উরুগুয়ের হোসে মুহিকা ও টিউলিপ’স টেরিটোরি
উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাকে বিশ্বের গরিব প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনে করা হতো। তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েও কোনো দিন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বসবাস করেননি। মন্টেভিডিওর অদূরে একটি এক কামরার অ্যাপার্টমেন্টে স্ত্রী আর ম্যানুয়েলা নামের তিনপেয়ে কুকুরকে নিয়ে থাকতেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রাপ্য মাসিক ১২ হাজার ৫০০ ডলার বেতনের মাত্র ১০ শতাংশ অর্থাৎ ১ হাজার ২৫০ ডলার নিতেন, বাকিটা দান করে দিতেন। তিনি বলতেন, ‘এর চেয়েও কম টাকায় উরুগুয়ের অনেক মানুষের জীবন চলে, আমার তো বেশ চলে যাচ্ছে।’ হোসে মুহিকার কোনো ব্যাংক হিসাব নেই, নেই কোনো ঋণও। নিজেকে কৃষক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী এখনও জীবন যাপন করেন ক্রিসানথিমাম ফুল চাষ করে। যখন তাকে বলা হলো তিনি বিশ্বের সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট, তখন তিনি সহাস্যে জবাব দিয়েছিলেন গরিব তিনি নন, গরিব হলো তারা যাদের চাইÑ আরও চাই আরও চাই। তিনি নিজেই গাড়ি চালান, বিমানে ইকোনমি ক্লাসে চড়েন। নিয়ম অনুযায়ী রাজনীতিবিদ হিসেবে তাকে তার সম্পদের বিবরণ ঘোষণা করতে বলা হলে হোসে মুহিকা ২০১০ সালে দেখিয়েছিলেন যে, তার মোট সম্পত্তির আর্থিক পরিমাণ ১৮০০ ডলার।
২০১৫ সালর ১ মার্চ তিনি প্রেসিডেন্টের অফিস ছেড়ে যান। তখন বিবিসি লিখেছিল, উরুগুয়ের অর্থনীতি তিনি রেখে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যবান আর স্থিতিশীল অবস্থায়, লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোর অর্থনীতি যার ধারেকাছে নেই। উরুগুয়ের মানুষ আদর করে তাকে ‘পেপে’ বলে ডাকে। তিনি ছিলেন জনমানুষের প্রেসিডেন্ট, মানুষের মঙ্গলই ছিল ধ্যানজ্ঞান। তিনি ছিলেন ভোগবিলাস কমানোর পক্ষপাতি। ছোট এই পৃথিবী এত মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাপনের উপযোগী কিনা, সে প্রশ্ন তিনি তুলতেন প্রায়ই। দেশের জনগণ চাওয়ার পরও তিনি দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। হোসে মুহিকা মানবিক সম্পর্ক, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, সৌহার্দ্য আর পরিবারের শক্তির ওপর ভিত্তি করে নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার ওপর জোর দিতেন। রাজনৈতিক জীবনে হোসে মুহিকা প্রায় ১৫ বছর জেল খাটেন, এর মধ্যে বেশির ভাগ সময় তাকে কাটাতে হয় নির্জন সেলে কিংবা অন্ধকার প্রকোষ্ঠে।
উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকার মতো পৃথিবীর আরও অনেক রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান, রাজনীতিবিদ সাদামাটা এবং সৎ জীবন যাপন করে গেছেন বা এখনও অনেকে করছেন। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাদের একজন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পারিবারিক জীবনযাপন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সহকর্মীদের নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তিনি নিজ হাতে তার জামাকাপড় কাচতেন। তিনি স্বাধীনতার পর অর্থমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বা পরবর্তী সময়েও সাদামাটা ও সৎভাবে জীবন কাটিয়ে গেছেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দ্বারা দারুণভাবে সমালোচিত হলেও তার ব্যক্তিগত সততার নজির রেখে গেছেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালামসহ অনেক বিখ্যাত রাজনীতিবিদ সৎ জীবনযাপনের জন্য আলোচিত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। একেবারেই সাদামাটা, সৎ জীবন যাপন করে গেছেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মিতব্যয়ী জীবনধারার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। পরিবারটি কলকাতার বালিগঞ্জে দুই কক্ষের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকত। বুদ্ধদেব এই বাড়ি থেকেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। এক দশক মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে গেলেও তিনি কখনো মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে থাকেননি। ত্রিপুরার মানিক সরকার চারবার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন (১৯৯৮ সালের মার্চ মাস থেকে ২০১৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত)। তিনি একটি পুরনো এবং খুব ছোট বাড়িতে বসবাস করতেন, যা তার পিতামহের ছিল। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যে বেতন পেতেন তা তার দলকে দান করতেন এবং বিনিময়ে প্রতি মাসে ভাতা হিসেবে ১০ হাজার টাকা পেতেন। সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছিল, মানিক সরকার যখন সরকারি গাড়িতে অফিসে যেতেন, তখন তার স্ত্রী বাজার করে রিকশায় বাসায় ফিরতেন। ত্রিপুরার আরেক রাজনীতিবিদ নৃপেন চক্রবর্তী, যিনি ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ঢাকার বিক্রমপুরে জন্ম নেওয়া নৃপেন চক্রবর্তী ১০ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরও সাদামাটা ও সৎভাবে জীবন যাপন করে গেছেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
দেশ ও বিদেশের ওই সব রাজনীতিবিদ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীর সৎ জীবনযাপনের বিপরীতে বাংলাদেশে বর্তমান রাজনীতিবিদদের জীবনযাপন কেমন? এখানে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, সরকারি দলের শীর্ষ নেতা থেকে পাতি নেতা, কর্মী, পুলিশ ও প্রশাসনের বিরাট অংশের শত শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জন, ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেন, বিদেশে অর্থ পাচারের খবর সবিস্তারে প্রতিদিনই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। বিলাসবহুল একাধিক ফ্ল্যাট, বাগানবাড়ি, রিসোর্ট, নজিরবিহীন অঙ্কের ব্যাংক ব্যালেন্স, একাধিক দামি গাড়ি এসব যেন উল্লিখিত ব্যক্তিদের কাছে খুব সাধারণ বিষয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ দুর্নীতর কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলের নজিরবিহীন দুর্নীতির কয়েকটি উদাহরণ থেকে প্রমাণ মিলবে যে, দুর্নীতির কী বিষবৃক্ষ তিনি রোপণ করে গেলেন। শেখ হাসিনার নিজের দেওয়া একটি বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হবে লাগামছাড়া দুর্নীতি করাকে তিনি যে এক ধরনের লাইসেন্স দিয়েছিলেন। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে পতন হওয়ার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমার বাসায় কাজ করে গেছে পিয়ন, সে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। এটা বাস্তব কথা। কী করে বানাল এই টাকা। যখন আমি জেনেছি, তাকে বাদ দিয়ে কার্ড সিজ করে আমি ব্যবস্থা নিয়েছি। এটা তো হয়।’ শুধু কি শেখ হাসিনার বাসার পিয়ন, পরিবারের সদস্য আর আশীর্বাদপুষ্ট মন্ত্রী, এমপি, দলের নেতা, কর্মী, পুলিশের আইজি, সচিব, ব্যবসায়ীসহ বিরাট অংশ দুর্নীতির মহোৎসবে মেতে উঠেছিল। একজন ব্যবসায়ী সাতটি ব্যাংক কার্যত দখল করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে নিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম দিকে এসব ব্যাংকের গ্রাহকদের ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে পারেনি। হাজার হাজার গ্রাহক সীমাহীন দুর্ভোগ পোহান। পরে এসব ব্যাংকের সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০ হাজার কোটি টাকা ছাপাতে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে।
বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ আমলের দুর্নীতির ফিরিস্তির কিছু অংশ অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া সংবাদপত্রের পাতায় প্রতিদিন শেখ হাসিনার আমলের দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশিত হচ্ছে। তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা ও তার আত্মীয় মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে বিমানবহরের প্রকল্পের নামে ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এ দুর্নীতির অভিযোগে তারিক সিদ্দিকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জেনারেল (অব.) তারিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের আগে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয় যে, গাজীপুরে একের পর এক রিসোর্ট ও বাগানবাড়ির সন্ধান মিলছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা পরিবারের সদস্যদের। যুক্তরাজ্যে শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ ওঠা এবং তার পদত্যাগের পর দেশেও রেহানা পরিবারের সদস্যদের সম্পদের খোঁজ করছে দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধানে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য মিলেছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়, প্রায় ৩৫ বিঘা জমির ওপর নির্মিত বাগানবাড়িতে কী নেই। বাংলো, পুকুর, হরেক রকমের ফুল ও ফলের গাছ। এর নামকরণ করা হয়েছে টিউলিপের নামে “টিউলিপ’স টেরিটোরি”। টিউলিপ’স টেরিটোরিতে রয়েছে বিশেষ ধরনের ডুপ্লেক্স বাড়ি, বিশাল আকারের পুকুর, বিস্তৃত জলাশয়সহ আরও অনেক কিছু। নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন। রয়েছে নিটিং কারাখানা। সম্প্রতি বিক্রি করা হয়েছে দশতলা একটি ভবন। দুদক জানিয়েছে, প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে টিউলিপ’স টেরিটোরি গড়ে তোলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারের আমলেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কমবেশি দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তির দুর্নীতির সূচনা হয় এইচএম এরশাদের হাতে। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে পতনের পর এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তিনি জাপানি বোট কেলেঙ্কারি ও জনতা টাওয়ার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হন এবং জেলে যান; যার কারণে ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য ঘোষিত হন। টিআইয়ের (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল) দুর্নীতির সূচকে বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশ তিনবার প্রথম হয়। তবে সব আমল ছাড়িয়ে গেছে শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরর স্বৈরশাসন আমলের দুর্নীতি। ক্যানসারের মতো এই দুর্নীতি এমনভাবে ছড়িয়েছে যে, এর থেকে নিরাময় আদৌ সম্ভব কিনা, সেই প্রশ্ন এখন থেকেই যায়।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
খায়রুল আনোয়ার : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!