পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল হওয়া কি যৌক্তিক সিদ্ধ্বান্ত?
দেশের সকল নাগরিকদের চাকরিসহ বিভিন্ন অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বিগত সময়ে এই পুলিশ ভেরিফিকেশনকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন কারণ দর্শানোর মাধ্যমে বিরোধীদল সমর্থনকারী এবং সরকারবিরোধী মত প্রকাশকারীদেরকে বাদ দেওয়া হতো। অনেক সময় পুলিশ এখানে ঘুষের বিনিময়ে ক্লিয়ারেন্স প্রদান করত। এছাড়াও সামান্যতম কারণেও বড় অঙ্কের ঘুষের মত বিষয়ের নজির রয়েছে। সাধারণত চাকরি, পাসপোর্ট, লাইসেন্স, বিদেশ গমন কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আবেদনকারীর তথ্য যাচাইয়ের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়। মোট ২১টি বিষয় নিয়ে এই ভেরিফিকেশন কাজ করে। যার মাধ্যমে চারিত্রিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়াদি যাচাই করা হয়। এই ভেরিফিকেশনের মধ্যে রয়েছে প্রার্থীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক তথ্য, বৈবাহিক তথ্য, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, আত্মীয়-স্বজন সরকারি চাকরিতে রয়েছেন কি না, প্রার্থীর পূর্ববর্তী চাকরির তথ্য এবং তার নামে মামলা সংক্রান্ত তথ্য ভেরিফিকেশন। এছাড়াও অনেক সময় ভাইবার আগে আন-অফিসিয়ালি প্রার্থী ও তার পরিবারের রাজনৈতিক সমর্থন এবং রাজনৈতিক ইতিহাস উদ্ঘাটন করা হত এবং ইচ্ছামতো প্রার্থীকে ভাইবার পূর্বেই বাদ দেয়া হত। পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ জানিয়েছেন ‘প্রার্থীর বা তার পরিবারের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করা অযৌক্তিক।’
১৮২৯ সালে প্রধানমন্ত্রী স্যার রবার্ট পিল প্রথম ব্রিটেনে পুলিশ ভেরিফিকেশন বিল পাশ করেন এবং ২০ শতকের শুরুতে এই প্রক্রিয়া ভারতীয় উপমহাদেশে চালু হয়। এই উপমহাদেশে পুলিশ ভেরিফিকেশন চালু হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সমর্থনকারীদের দমনের জন্য। কিন্তু এই প্রক্রিয়া চালু রাখা হয়েছে এক শতকেরও বেশি সময় ধরে। বর্তমানে ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে বিরোধী দল সমর্থনকারী এবং সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনাকারীকে দমন রাখা হয়। সরকারি চাকরি পাওয়া সোনার হরিণের মতো। তাই এই সোনার হরিণ হাতছাড়া কেউ করতে চাই না। বিশেষ করে পুলিশ ভেরিফিকেশনে এসে তো একদমই না। তাই নিজেদের মৌলিক অধিকার যেমন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ এর বাকস্বাধীনতার অধিকার মানুষ ত্যাগ করে শুধু পুলিশ ভেরিফিকেশনে ঝামেলা মুক্ত থাকার জন্য।
সম্প্রতি দেশ সংস্কারের অংশ হিসেবে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের সুপারিশ এসেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের থেকে। গত ১৭ ডিসেম্বর পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া পুরোপুরি তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের আবদুল মুয়ীদ চৌধুরি। কিন্তু গত ৬ জানুয়ারি, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন যে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নেওয়া রোধ করতে পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতি এখনই তুলে দেওয়া যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
তিনি বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনের কাজ করা গেলে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নিয়ম তুলে দেওয়া হবে কিন্তু তা এখন করা সম্ভব হচ্ছে না।’ কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন তুলে দেওয়ার সুপরিশটি এখনো বিদ্যমান আছে।
পুলিশ ভেরিফিকেশন বন্ধ করলে নাগরিকের প্রদত্ত তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। সরকারি চাকরি কিংবা পাসপোর্ট এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার যাচাইকরণ ছাড়া কাউকে প্রদান করা যেতে পারে না। কিন্তু অপরদিকে পুলিশ ভেরিফিকেশনে পুলিশের ঘুষ গ্রহণ প্রথা ও হয়রানি এবং প্রার্থীর বা তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচিতি, রাজনৈতিক ইতিহাস পুলিশ ভেরিফিকেশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সুতরাং এমন একটি পদ্ধতি সরকারকে তৈরি করতে হবে যাতে করে পুলিশ ভেরিফিকেশনের খারাপ দিক গুলো রোধ করা যায়, বিশেষ করে ঘুষ খাওয়ার প্রবণতা বন্ধ এবং হয়রানি রোধ করা যায়। এক্ষেত্রে এমন একটি ডেটাবেজ তৈরি করা যেতে পারে যেখানে একজন শিক্ষার্থীর স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত সার্টিফিকেট, পুলিশের মামলার ডেটাবেজ এবং অন্যান্য তথ্য যা একজন ব্যক্তি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য প্রদান করতে পারে তা জাতীয় পরিচয় পত্রের নম্বরের সাথে সংযুক্ত করতে হবে যাতে জাতীয় পরিচয় পত্রের নাম্বার দিয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ অন্যান্য কাজ করা যায়। এতে করে তথ্য ব্যবস্থাপনা অনেক উন্নত হবে। যেহেতু বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, সেহেতু এ ধরনের ডেটাবেজ থাকা অতীব জরুরি। সেজন্য সরকারকে অতিদ্রুত প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত পুলিশ ভেরিফিকেশন চালু রাখা যেতে পারে, তবে তা জেনো কোনো ভাবেই একজন মানুষের রাজনীতিক অধিকারকগুলোকে লঙ্ঘন না করে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
লেখক: ইসতিয়াক আহম্মেদ (৪র্থ বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, আইন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!