শুল্ক কর বৃদ্ধিতে সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কা

আনতারা তারান্নুম তাবিতা
২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১৮:২৭
শেয়ার :
শুল্ক কর বৃদ্ধিতে সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কা

শতাধিক পণ্য এবং সেবায় নানাধরণের শুল্ক বৃদ্ধি করে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাঝপথে অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। ট্যাক্স বাড়ানো হলেও দেশের মানুষের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে দাবি করছে সরকার। তবে চলতি অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এমন সিদ্ধান্তকে অনেক ব্যবসায়ী আত্মঘাতী বলছেন, কেউ কেউ দাবি জানাচ্ছেন ভ্যাট কমানোর, আবার কেউ কেউ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কারণ প্রতিনিয়তই মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর উপর এরূপ অন্যায্য শুল্কের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তাদের জীবনযাত্রা করে দেওয়া হচ্ছে দুর্বিষহ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে শুধু নিম্ন আয় ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ নয়; মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছে। তাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। 

শুল্ককর বাড়ানোর ফলে একদিকে যেমন সামাজিক ন্যায্যতা লঙ্ঘন হয়েছে, যা সরাসরি জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়ে প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে এটি নিম্ন-আয়ের মানুষ এবং মধ্যবিত্তদের উপর অধিক চাপ সৃষ্টি করছে। সহজ পন্থায়, ক্রেতার পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়ায় মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, সরকারের চোখ জনগণের টাকায়। যে পরিমাণ রাজস্ব প্রয়োজন, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনগণের পকেট থেকেই সেই সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বা যে পরিমাণ দরকার তা তুলে নিতে পারবে। এরাই বাস্তবায়নে প্রতিনিয়ত খামখেয়ালিভাবে শুল্ক বৃদ্ধি করে যাচ্ছে সরকার। কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে বাড়তি খরচ কেটে নিচ্ছে অপারেটরগুলো, আবার পোশাক-আশাকের দামও বাড়ছে ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে। বেড়েছে রেস্তোরাঁয় যাওয়ার খরচও। পণ্য এবং সেবায় ভোক্তাকে গুণতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। কমেছে বিক্রি, চাহিদার লাগাম টেনেছে ভোক্তা। এমনকি বিস্কুটে ভ্যাট তিনগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায়, উচ্চ করের কারণে ছোট এবং মাঝারি উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপক, যার ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাচ্ছে।

রাজধানীর বাজারে এক পোষাক ক্রেতা বলেন, এভাবে যদি পোশাকের দাম বাড়ে তাহলে আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার সন্তানদের জন্য কখনও আর জামা কাপড় কিনতে পারবো না। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, কোভিডের পর থেকে এমনিতেই পোশাকের ব্যবসা মন্দা। রোজার ঈদের আগে নতুন করে ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে ব্যবসায় আরও অবনতি হচ্ছে। 

সব ধরনের রেস্তোরাঁর বিলের ওপর ভ্যাট এক লাফে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এত দিন এই হার ছিল ৫ শতাংশ। ১ হাজার টাকা খাবারের বিলে ভোক্তাকে গুণতে হচ্ছে আরও বাড়তি ১০০ টাকা। সারা দেশে সোয়া পাঁচ লাখ রেস্তোরাঁ রয়েছে। শহর এলাকায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক এবং বৈচিত্র্যময় খাবারের দোকান আছে। শহুরে মানুষের মধ্যে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার প্রচলন চালু রয়েছে। ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে শহরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরিবার-পরিজন নিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে আগের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে। রেস্তোরাঁয় গ্রাহক কমে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন বলেন, রেস্তোরাঁ ব্যবসা ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এটিকে বাঁচানোর তো কোনো পথ দেখায়নি, উল্টো মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট জুড়ে দেয়া হয়েছে। কার সাথে আলোচনা করে তিনগুণ ভ্যাট কার্যকর করা হলো—সেই প্রশ্ন রাখেন এই ব্যবসায়ী নেতা। 

বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহার না করলে সারাদেশে রেস্তোরাঁ বন্ধের হুমকিও দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। রেস্তোরাঁর মালিক সমিতি ভ্যাট কমানোর আন্দোলনে নামলে তাতে যুক্ত হবে বাংলাদেশ সুইটস ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের সাবেক সভাপতি ও ভাগ্যকুল মিষ্টান্নের কর্ণধার মাধব চন্দ্র ঘোস জানান, ভ্যাট অফিস থেকে এসে এখন পর্যন্ত কেউ কোন নির্দেশনা দেননি। মিষ্টিতে আগের মতো ভ্যাট বহালে এক হবেন ব্যবসায়ীরা।

জনগণ যদি মনে করে করের বোঝা অন্যায্যভাবে তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাহলে তারা বিক্ষোভ বা আন্দোলনে জড়িত হতে পারে। একসঙ্গে বড় ধরনের শুল্ক কর বৃদ্ধির পরিবর্তে, ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান করলে জনগণের উপর চাপ কমানো সম্ভব। শুল্ক কর বৃদ্ধির আগে জনগণের মতামত ও উদ্বেগ শোনা উচিত। সরকারের উচিত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করা, যাতে সামাজিক অস্থিরতা এড়ানো যায়।

লেখক: আনতারা তারান্নুম তাবিতা (৪র্থ বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, আইন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)