চব্বিশ ব্যর্থ হলে নতুন বিপ্লব ও রাজনৈতিক মেরুকরণ!
প্রতিটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত বা ঘটনা আসে সংশোধন, পরিবর্তন, সংস্কার ও করণীয় নির্ধারণ করে নতুনভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। সমাজ-সময় অনিবার্যভাবেই বিবর্তনশীল। আর তা মানুষের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করেই ক্রিয়াশীল। কিন্তু আকাক্সক্ষা ও সময়কে ধারণ করে এগোতে না পারলে বিপত্তিটা বড় বিপদ বা মুক্তির লড়াই হিসেবে জনপদের মানুষের সামনে হাজির হয়। আমরা অল্প সময়ে এমন অনেক উদাহরণের সম্মুখীন হয়েছি। সাতচল্লিশ আমাদের দাবি মেটাতে না পারায় একাত্তরকে নিজেদের মুক্তির জন্য বেছে নিয়েছি। দেখুন একাত্তর খুব দ্রুত আমাদের পঁচাত্তরে নিয়ে পৌঁছাল। তারপর নব্বই হয়ে একবিংশ শতাব্দীর চব্বিশের রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থান জ্বলন্ত উদাহরণ। এই গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিট বা চেতনা অথবা আকাক্সক্ষা ধারণ করে এগোতে না পারলে আমাদের গতিপথ আবারও থমকে যাবে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে নতুন কোনো সংগ্রাম বা গণবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার আলামত এখনই আঁচ করা যাচ্ছে, যা বিদ্যমান গোটা সমাজব্যবস্থাকেই পাল্টে দেবে।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী এর অংশীজনদের মধ্যে নানা ভিন্নতা ও বিভাজন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর মানে গণ-অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট বেহাত হওয়া। আর তা সত্যি হলে অদূর ভবিষ্যতে আরও বড়সড় গণবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা অমূলক নয়। ধারণা করছি, সম্মিলিত একটি পক্ষশক্তির সুনির্দিষ্ট স্পিরিটের ভিত্তিতেই সেই বিপ্লব সংঘটিত হবে। আর এই বিপ্লবের প্রধান স্টেকহোল্ডার কারা হবেন, তা-ও অনুমান করছি। অনাগত বিপ্লবের স্টেকহোল্ডারদের স্পিরিট নিয়ে আজকের মতো দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ থাকবে না। ঐক্য, আদর্শ ও পারস্পরিক বোঝাপড়া নিশ্চিত হওয়ার পরই সেই বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর বিপ্লব মানেই যে রক্তক্ষয়ী তা ঠিক নয়। অনাগত বিপ্লব কখন, কোন আবরণে হবে, তা সময়ই নির্ধারণ করবে। তবে চব্বিশের রক্তাক্ত বিপ্লবের আকাক্সক্ষা ধারণ ও বাস্তবায়ন ব্যর্থ হলে তা অবধারিতভাবেই সংঘটিত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। রাজনীতিতে সেই মেরুকরণও লক্ষ করা যাচ্ছে।
প্রশ্ন আসতে পারে, চব্বিশের গণবিপ্লবের স্পিরিট আসলে কী? আর আমরা কীভাবে তা ধারণ বা বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে পারি অথবা বাধা কোথায়? উত্তরে বলতে পারি, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এবং রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনে জন-আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে। এই জনআকাক্সক্ষার মৌলিক বিষয় হলো প্রান্তিক থেকে সর্বত্র ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধ, দখল, চাঁদাবাজি ও তদবির বাণিজ্য বিষয়ে শূন্য সহনশীলতা (জিরো টলারেন্স), আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর, বৈষম্য দূরীকরণ, সর্বস্তরে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশসাধন, রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কার, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপে নতুন আইনি কাঠামো তৈরি, ফ্যাসিস্ট ও দোসর রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধি এবং তাদের বিচার দাবিসহ রাজনৈতিক ও জাতীয় ঐক্যের অগ্রাধিকার অন্যতম।
অনস্বীকার্য যে, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে, যা পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারপ্রধানের বর্ণবাদী আচরণ-ট্যাগ (যাকে-তাকে রাজাকার গালি দেওয়া) এবং সরকারের অতিমাত্রায় দলন-পীড়নে আন্দোলন খুব দ্রুতই গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়, যা বিগত সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করে। ফলে দেড় দশকের ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী সরকারপ্রধানসহ তার ক্যাবিনেটের সব সদস্য এবং পার্লামেন্ট মেম্বার ও সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সবাইকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। এই আন্দোলন সফল হওয়ার পরই দাবি ওঠে বিদ্যমান রাজনৈতিক কালচারের পরিবর্তে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বলা যায়, যদিও আন্দোলনের শুরু থেকে বা আন্দোলনের সময় কোটা সংস্কার ছাড়া অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট আকাক্সক্ষা ঘোষণা করা হয়নি। তবে সরকার পতনের এক দফা দাবি ঘোষণার দিনই ৩ আগস্ট বিপ্লব ঘোষণার একটি রূপরেখা লিখিত আকারে আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড এমন একজনের কাছ থেকে ছাত্র নেতৃত্বের হাতে পৌঁছেছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ছাত্র নেতৃত্ব তখন তা ঘোষণা করেনি। একইভাবে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন ও পলায়ন করলে আবারও বিপ্লব ঘোষণার বিষয়টি সামনে আসে। কিন্তু এদিনও ছাত্র নেতৃত্ব সেই ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ ৮ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার দিনও বিপ্লব ঘোষণা করে বিপ্লবী সরকার গঠনের সুযোগ ছিল। সেদিনও আন্দোলনের ফ্রন্টলাইনার ছাত্র নেতৃত্ব সেই সুযোগ হাতছাড়া করে। শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পাঁচ মাসের মাথায় ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ছাত্র নেতৃত্ব প্রোক্লেমেশন অব রেভুলেশন ঘোষণার দিন নির্ধারণ করে। কিন্তু এক দিন আগে হঠাৎ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সরকারই বিপ্লব ঘোষণা করবে। ছাত্র নেতৃত্বসহ সব রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে বিপ্লব ঘোষণার রূপরেখা নির্ধারণ করে তা ঘোষণা করা হবে। ফলে ছাত্র নেতৃত্ব সরকারের ঘোষণায় আশ্বস্ত হয়ে বিপ্লব ঘোষণা থেকে নিজেদের বিরত রাখে। অথচ বেশ সময় পার হলেও এখন এ নিয়ে কোনো পক্ষেরই তোড়জোড়ের লক্ষণ নেই।
চব্বিশের আন্দোলনের ভ্যানগার্ড হিসেবে কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেতৃত্বে ছিল না। এই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছাত্র প্রতিনিধিরা। আর আন্দোলনকারীদের মধ্যে ফ্রন্টলাইনার বা প্রধান অংশীজনও ছিলেন শিক্ষার্থীরা। পরে তাদের অভিভাবক ও সাধারণ জনতা এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়। একপর্যায়ে রাজনৈতিক শক্তিগুলো আন্দোলনের গতিপথ দেখে চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শরিক হয়। ফলে এই আন্দোলন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বা গণবিপ্লব হিসেবে সাব্যস্ত হয়। আন্দোলন সফলের পর গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান স্টেকহোল্ডার শিক্ষার্থীদের দাবি ও আকাক্সক্ষার সঙ্গে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মতের অমিল লক্ষ করা যাচ্ছে। শিক্ষার্থী ও তাদের নেতৃত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির ঐক্য তৈরিতে অন্তর্বর্তী সরকার, ছাত্র প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলগুলোÑ সব পক্ষই ব্যর্থ হয়েছে। ফলে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী যে জন-আকাক্সক্ষা বা স্পিরিট সৃষ্টি হয়েছিল তা বেহাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অনস্বীকার্য যে, ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের যে দাবি উঠেছে, বিশেষ করে সংবিধান বাতিল বা সংস্কার এবং বরাবরই ফ্যাসিবাদী চরিত্রের রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা প্রকাশ্যে সামনে এসেছে। নানা মাধ্যমে গুঞ্জন রয়েছে, বিরোধিতা আছে প্রতিবেশী দেশসহ বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রেরও। একই সঙ্গে বিপ্লব ঘোষণা নিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিরও বিরোধিতা বেশ। এর বিরোধিতায় বহিঃশক্তিও কম সক্রিয় নয়। বিপ্লব ঘোষণা যেন না হয় তা নিয়ে চাপে আছে অন্তর্বর্তী সরকারও। এসব নিয়ে রাখঢাক থাকলেও তা স্পষ্ট।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
শুরুতে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত হলে আরেকটি বিপ্লবের আশঙ্কা করেছিলাম। বলেছিলাম তার নজিরও বিদ্যমান।
বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের নেতিবাচক তৎপরতা যত বাড়বে বা চলমান থাকবে, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী ঐক্যকে আরও সুদৃঢ় করবে। একই সঙ্গে ইসলাম ফোবিয়া ও ভারতপ্রীতি এবং ভারতের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের কোনো দল চিহ্নিত হয়ে গেলে ভারতবিরোধী ঐক্যসংশ্লিষ্টরা ওই সব দলের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
চব্বিশের রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে আমরা যদি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনে সঠিক নেতৃত্ব দিতে না পারি, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আরও একটি গণপ্রতিক্রিয়া বা গণবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আর এবার এই গণবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পেছনের মূল শক্তি হিসেবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্য ও উত্থানকে ত্বরান্বিত করবে, যা রাজনীতির নতুন মেরুকরণকে নির্দেশ করে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
জাকির মজুমদার : সাংবাদিক ও সংগঠক