বেকার ও বেকারত্বের সমাধান

আনোয়ারা আজাদ
২০ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বেকার ও বেকারত্বের সমাধান

রাস্তাঘাটে চলার সময় একটু চোখ রাখলেই দেখা যায় সতেরো-আঠারো কিংবা তার চেয়ে একটু এদিক-ওদিক বয়সের কিছু তরুণ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে কিংবা চায়ের দোকানে বসে পা দোলাচ্ছে। হাতে মোবাইল তো থাকেই, সিগারেটও থাকে। স্কুলের পাশে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেওয়া তরুণ নয় এরা। কর্মহীন তরুণ। যাদের হাতে তেমন কোনো কাজ নেই। চোখ-মুখ, পোশাক-আশাক দেখেই আন্দাজ করা যায়। পশ এলাকার কথা বলছি না, জনবহুল এলাকার কথা বলছি। আসতে-যেতে দেখি এদের। মায়া লাগে, চিন্তাও লাগে। ইদানীং বেশি বেশি চোখে পড়ছে এদের। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর গার্মেন্ট, ওষুধ ও আরও নানারকম ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার যে খবরাখবর আমরা পেয়েছি বা পাচ্ছি তাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর-তরুণদের সংখ্যা বেশি হওয়ারই কথা। কাজ হারিয়ে পথে এখন। কারখানাগুলোয় আগুন লাগার রহস্য উদ্ধার করার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়ে এখন কীভাবে জীবনযাপন করছে বা করবে সে খবর নেওয়ার চেষ্টা করা জরুরি মনে করছি। কর্মহীন মানুষগুলোর কর্মের ব্যবস্থা না হলে নানারকম অরাজকতার সৃষ্টি হবে বলাই যায়। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের বেশি বেশি উৎপাত এই ইশারাই করে।

প্রতিদিনই পত্রিকায় ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যের কাহিনি পড়তে হয় এখন। আগেও পড়েছি, কিন্তু এখন একটু বেশি মাত্রায়। সঙ্গে নানারকম চাঁদাবাজি তো আছেই। এই সেদিন একজনের মুখে তার ছেলের মোবাইল ছিনতাইয়ের টাইমিং শুনলাম। ছেলেটির বাবা একটি নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ে পাহারাদারের কাজ করেন। ছেলেটি রাতে তার বাবাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এবং রাতে বাবা যেন একটু ঘুমোতে পারে, সেজন্য বাবার কাছে গিয়ে থাকে। ছেলেটি একটি লন্ড্রিতে কাজ করে। তো, সেদিনও ছেলেটি বাবাকে ঘুমোতে বলে সিঁড়িতে বসে মোবাইল দেখছিল। রাত তখন দুটোর মতো। হঠাৎ তার সামনে একটি মেয়ে হাজির হয়ে গল্প করার চেষ্টা করে। খুব অবাক হয়ে ‘এত রাতে মেয়েটি কেন এখানে’ জিজ্ঞেস করার পর পরই ছেলেটি আর কিছু বলতে পারে না। যখন হুঁশ আসে, দেখে তার মোবাইল, সামান্য কয়টা টাকা সব গায়েব। হুঁশ হারানোর আগে আরও দুজনকে মেয়েটির পাশে আসতে দেখেছিল বলে জানিয়েছে ছেলেটি। আগে ছিঁচকে চোর আর বড় মাপের চোরের কথা শুনতাম। এখন ছিঁচকে ছিনতাইকারীর আগমন!

খবরে প্রকাশ, দেশে এখন বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজার। ২০২৩ সালের এই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। তার মানে এক বছরের ব্যবধানে ১ লাখ ৭০ হাজার বেড়েছে। সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ পায়নি যারা তাদেরই ‘বেকার’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এই সংজ্ঞাতেই সম্ভবত এই পরিসংখ্যান। সেই হিসাবে গৃহকর্মে নিয়োজিত নারীরাও বেকারের সংজ্ঞায় পড়ে। কারণ সারাদিন বিনা মজুরিতেই তারা গৃহকর্মে নিয়োজিত থাকে! তবে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান নারীদের গোনায় রাখে না। গৃহকর্মে নিয়োজিত নারীদের বাদ দিয়েই ২৬ লাখ ৬০ হাজারের বেকারের হিসাবই থাকে! আর তাই তো নারীরা এখন গৃহকর্মের পাশাপাশি বাইরের কাজেও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। শিক্ষিত হোক কিংবা আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই এমন নারীরাও। নারীরাও ধীরে ধীরে বুঝে গেছে অর্থনৈতিক মুক্তিই হলো মানুষের প্রকৃত মুক্তি। এর বাইরে কোনো কথা থাকতে পারে না, যে যতই যুক্তি দেখাক। একজন মানুষ সে নারী হোক কিংবা পুরুষ, নিজের উপার্জন না থাকলে, হাতে নিজের টাকা না থাকলে তার কোনো মূল্য এই সমাজ দেয় না। পরিবারেও সে অবহেলিত থাকে। এমনকি সন্তানের কাছেও।

প্রতিটি দেশেই বেকারত্বের একটি পরিসংখ্যান থাকে। কম আর বেশি। তথ্যসূত্রে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ৪.১০%। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বেকার আর বাংলাদেশের বেকারের জীবনযাপন এক নয়। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর সামাজিক কাঠামো নির্ভর করে। জীবনযাপন নির্ভর করে। বাংলাদেশের জনশুমারি তথ্য বলছে, দেশে জনসংখ্যার ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশই তরুণ। এর মধ্যে মোট বেকারের ১২ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছরে ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করে। আবার যাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাদের হার ১.০৭ শতাংশ। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, যাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তারা কোনো না কোনো উপায়ে উপার্জনের পথ বের করে নেন। আর শিক্ষিতরা চাকরির ওপর ভরসা করে বেকারের খাতায় নাম লেখায়।

জনসংখ্যার চাপে বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধান খুব সহজ নয়। প্রবাসে প্রচুর বাংলাদেশি তরুণ শ্রমিকের কাজ করে। রেমিট্যান্স পাঠায়। এই রেমিট্যান্সের টাকায় অনেকের পরিবার বেঁচে গেলেও মূল সমস্যার সমাধান হয় না। কারণ জনসংখ্যার বৃদ্ধি।

যাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাদের হার ১.০৭ হওয়ার কারণ তারা বেকার থাকেন না, রাস্তায় বাদাম বিক্রি করে হলেও সপ্তাহে কিছু উপার্জন করেন। অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকেও রাস্তার ধারে পিঠা বিক্রি করে উপার্জন করতে দেখি। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিত কিংবা কম শিক্ষিতদের প্রধান সমস্যা ইগো। এই ইগো ঠেলে যে কোনো কর্মক্ষেত্রে ঢুকে যাওয়া সহজ কাজ নয়! তাই ইগো তৈরি হয়ে যাওয়ার আগে স্কিল্ড হতে হবে। অবশ্য চিন্তাভাবনা হালকা করে হলেও বদলাচ্ছে। অনেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে ঝুঁকছে। সম্ভবত এটি খুবই কার্যকরী একটি সমাধান। ডিজিটাল এই যুগে একটি মোবাইল ফোন যা প্রায় সবার কাছেই এখন থাকে, একটি ল্যাপটপ আর সামান্য কিছু টাকা দিয়েই অনেকে মাঠে নেমেছে। হ্যাঁ, অনলাইন ব্যবসার কথা বলছি। অনেকে তো শুনেছি মাত্র পাঁচ হাজার টাকা হাতে নিয়েই ব্যবসায় নেমেছে। মোবাইল ফোন হাতে নিলেই এখন নানারকম বেচাবিক্রির বিজ্ঞাপন সামনে চলে আসে। সামান্য বিরক্তবোধ করলেও মানুষ কিছু করে খাচ্ছে, বেকার হয়ে থাকছে না ভেবে সহ্য করে নিই। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি নতুন নতুন আইডিয়া। সেদিন দেখলাম বিট রুটের গুড়া বিক্রির বিজ্ঞাপন। একেবারেই নতুন মনে হয়েছে। বিট খুবই উপকারী একটি সবজি জেনেও আমাদের খাওয়া হয় না। তাছাড়া সব সময় পাওয়াও যায় না। অথচ ওই বিজ্ঞাপন দেখে আপনি খুব সহজেই কিনে সংরক্ষণ করতে পারবেন। এ রকম আরও অনেক কিছুরই বেচাবিক্রি দেখি। আসলে ব্যবসা মানেই হলো নতুন আইডিয়ার আবির্ভাব। পুরো পৃথিবীই এখন একটি বাজার। কোনো দেশ কোথায় তার প্রডাক্ট বেচবে তাই নিয়ে চলে রাজনীতি। এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্কও চলে এই বেচাবিক্রির ওপর। বহু মানুষ এখন অনলাইনে কেনাকাটা করে। সময়ের অভাবে। অনলাইনেই এখন জমজমাট ব্যবসা। তা ছাড়া এত এত প্রডাক্টও তো আগে ছিল না। এখন হচ্ছে। সংসারের টুকিটাকি নানারকম জিনিস অর্ডার করলেই হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছি। তাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ বেকার না থেকে কিংবা চাকরির জন্য হয়রান না হয়ে উদ্যোক্তা হয়ে যাওয়া। শুধু চারপাশে নজর রাখতে হবে। বাজার সার্ভে করতে হবে। মানুষের চাহিদা বা প্রয়োজন বুঝতে হবে। যে পণ্য বাজারে আনার কথা আগে কেউ ভাবেনি সেই পণ্য বাজারজাত করার ভাবনা মাথায় নিয়ে আসতে হবে। মানুষ তার প্রয়োজন অনুযায়ী জিনিসপত্র ক্রয় করে এখন। বাংলাদেশ এখন আর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো।

বেকারত্বের সমস্যা থাকবেই। সব দেশেই আছে। এর পরও মানুষকে চেষ্টা করে যেতে হয়। আসলে ইচ্ছাই সব। ইচ্ছা এবং মনোবল এই দুটোর সংযোগ না হলে কোনো কিছুই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ইচ্ছেটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কনসেনট্রেট করতে হবে। সবার আগে নিজেকে জানতে ও চিনতে শেখা এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখা জরুরি। অনেকেই সহজে হাল ছেড়ে দেয়। হাল ছেড়ে দিলে কোনো কাজেই সাফল্য আসে না।

তাই আপনি বেকার থাকবেন নাকি থাকবেন না, এটা নির্ভর করবে আপনার ওপর। আপনি উদ্যোক্তা হবেন নাকি চাকরির আশায় বসে থেকে দেশের পিণ্ডি চটকাবেন, সব নির্ভর করবে আপনার ওপর। চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে নতুন আইডিয়া সামনে আনুন। সাফল্য আপনার দুয়ারে আসবেই।


আনোয়ারা আজাদ : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক