষাকে অবহেলা করার যে প্রবণতা তা যে শুধু ব্রিটিশ শাসিত ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তান শাসিত অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক যুগে সম্প্রসারিত হয়েছিল তা নয়, এর বহু আগে থেকে বিশেষ করে তুর্কি শাসনের সময় থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি বিরূপ ধারণা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। সে জন্য মধ্যযুগে বাংলাভাষার মর্যাদাকে স্বশাসনে প্রতিষ্ঠাকল্পে কবি আব্দুল হাকিম তার ‘বঙ্গবাণী’ শীর্ষক এক কবিতায় লিখেছেন- “যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ এটি যে শুধু একটি ব্যঙ্গাত্মক কথোপকথন বা কোনো রচনার পঙ্্ক্তি ছিল তা নয়, তা ছিল এই অপশাসন এবং বাংলা ভাষা অবমূল্যায়নের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের প্রকাশ। ‘আমার ধ্যানের ভারত’ শীর্ষক রচনায় ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী) বলেছেন- ‘মাতৃভাষাকে স্থানচ্যুত করার পদ্ধতিকে, ইংরেজদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ইতিহাসের একটি দুঃখজনক অধ্যায় বলে বর্ণনা করা যেতে পারে।’ তিনি বলেন, রামমোহন রায় আরও বড় সংস্কারক এবং লোকমান্য তিলক আরও বড় প-িত হতে পারতেন যদি তারা তাদের চিন্তাধারাকে ইংরেজিতে চিন্তা বা প্রকাশ না করে তাদের মাতৃভাষায় তার প্রকাশ ঘটাতেন। অবশ্যই এসব গুণী ব্যক্তি ইংরেজি সাহিত্যের সুসমৃদ্ধ রত্নভা-ারের জ্ঞান দ্বারা উপকৃত হয়েছিলেন, নিজেদের মাতৃভাষার মাধ্যমে না হওয়ায় এ জ্ঞান অর্জন কতটুকু জনগণের উপকারে এসেছে তা প্রশ্নের দাবি রাখে।

নিজের মাতৃভাষায় জ্ঞানের সমৃদ্ধিকরণকে অবহেলা করে গান্ধী মনে করেন, একদল অনুবাদকের সৃষ্টি করে কোনো জাতি মহৎ কিছু অর্জন করতে পারে না। মাতৃভাষায় চিন্তা, মত প্রকাশ এবং সামগ্রিক অর্থে জ্ঞান অর্জনের যে ধারা সেটি বিশ্বের শীর্ষ উন্নত দেশগুলোর কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। জাপানের শিক্ষা কার্যক্রম যদি আমরা দেখি, তাদের প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে ছয় বছর, মাধ্যমিক শিক্ষা তিন বছর এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা তিন বছর- অর্থাৎ ১২ বছর অধ্যয়ন শেষে তারা উচ্চ বিদ্যালয়ের সমাপনী ডিগ্রি অর্জন করে। এরপর সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়ে ৪ বছরকাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনের পর অর্থাৎ ১৬ বছরকাল অধ্যয়ন শেষে জাপানের ৮০%-এর অধিক ছাত্র সরাসরি কর্মজীবনে নিয়োজিত হয়। বাকিদের মধ্যে অল্পসংখ্যক দুই বছরের জন্য মাস্টার্স প্রোগ্রাম বা পরবর্তী ৩ বছরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনে ব্রতী হন। এখানে উল্লেখ করার বিষয় এই যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাতৃভাষা বা জাপানি ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা সেখানে প্রচলিত নয়। মাধ্যমিক স্কুলের দ্বিতীয় বা তৃতীয় গ্রেড থেকে তাদের প্রথম ইংরেজি শিক্ষা চালু হয়।

মুখ্যত শিক্ষা কার্যক্রমের সব পর্যায়ে মাতৃভাষায় লিখিত বা অনূদিত পাঠ্যবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে পাঠ্যসূচির বিষয়গুলো সম্যক উপলব্ধির চেষ্টা করে। ফলে অন্য কোনো ভাষার চেয়ে মাতৃভাষায় পঠনপাঠন তাদের যে সব ক্ষেত্রেই বিশেষ প্রণোদনা জোগাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু জাপান কেন, চীন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন, কানাডা, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্কসহ প্রায় সব উন্নত রাষ্ট্রে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা সে দেশের উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। বস্তুত বর্তমান আধুনিক যুগে সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতার দুটি প্রধান উৎস হলো অর্থ ও জ্ঞান। পুঁজিবাদী সমাজে জ্ঞান বা শিক্ষা একটি মূলধন হিসেবে বিবেচিত এবং অন্য সব পণ্যের মতো জ্ঞান বা বিদ্যারও ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। এ দেশের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছিল তার মূলে ছিল ব্যয়বহুল ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন এবং তা ছিল সম্পদশালী জমিদারগোষ্ঠী বা ভূমিব্যবস্থার মাধ্যমে সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণির দখলে। এ প্রসঙ্গে কার্ল মার্কসের বক্তব্য ছিল- ভারতীয়দের কলকাতাকেন্দ্রিক ইংরেজদের তত্ত্বাবধানে সরকারি প্রয়োজনে যৎকিঞ্চিৎ শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং ইউরোপীয় বিজ্ঞানে অনুপ্রাণিত যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছিল, তারা শুধু নতুন জমিদারগোষ্ঠী নয়- ভূ-সম্পত্তিতে একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠার ফলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণে লালনকর্তা হিসেবে সমাজে শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত হওয়া এবং সমাজের নেতৃত্ব লাভের সুযোগ পেয়েছিল।

১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সৃষ্ট জমিদার শ্রেণি এবং পরবর্তীকালে ভারতের সর্বত্র ভূমিব্যবস্থার যে পরিবর্তন তারই অনিবার্য ফসল ছিল এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সমাজের উপরিকাঠামোর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে শিক্ষাব্যবস্থা সর্বত্র বিবেচিত হয়ে এলেও এটি সর্বজনবিদিত যে, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটি বৃহৎ অংশ প্রায় সব সমাজের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে দেশমাতৃকার স্বাজাত্যবোধের পরিচর্যায় এক প্রগতিশীল শক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখে আসছিল। এর ধারাবাহিকতায় ইংরেজি শিক্ষার প্রাধান্য এবং বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা আমাদের জাতিকে যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে কতটুকু পেছনে ফেলে রেখেছে আজ গুরুত্বসহকারে তা বিবেচনা করতে হবে। একুশকে যদি সত্যিকার অর্থে আমাদের চেতনায় সার্বক্ষণিক উজ্জীবিত দেখতে চাই তাহলে মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও জোরদার ও জোরালো করে সব জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এটিই হবে অমর একুশের অবিনাশী শাশ্বত চেতনার গৌরবোজ্জ্বল অমিয় স্মারক।


ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী