ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিরোধে কয়েকটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

এ টি এম মোস্তফা কামাল
১৮ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিরোধে কয়েকটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

ফ্যাসিস্ট সরকারের উত্থানের পেছনে বেশ কিছু উপাদান সহায়ক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে থাকে। সেসব উপাদান চিহ্নিত করতে হবে। চিহ্নিত করে সেসব উপাদান যাতে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় প্রভাবশালী ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

১। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে প্রজাতন্ত্রের কর্ম বিভাজন করে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা যেতে পারে। সংসদ নির্বাচন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে পারে। কোনো দলীয় প্রতীকে কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যে কোনো যোগ্য ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতির হাতে জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা, ভূমি, নৌপরিবহন, প্রতিরক্ষা, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং আইন ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে।

২। রাষ্ট্রের সামগ্রিক প্রশাসনযন্ত্রকে ক্ষমতাসীন দলের দলীয়করণের রাহুগ্রাস থেকে শতভাগ মুক্ত করতে হবে। ১৯৯১ সাল থেকে প্রশাসনের দলীয়করণ শুরু হয়। প্রথম টার্মে দলীয়করণ যদি হয় ১০%, পরের টার্মে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ২০%, তার পরের টার্মে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০% এবং ৪র্থ টার্মে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ১০০%। ফ্যাসিজম ও স্বৈরতন্ত্র উত্থানে সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আমরা যদি মনে করি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার হোক ফ্যাসিবাদমুক্ত ও স্বৈরাচারমুক্ত, তাহলে এমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে যাতে নির্বাচিত দলীয় সরকার কোনোক্রমেই প্রশাসনযন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। প্রশাসনযন্ত্রকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ক্ষমতাসীন দলের দলীয় তহবিল থেকে বহন করা হয় না। রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে যাদের বেতন ভাতা বহন করা হয়ে থাকে, তাদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের দলীয় প্রভাব বিস্তার করার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। পরবর্তী নির্বাচনে যেসব দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তাদের সবার কাছ থেকে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে যে, ক্ষমতাসীন হয়ে তারা সরকারি প্রশাসনযন্ত্র কোনোরূপ দলীয়করণ করবে না। সাধারণ জনগণের কাছে সেটা যেন বিশ্বাসযোগ্য হয় সেরূপ ব্যবস্থা তাদের করতে হবে। তাদের চলমান আচরণে সেটার প্রতিফলন থাকতে হবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষের মধ্যে যে অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে, সেটা দূর করা কঠিন হবে।

৩। প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা স্বৈরতন্ত্রের উত্থানে এবং ফ্যাসিজম কায়েমে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। ফ্যাসিজম প্রতিরোধে তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা রুখতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব? জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র আধিপত্য রুখতে হবে। সে জন্য নমিনেশন বাণিজ্যের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের সদস্য পদ ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিক্রি করে দেওয়ার যে রীতি আমাদের দেশে চালু হয়েছে, সেটা বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সেটা বন্ধ করতে না পারে তাহলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সঙ্গে তুলনা করে জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রাপ্য কোটা নির্ধারণ করে দিতে হবে। ধরুন, সেই কোটা যদি হয় ৩-৫% তাহলে ব্যবসায়ীদের জাতীয় সংসদে সেই কোটা অতিক্রম করতে দেওয়া যাবে না। সেটার আইনি ভিত্তি প্রদান করাও আবশ্যক। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে Large Tax Payer & Big NGO-দের যে আয়কর অব্যাহতি দেওয়া হয়ে আসছে সেটা বন্ধ করতে হবে। এটিকে ক্ষমতাসীন সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী-রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা প্রজাতন্ত্রের যেসব সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করেছে, সেসব সম্পত্তি উদ্ধার করে রাষ্ট্রীয় দখলে নিতে হবে। বড় ব্যবসায়ীরা ঋণের নামে ব্যাংক থেকে যে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, তাদের সব সহায়-সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা ব্যাংকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

৪। সংসদ সদস্যদের একমাত্র অধিক্ষেত্র হচ্ছে সংসদ ভবন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তা-ই ছিল। সংসদ ভবনের বাইরে নিজ সংসদীয় এলাকাসহ কোনো ক্ষেত্রে তারা প্রভাব খাটাতে পারবেন না। এলাকার উন্নয়ন কার্যক্রম দেখার দায়িত্ব উপজেলা পরিষদের। তাদের নামে উন্নয়ন কিংবা স্বেচ্ছাধীন তহবিল নামে কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যাবে না। ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য যেসব ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের দেওয়া হয়েছে, সেসব প্রত্যাহার করে নিতে হবে। কারণ তারা সেসব ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি করেছেন এবং স্থানীয় রাজনীতিতে মাফিয়া ডন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

৫। সংসদীয় আসনের সর্বমোট ভোটের ৫০%-এর বেশী ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হওয়ার রেওয়াজ চালু করতে হবে। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করার জন্য রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

৬। থাইল্যান্ডের আদলে একটি Constitutional Court-এর বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, দলীয়করণ, ভারতকে একতরফা সুবিধা দিয়ে কোনো চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে অন্য কোনো সংসদ সদস্যকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে।

৭। দেশে সুশাসন কায়েম এবং দেশের সব পর্যায়ে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ব্যবসা নির্মূল করার রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি ঘোষণা করতে হবে।

৮। ভারতকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে দেওয়া যাবে না। ভারতের কাছ থেকে তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার আগে দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো সুযোগ নেই। দু’দেশের সীমান্ত বিরোধ সর্বাগ্রে নিষ্পত্তি করতে হবে। ভারতকে একতরফা সুবিধা দিয়ে কোনো চুক্তি করা যাবে না। ভারতের সঙ্গে করা যে কোনো চুক্তি সংসদের তিন-চতুর্থাংশ ভোটে পাস হওয়ার পর কার্যকর হবেÑ এরূপ বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার আবশ্যকতা রয়েছে।

৯। রাষ্ট্রের Planning Discipline সঠিক রাখার স্বার্থে Economic Cadre-কে স্বীয় অবস্থানে পুনর্বহাল করা অত্যাবশ্যক। অনুমোদিত পদের চেয়ে বেশি পদে পদোন্নতি প্রদান করা যাবে না। গাড়ি ভাতা প্রদান বন্ধ করে দিতে হবে। ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রজেক্ট সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। বিদেশি অর্থায়নে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ এবং গাড়ি ক্রয়ের বাধ্যবাধকতা পরিহার করতে হবে। সার্বভৌম গ্যারান্টি দিয়ে নেওয়া ঋণের অর্থ অনুন্নয়ন এবং বিলাসী কাজে ব্যয় করা যাবে না।

১০। দেশ থেকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও ফ্যাসিজম নির্মূলে উপর্যুক্ত সংস্কারমূলক কার্যক্রমই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। এর বাইরে অদূরদর্শী সংস্কার কার্যক্রমের উদ্যোগ ফ্যাসিজম পুনর্বহালে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমনÑ ৫০৫ আসনের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদের সুপারিশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর চাপ বাড়বে। বর্তমান জাতীয় সংসদে স্থানসংকুলান না হলে কীরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তার ব্যাখ্যা থাকা আবশ্যক। অতিরিক্ত আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। যে ক্ষেত্রে ৩০০ আসনেই উপযুক্ত লোক পাওয়া যাচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে ৫০৫ আসনে কীভাবে সেটা পাওয়া যাবে? অতিরিক্ত আসন বাড়ার যৌক্তিকতা কী? নমিনেশন বাণিজ্যের সুযোগ বৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে স্বৈরাচার পুনরুত্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ৩০০ সংসদ সদস্যের শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতনে সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ আর ৫০৫ আসনের সদস্যদের শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতনে বাংলার সাধারণ মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যেতে পারে।


এ টি এম মোস্তফা কামাল : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব, অর্থনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক