স্বাস্থ্য খাতে নতুন বন্দোবস্তের প্রয়োজন কেন
স্বাস্থ্যসেবা একটি মৌলিক অধিকার। এর প্রয়োজনীয়তা নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। মানুষ প্রতিনিয়ত শত প্রতিকূলতার মাঝেও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে মানুষকে রোগমুক্ত থাকা, রোগাক্রান্ত হলে তা থেকে মুক্ত হওয়া এবং রোগবালাই ছড়ানো প্রতিরোধÑ এই তিন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সুস্থ থাকার জন্য রোগবালাই সম্পর্কে যেমন প্রাথমিক ধারণার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সুস্থ ধারার জীবনশৈলী। রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সামাজিক বা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। জীবনশৈলী ও জনস্বাস্থ্য এ দুটি জনসম্পৃক্ত বিষয়, যার জন্য হাসপাতালের বাইরে সমাজে এক ধরনের ভিন্নতর আয়োজন বা কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন হয়। আর চিকিৎসাসেবার জন্য প্রয়োজন হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা। স্বাস্থ্যসেবা বলতে আমরা জীবনশৈলী, জনস্বাস্থ্য এবং চিকিৎসাসেবাÑ সব কিছুকে একসঙ্গে বুঝে থাকি। স্বাস্থ্য খাতের ভাবনায় এ সবগুলো বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে।
যদিও সাধারণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা মানে চিকিৎসাসেবা। চিকিৎসাসেবা মানে হাসপাতাল ও চিকিৎসক। বিষয়টি স্বাস্থ্যসেবাকে খণ্ডিত রূপে উপস্থাপন করে বিধায় স্বাস্থ্য খাতে সবার চিন্তাভাবনায় এক ধরনের সংকীর্ণতা বা অপূর্ণতা কাজ করে। ফলে স্বাস্থ্য খাত সব সময় এক ধরনের অযত্ন আর অবহেলার শিকার হচ্ছে। দেশে স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান অনেক হাসপাতাল হলেও এর গুণগত মান, ব্যবস্থাপনা, সহজলভ্যতা- এগুলো নিয়ে প্রশ্ন আছে।
এখনও বিশেষায়িত অনেক চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয়। ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে প্রতিবছর বিদেশে চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। সমাজের অগ্রসর অংশের কেউ কেউ বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ গ্রহণে সমর্থ হলেও অধিকাংশের ভাগ্যে সেটি সম্ভব হয় না। এটি সমাজে এক ধররের বৈষম্য সৃষ্টি করে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে।
স্বাস্থ্য খাতের জন্য নতুন বন্দোবস্তের প্রয়োজন। কারণ গতানুগতিক ধারায় স্বাস্থ্য খাত যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে চিকিৎসকসমাজ যেমন হতাশায় নিমজ্জিত, তেমনি চিকিৎসা খরচের ভারে সাধারণ মানুষও পিষ্ট। চিকিৎসকদের হতাশার কারণ বিবিধ। সদ্য পাস করা চিকিৎসক হতাশ, কারণ তার সামনে চাকরির সুযোগ সীমিত। প্রশিক্ষণেচ্ছু চিকিৎসক হতাশ, কারণ তার ক্যারিয়ার প্ল্যানিং বা উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থাপনা সংকুচিত ও কণ্টকাকীর্ণ। স্নাতকোত্তর চিকিৎসক পদোন্নতি ও বেতন-ভাতাদিতে এক ধরনের বৈষম্যের শিকার। ক্যাডারে যেসব চিকিৎসক কর্মরত তারা আন্তঃক্যাডার নজিরবিহীন বৈষম্যের শিকার।
বর্তমান ব্যবস্থাপনায় সরকারি চিকিৎসকদের পদোন্নতির বিষয়টি এক জটিল আকার ধারণ করে আছে। যেমনÑ চাকরিতে প্রবেশের পর বিভিন্ন ক্যাডারে নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ হলে পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হন। চিকিৎসকদের বেলায়, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বেলায় মেয়াদ ছাড়াও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির আবশ্যকতা রয়েছে। আর এই স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য প্রয়োজন বিশেষ প্রশিক্ষণ। এর বাইরেও তাদের পদোন্নতির জন্য গবেষণার আবশ্যকতা আছে। শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে কিছুটা মিল আছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হতে গিয়ে একজন চিকিৎসককে অতিরিক্ত ৫-৭ বছর শিক্ষানবিশ হিসেবে কাটাতে হয়। এত কিছুর পরে যখন একজন চিকিৎসক নিজেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে উন্নীত করেন, তখন তিনি সাধারণ চিকিৎসকের চেয়ে বেশি মূল্যমানের চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বর্তমান কাঠামোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মানেই পদোন্নতি, বিষয়টি এমন নয়। অর্থাৎ একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনেক বেশি মূল্যমানের চিকিৎসা দিলেও পদোন্নতি না হওয়ায় তিনি কোনো ধরনের ইনসেনটিভ ছাড়াই নিজ বেতনের একজন সাধারণ চিকিৎসক বা মেডিক্যাল অফিসারের মতোই বেতন-ভাতাদি উত্তোলন করে থাকেন। অনেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা প্রদান থেকেও বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হন যথাস্থানে পোস্টিং না হওয়ার কারণে। অথচ একই চিকিৎসক সরকারি ব্যবস্থাপনার বাইরে কর্পোরেট হাসপাতালগুলোতে কয়েক গুণ বেশি পারিতোষিক গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ বেসরকারি পর্যায়ে কখনোই একজন বিশেষজ্ঞ চিকৎসককে সাধারণ চিকিৎসক বা মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যেহেতু বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা প্রদান করবেন, তাই তার পদমর্যাদা একজন মেডিক্যাল অফিসার থেকে আলাদা হবে এটাই যুক্তিযুক্ত। বর্তমান স্বাস্থ্যকাঠামোতে এই বৈষম্যটুকু সুরাহা করার কোনো ধরনের প্রচেষ্টা নেই। গতানুগতিক পদোন্নতির ধারাবাহিকতায় হাজার হাজার বিশেষজ্ঞ এই বৈষম্যের শিকার।
বর্তমান ক্যাডার সিস্টেমে বিষযটি যেভাবে আছে তাতে স্নাতকোত্তর চিকিৎসকদের জন্য কোনো আশার বাণী নেই। কারণ যাদের হাতে এই চিকিৎসকদের সব কিছু নিয়ন্ত্রণের ভার অর্পণ করা আছে তারা বিষয়টি কোনোমতেই অনুধাবন করতে সমর্থ নন। দু-একজন আংশিক অনুধান করতে পারলেও সিস্টেমের ত্রুটির কারণে সুরাহা করতে পারবেন না। অর্থাৎ একজন সাধারণ চিকিৎসক, একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, একজন প্রশাসক চিকিৎসকÑ বিষয়গুলোর জন্য স্বতন্ত্র অথচ সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োজন। পারিতোষিক এবং সুযোগ-সুবিধা, কর্মস্থল ইত্যাদিতে ভিন্নতা থাকা প্রয়োজন। বর্তমান ক্যাডার কাঠামোতে এটি জটিল একটি সমীকরণ। যথাযথভাবে অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও পদক্ষেপ নিতে হলে বর্তমান কাঠামোতে কোনোমতেই সম্ভব নয়। চিকিৎসক শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতনকাঠামো এবং ক্যারিয়ার প্ল্যান থাকা আবশ্যক, যেটি বর্তমান কাঠামোতে অনুপস্থিত।
বর্তমান কাঠামোতে চিকিৎসা শিক্ষাই কেবল রুগ্ন হচ্ছে তাই নয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলো, বিশেষ করে বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো বর্তমান কাঠামোতে নিজেদের সমস্যাগুলোর সমাধানে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে পারে না। সেটি জনবল সংকট হোক বা যন্ত্রপাতির সংকট হোক, তার জন্য মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এতে দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও সমাধান।
স্বাস্থ্য খাতে জনবলের সংকট সর্বজনবিদিত একটি বিষয়। জনবল সংকট কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি স্বাস্থ্য খাতকে বেশ নাজুক করে ফেলেছে। বিশেষায়িত অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসক, নার্স এবং পেরামেডিকস ও টেকনিশিয়ান জনবলে প্রচুর ঘাটতি আছে, যেটি যুগ যুগ ধরে বহাল থেকে যাচ্ছে। এরপর সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের নিবর্তনমূলক বদলির খড়্্গ নেমে আসে, যেখানে ব্যক্তির পাশাপাশি হাসপাতালগুলোও এক ধরনের সংকটে পড়ে যায়। স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। জনবল তৈরিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বিষয়গুলো সবারই জানা। অথচ রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এখান থেকে বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমান স্বাস্থ্যকাঠামোতে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় সুদূর পরাহত।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে- এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? উপায় খুবই সহজ। উন্নত দেশগুলো যেভাবে তাদের স্বাস্থ্য খাতের উত্তরণ ঘটিয়েছে, আমাদেরও একই রাস্তায় হাঁটতে হবে। এর মধ্যে সোজা রাস্তা হলো স্বতন্ত্র স্বাস্থ্য কমিশন। স্বতন্ত্র কমিশন কেবল বাজেট এবং সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোতে সরকারের ওপর আংশিক নির্ভরশীল থাকবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের সব পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা, নিয়োগ, পদোন্নতিসহ জনবলকাঠামোর সার্বিক তত্ত্বাবধান নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে। চিকিৎসা শিক্ষা বা মেডিক্যাল এডুকেশন, চিকিৎসকদের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও বেতনকাঠামো- এগুলো কমিশন ঠিক করবে। প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টার্শিয়ারি লেভেলের স্বাস্থ্যসেবার বিভাজন এবং একটি রেফারেল সিস্টেম প্রবর্তন করে কেন্দ্রের পাশাপাশি স্থানীয় ব্যবস্থাপনাও গড়ে তুলবে।
স্পেশালাইজড হাসপাতালগুলোকে এক ধরনের স্বায়ত্তশাসনের মতো এখতিয়ার দিতে হবে, যাতে তারা প্রয়োজনমাফিক নিজেদের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। প্রাইমারি লেভেলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও বিশেষায়িত হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা একই ধরনের হলে চলবে না। এর মধ্যে বিস্তর ফারাক। ব্যবস্থাপনায়ও এর বিভাজন থাকতে হবে। চিকিৎসা শিক্ষা, বিশেষায়িত হাসপাতাল, প্রাইমারি স্বাস্থ্যসেবা ও রোগ প্রতিরাধের জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা থাকা জরুরি। এগুলো বর্তমান কাঠামোতে খুবই অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ । স্বতন্ত্র কমিশনের পক্ষে এগুলো অধিকতর সক্ষমতার সঙ্গে পরিচালনা করা অনেকটাই সহজ হবে।
স্বতন্ত্র কমিশনের নাম শুনে অনেকের মনেই এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। স্বতন্ত্র কমিশন হলে সবচেয়ে লাভবান হবে চিকিৎসক। অথচ অনুমান করি, চিকিৎসকদের বিশাল এক অংশ এর বিরোধিতা করতে পারে। দুটি কারণে এমনটি হতে পারে। একটি অংশ মনে করে, স্বতন্ত্র কমিশন হলে চাকরি করা কঠিন হয়ে যাবে। একটু কঠিন হবে হয়তো যেহেতু জবাবদিহির জায়গাটা সংহত হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাব কমে যাওয়ায় অনেকের জন্য নেতৃত্বের জায়গাটা সংকুচিত হয়ে আসবে। প্রিভিলেজ হাতছাড়া হওয়ার অশঙ্কা তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনে উৎসাহিত করতে পারে। যদিও দেশের কথা ভাবলে অথবা স্বাস্থ্য খাতের কথা ভাবলে এসব মনোবৃত্তি আমলে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
পরিবর্তনের সুযোগ সব সময় থাকে না। সময় এসেছে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করার। প্রত্যেকের উচিত নিজস্ব পরিমণ্ডল ও ভাবনা থেকে বের হয়ে আসা। নিজস্ব মাইন্ড সেট পরিবর্তন করা। স্বাস্থ্য খাতের নতুন বন্দোবস্তের জন্য ভূমিকা রাখা। স্বাস্থ্য খাতকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে সবারই এগিয়ে আসা উচিত।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
অধ্যাপক ডা. মো. ছায়েদুল হক : চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক