হৃদয়ে জনতার জিয়া

গয়েশ্বরচন্দ্র রায়
১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
হৃদয়ে জনতার জিয়া

জিয়াউর রহমান। ডাকনাম কমল। ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার বাগবাড়িতে তার জন্ম। পিতা মুনসুর রহমান ও মাতা জাহানারা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান জিয়াউর রহমান। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তিনি শহীদ হন।

তার কর্মময় জীবন ছিল সফলতায় ভারপুর। স্বীকৃতিস্বরূপ বীর-উত্তম, স্বাধীনতা পুরস্কার, হিলাল-ই-জুরাত, অর্ডার অব দ্য নাইল, সার্ক পুরস্কার, অর্ডার অব দ্য যুগোস্লাভ স্টার, হিরো অব দ্য রিপাবলিক ইত্যাদি পদকে তিনি ভূষিত হয়েছেন।

স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সাহসী সৈনিক। তার মেধা, শ্রম, সাহস এবং সততা তাকে সফল মানুষে পরিণত করেছে। একাধারে তিনি একজন রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, অর্থনীতিবিদ হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তাও। নানা গুণের অধিকারী এই মানুষটি সর্বোপরি একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। যখনই দেশ ও জাতির সংকট দেখা দিয়েছে সৃষ্টিকর্তা তাকেই ত্রাণকর্তা হিসেবে জাতির সামনে হাজির করেছেন। নিজেকে একজন শ্রমিক পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি। স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকা এই মানুষটির শেষ কথাই ছিল দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ। এটিই ছিল তার মূল রাজনীতি। রাষ্ট্রপতি হলেও জিয়াউর রহমান সাধারণ জীবন যাপন করতেন, তার সততা নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি।

জিয়াউর রহমান শৈশব ও কৈশোরে কমল নামে পরিচিত ছিলেন। শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে কেটেছে তার। এরপর রসায়নবিদ বাবা মুনসুর রহমানের কর্মক্ষেত্র কলকাতার হেয়ার স্কুলে পড়াশোনা করেন জিয়াউর রহমান। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলে পিতার কর্মস্থলের সুবাদে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি নগরীতে চলে যান তিনি। কলকাতার হেয়ার স্কুল ছেড়ে করাচির একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন। তিনি ১৯৫২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন শেষ করেন। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি কমিশন লাভ করেন। বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুÑ এই তিন ভাষায়ই পারদর্শী ছিলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৬০ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন জিয়াউর রহমান। তার স্ত্রী গণতন্ত্রের মাতা বেগম খালেদা জিয়া, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক বিরোধীদলীয় নেতাও।

জিয়াউর রহমান ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে একটি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে।

১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদবিতে জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মারণাস্ত্র নিয়ে হঠাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নিহত হয় হাজার হাজার মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং পাক হানাদারদের অতর্কিত আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ।

এই রাতেই চট্টগ্রামের ষোলোশহরে সেনাবাহিনীর অষ্টম ব্যাটালিয়নের বাংলাভাষী অফিসার ও জওয়ান নিয়ে বিদ্রোহ করেন জিয়াউর রহমান। ২৬ মার্চ তিনি চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে দিশাহারা গোটা জাতি। ‘আমি মেজর জিয়া বলছি...বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’Ñ তার এই অবিস্মরণীয় অবিনাশী ঘোষণায় আমাদের মতো পথহারা মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে মরণপণ মুক্তিযুদ্ধে।

জিয়াউর রহমান শুধু মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি। স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং দুই শিশুপুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর কথা না ভেবে দেশকে স্বাধীন করতে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় জিয়া চৌকস জেড ফোর্স গঠন ও পরিচালনা করেন। স্ত্রী খালেদা জিয়া ও দুই শিশুসন্তান রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী থেকে গ্রেপ্তার হলেও জিয়াউর রহমানকে থামানো যায়নি। বীরত্বের সঙ্গে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর আবার ফিরে যান ক্যান্টনমেন্টে। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর-উত্তম খেতাবে ভূষিত করে।

কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৈষম্যের শিকার হন জিয়াউর রহমান। সেনাবাহিনীতে জিয়াউর রহমান সিনিয়র হলেও তাকে ডিঙিয়ে কে এম সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করা হয়েছিল। এখান থেকেই কিছুটা বুঝতে পারা যায় শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার কেমন ছিল। ’৭২-৭৫ সাল আওয়ামী লীগের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছুই ছিল না। ব্যাংক ডাকাতি, নারী নির্যাতনসহ হেন কোনো অপরাধ নেই- যা ওই সময় হয়নি। এই সময়ে জাসদের ২০ হাজারের বেশি কর্মীকে হত্যা করা হয়। শেখ মুজিব সরকারের ভয়াবহ রকম দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির কারণে ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে বিপুলসংখ্যক মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। এ অবস্থায় শেখ মুজিব সরকারের পক্ষে দেশ পরিচালনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। শেষ রক্ষা হিসেবে সব রাজনৈতিক দল বেআইনি ঘোষণা করে বাকশাল গঠন করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির পর দৃশ্যত দেশে আর কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। বাকশাল গঠনের মাত্র কয়েক মাসের মাথায় ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে হত্যার শিকার হন।

এরপর আওয়ামী লীগের নেতা ও শেখ মুজিব সরকারের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। এ বছরের ২০ আগস্ট খন্দকার মোশতাক সামরিক আইন জারি করলেন এবং নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন। সেনাবাহিনী-জাতির ভাগ্যোন্নয়নে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। সেনাবাহিনীতে ক্যু-পাল্টা ক্যু- পুরো জাতি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সৈনিক ও জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আবার জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন।

জিয়াউর রহমানের সাহস এবং সেনাবাহিনীতে তার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান তার লেখা ‘কিছু স্মৃতি কিছু কথা’ বইয়ে জিয়া ও সাত নভেম্বর শিরোনামে উল্লেখ করেছেন। ৭৩ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেছেন, “আমার মনে পড়ে ঢাকা সেনানিবাসে তিনি (জিয়াউর রহমান) এ সময় দরবারে এসেছিলেন। মাঠে অস্ত্র উঁচিয়ে উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকের ভিড়। চতুর্দিকে মহুর্মুহু স্লোগান ‘জিয়া ভাই, জিয়া ভাই’। ঢাকা সেনানিবাসের আকাশ-বাতাস মুখরিত। পতাকাবাহী গাড়ি রাস্তায় রেখে তিনি হেঁটে সৈনিকদের ঠিক মাঝখানে চলে আসেন। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলতে শুরু করেন, ‘Shut-up. I am not your Zia bhai. I am bloodz well your chief. Behave properly, তোমরা সকলে চুপ করো। আমি তোমাদের ভাই নই। আমি তোমাদের সেনাপ্রধান। সাবধানে কথা বলো। সেনাশৃঙ্খলা ভঙ্গ আমি কখনো সহ্য করব না।’ তিনি সবাইকে ব্যারাকে যাওয়ার আদেশ দেন। অস্ত্র জমা দিতে বলেন এবং চেইন অব কমান্ডে ফিরে আসতে বলেন। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, মুহূর্তের মধ্যে সব কোলাহল স্তব্ধ, সৈনিকরা লাইন ধরে সুড়সুড় করে আপন আপন ইউনিটের কাছে ধাবমান। আমার কাছে জিয়াকে সেদিন মনে হয়েছিল তিনি যেন সেই হ্যামিলনের বংশীবাদক, যার বাঁশির সুরে হ্যামিলন নগরীর সব শিশু-কিশোর যেখানে ছিল তার পেছনে পেছনে ছুটে চলছে।” আসলেই জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি মানুষের কাছে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাই ছিলেন।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে জিয়াউর রহমানকে সৈনিক-জনতা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসায়। শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পদত্যাগ করেন। ফলে ৪২ বছর বয়সে জিয়াউর রহমান সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। বছরখানেক পর হ্যাঁ-না ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি। বাংলাদেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। এর আগে বাংলাদেশে কেউ বৈধ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হননি। এমনকি শেখ মুজিবও নন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে সংসদে প্রবেশ করেন, এর কিছুক্ষণ পরেই রাষ্ট্রপতি হয়ে বের হয়েছিলেন। এরপর জিয়াউর রহমান একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেন। নিবন্ধনের মাধ্যমে সবাইকে রাজনীতির সুযোগ দিলেন।

দীর্ঘ সংলাপ, অভিন্ন ধারার রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক জাতীয় ঐক্য সূচিত হয়। এভাবেই গড়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল)। বিচারপতি আবদুস সাত্তার ছিলেন এ দলের প্রধান। পরে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠিত হয়, যার প্রধান ছিলেন জিয়াউর রহমান। ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম।

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জাগদল বিলুপ্ত করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের জন্য ওই দিনে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এই দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমান। উন্মুক্ত আকাশের নিচে রমনার বটমূলের সামনে একটি ছোট টেবিল আর গোটা সাতেক চেয়ার ছিল, সামনে কিছু সাংবাদিক। এই সংবাদ সম্মেলন সফল করতে বরকতউল্লা বুলু (বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান) ও আমি (গয়েশ্বর চন্দ্র রায়) দায়িত্ব পালন করেছিলাম। ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচন জাতীয় ঐক্যের এক বিরল প্রদর্শন। এই নির্বাচনে সমাবেশ ঘটল ডান, বাম, মধ্যপন্থীÑ সব মানুষের, যা দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। এই নির্বাচনে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনকারী এবং আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জনক জিয়াউর রহমান তার কর্ম দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে জনগণের মনের গভীরে প্রবেশ করেন। তার উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি খাল কাটা কর্মসূচি, কৃষি, শিক্ষা, শিল্পবিপ্লবসহ যে কোনো পদক্ষেপেই দেশের মানুষ তার পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশের বেকার জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করেন; মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানো শুরু করেন তিনি। খাল কাটা কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষিবিপ্লব শুরু হয়।

জিয়াউর রহমান মহিলা পুলিশ গঠন, সেনাবাহিনীতে যোদ্ধা হিসেবে মেয়েদের নিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। পুলিশ বাহিনীর সদস্য দ্বিগুণ এবং অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন। সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব বাড়ান, উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৯০ হাজার করেন। রক্ষী বাহিনীর ১৬ ব্যাটালিয়নকে দিয়ে সেনাবাহিনীতে পঞ্চম ডিভিশন তৈরি করেন। চীনের অনুদানে আর্টিলারির জন্য অস্ত্র, সিগন্যাল সেট থেকে শুরু করে বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে আসেন। দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেন। দেশে অস্ত্র উৎপাদন শুরু করার ব্যবস্থা নেন। গাজীপুর অস্ত্র কারখানায় সামরিক ভেহিক্যাল সংযোজন ও চট্টগ্রাম ডকইয়ার্ডে ভবিষ্যৎ জাহাজ নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে যুদ্ধজাহাজ সার্ভিস ফ্যাসিলিটি উন্নত করেন। মিরপুর ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে কৌশলগত শিক্ষা গ্রহণকারীদের অন্তত একজন ফিল্ড মার্শাল খেতাব অর্জন করেন। বর্তমান গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইকে আধুনিক প্রশিক্ষণ এবং এর পেশাদারিত্ব উন্নত করে অধিক কার্যকর করে গড়ে তোলেন। সৈনিকদের আবাসন, বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি করেন। সামরিক বাহিনীতে পুরনো খাকি পোশাক বদলে ক্যামোফ্লাজ পোশাক প্রবর্তন করেন। ব্রিটেন থেকে নৌবাহিনীর জন্য দুটি ফ্রিগেট ক্রয় করেন, এ ছাড়া কিছু প্যাট্রল বোট ক্রয় করেন। কাপ্তাইয়ে নেভাল ইউনিট গঠন করেন। তিনি বিমানবাহিনীর জন্য এফ-৬ এবং এফটি-৬ বিমান ক্রয় করেন।

এ ছাড়াও জিয়াউর রহমান বিডিআরকে (বর্তমান বিজিবি) সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আধুনিক করে গড়ে তোলেন। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র অল্প কয়েক বছরেই অপর্যাপ্ত সম্পদ, বিদেশি ষড়যন্ত্র, স্বদেশি স্বার্থান্বেষী বিদ্রোহী গোষ্ঠী, বিশৃঙ্খল দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা, পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অস্থিতিশীলতা, রোহিঙ্গা ইস্যু, ভারতীয়দের সীমান্ত অত্যাচারÑ এসব পেরিয়ে তিনি যা করেছেন ওই পরিস্থিতিতে, পৃথিবীতে খুব কম রাষ্ট্রনায়কই অতখানি দৃঢ়তা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।

জিয়াউর রহমান পল্লী উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন, গার্মেন্টসকে শিল্প হিসেবে পরিণত করেন। এর মাধ্যমে লাখ লাখ নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, বন্ধ কলকারখানা চালু এবং নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তুলে উন্নয়নের সূচনা করেন। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়েছেন। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ও ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদক প্রবর্তন করেন। বিএনপি যে সব ধর্মের মানুষের দল সেটা তিনি প্রমাণও করেছেন। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশ যখন উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির শিখরের দিকে যাচ্ছিল, তখনই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র শুরু হয় তার বিরুদ্ধে। জিয়ার ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা ও দেশপ্রেমই তার জন্য কাল হয়েছিল। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা চট্টগ্রামে তাকে হত্যা করলেও তার আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি।

১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানের শাহাদাতে গোটা পৃথিবী শোকাভিভূত হয়ে পড়েছিল। এই শোকের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল শেরেবাংলানগরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাজায়। লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে সেদিন জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। জিয়াউর রহমান যেখানে শেষ করেছেন, সেখান থেকে শুরু করেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তার রেখে যাওয়া বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পতাকা বহন করে বিএনপিকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তিনবার ক্ষমতায় নিয়ে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করেছেন। এখন দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের বড় সন্তান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার মাঝে জিয়াউর রহমানের প্রতিচ্ছবি স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পতাকা বহন করে এগিয়ে যাচ্ছেন তারেক রহমান। তার কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। তাকে ঘিরে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলমান, তবে তারেক রহমানকে সফল করতে আমরা আজ ঐক্যবদ্ধ। ’৭১-এ জিয়াউর রহমান, ’৯০-এ বেগম খালেদা জিয়ার মতো ২০২৪-এ তারেক রহমান নিজ কর্ম দিয়ে জনতার নায়ক হিসেবে তাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।

গয়েশ্বরচন্দ্র রায় : সাবেক মন্ত্রী ও সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি