ট্রুডো যুগের অবসান

চিররঞ্জন সরকার
১২ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ট্রুডো যুগের অবসান

জাস্টিন ট্রুডো। এক দশক আগে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন সুদর্শন এই নেতা। ২০১৫ সাল থেকে টানা নয় বছর ধরে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু রাজনীতিতে কখন কার খারাপ সময় আসে, তা তো আর আগেভাগে বোঝা যায় না। তিনিও সম্ভবত বুঝতে পারেননি। দলের ভেতরে ও বাইরে পদত্যাগের জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি হওয়ায় মেয়াদ শেষ না করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে লিবারেল পার্টি নতুন একজন নেতা নির্বাচিত না করা পর্যন্ত তিনি নিজ পদে দায়িত্ব পালন করবেন।

এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাস্টিন ট্রুডোর রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ এক অধ্যায়ের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। পিয়েরে ট্রুডো ছিলেন কানাডার ১৫তম প্রধানমন্ত্রী। তার পুত্র জাস্টিন ট্রুডো হন কানাডার ২৩তম প্রধানমন্ত্রী। শিক্ষকতা দিয়ে তার পেশাগত জীবন শুরু হলেও ২০০৮ সালে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ওই বছর তিনি মন্ট্রিয়লের পাপিনো নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর দ্রুতই তিনি একজন উদারনৈতিক এবং তরুণদের প্রিয় নেতা হয়ে ওঠেন।

২০১৩ সালে এমন এক সময় তিনি লিবারেল পার্টির দায়িত্ব নিয়েছিলেন, যখন দলটি গভীর সংকটে নিমজ্জিত ছিল। সে সময় কানাডার হাউস অব কমন্সে তৃতীয় অবস্থানে নেমে গিয়েছিল লিবারেল পার্টি। ২০১৯ ও ২০২১ সালে লিবারেলদের জয়ের বন্দরে নিয়ে যান। ট্রুডো তার নেতৃত্বে সমতা এবং বৈচিত্র্যের প্রতি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা তার উত্তরাধিকারের একটি বড় অংশ। তার মন্ত্রিসভায় প্রথমবারের মতো লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা হয়, যেখানে পুরুষ এবং নারীর সমান অংশগ্রহণ ছিল। এ ছাড়া তিনি এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের অধিকারের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি দলগত নিয়োগের অবসান এবং একটি স্বাধীন, যোগ্যতাভিত্তিক নির্বাচন প্রক্রিয়া তৈরি করে সিনেট সিস্টেমকে স্বচ্ছ করার চেষ্টা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি নতুন বাণিজ্য চুক্তিও স্বাক্ষর করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম দুই মেয়াদে কানাডার গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে কার্বন কর প্রবর্তন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গাঁজার ব্যবহারকে বৈধতা দেওয়া, নিখোঁজ ও খুন হওয়া আদিবাসী নারীদের বিষয়ে জনসাধারণের তদন্ত কমিটি গঠন এবং চিকিৎসা সহায়তায় আত্মহত্যার অনুমতিসংক্রান্ত আইন পাস করে নজরে আসেন ট্রুডো। তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে কানাডার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। জাতিসংঘ, জি৭ এবং জি২০-এর মতো ফোরামে কানাডার ভূমিকা উজ্জ্বল ও সুদৃঢ় করেন। বিশেষত শরণার্থী গ্রহণে তার নেতৃত্ব এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক প্রগতিশীল নেতৃত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করে।

কিন্তু অনেক ভালো কিছু করেও তিনি দেশের মানুষের মন পাননি। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। তৃতীয় মেয়াদের শেষ দিনগুলোতে তিনি আসলে সবকিছু ঠিকঠাকমতো ম্যানেজ করতে পারছিলেন না। সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে মূলস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। ২০২৪ সালে কানাডায় মুদ্রাস্ফীতি জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং আবাসন ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ট্রুডোর সরকার এই সংকট মোকাবিলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি ফেডারেল বাজেট প্রস্তাব তার নিজ দল এবং বিরোধী পক্ষ উভয়ের কাছ থেকে সমালোচিত হয়। বাজেট প্রস্তাবে একটি বড় অংশের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

পরিবেশ সুরক্ষা নিয়েও ট্রুডোর লিবারেল পার্টি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ ওঠে। ক্রমবর্ধমান জলবায়ু দুর্যোগ পরিস্থিতি তার ‘পরিবেশবান্ধব’ নেতৃত্বের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে। পাশাপাশি প্রদেশগুলোর সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা তহবিল নিয়ে আলোচনা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য ট্রুডোর সরকার সমালোচিত হয়েছে। এই বিষয়টি স্বাস্থ্যসেবা খাতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সঙ্গে তার সরকারের সম্পর্ক দুর্বল করেছে।

বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে জড়িয়ে পড়েছিলেন ট্রুডো। প্রশ্ন উঠছিল তার ভারতবিরোধী মনোভাব নিয়েও। তার সময়ে নয়াদিল্লি-অটোয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরার সূত্রপাত স্বাধীন খালিস্তান আন্দোলনের নেতা নিজ্জরের হত্যাকা- থেকে। খালিস্তানি নেতা নিজ্জরকে ২০২০ সালে ‘সন্ত্রাসবাদী’ ঘোষণা করেছিল ভারত। তিন বছর পর ২০২৩ সালের ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারের একটি গুরুদুয়ারার সামনে তাকে হত্যা করা হয়। নিজ্জর হত্যাকা-ে ভারতের ‘ভূমিকা’ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন ট্রুডো। বস্তুত তার পর থেকেই দুদেশের সম্পর্কে চিড় ধরে।

ট্রুডোর ইস্তফায় ট্রাম্পের ‘হাত’ও দেখছেন অনেকে। দ্বিতীয়বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অঙ্গীভূত করার কথা শোনা গিয়েছে ট্রাম্পের গলায়। কানাডায় রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক নানা সমস্যার কারণে ট্রুডোর জনপ্রিয়তায় এমনিতেই ধস নেমেছিল। এর মধ্যেই ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছিলেন, আগামী ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তিনি কানাডা থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন। কানাডার দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে অবৈধ মাদক এবং অবৈধ অভিবাসী প্রবেশ বন্ধ করতে না পারলে এই শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প।

ট্রাম্পের এই হুমকি ট্রুডোর দলীয় সংহতির ওপর আঘাত হানে। কয়েক সপ্তাহ আগে অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড পদত্যাগ করেন। ফ্রিল্যান্ড প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনের সময় কানাডার প্রধান বাণিজ্য আলোচক ছিলেন। ট্রুডোর অন্যতম বিশ্বস্ত সহযোগীও ছিলেন তিনি। বাজেট এবং সম্ভাব্য মার্কিন শুল্ক নিয়ে মতবিরোধের জের ধরেই তিনি পদত্যাগ করেন। সব মিলিয়ে পুরো পরিস্থিতিই ট্রুডোর প্রতিকূলে চলে যায়।

এদিকে ট্রুডোর পদত্যাগ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, কানাডার জনগণ নিজের দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হিসেবে দেখতে চায়। আর এ বিষয়টি বুঝতে পেরেই পদত্যাগ করেছেন ট্রুডো। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডার একীভূত হয়ে দেশটির ৫১তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হওয়া উচিত বলে জানিয়ে নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে পোস্টও করেছেন ট্রাম্প।

একটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ করে যেভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডার একীভূত হওয়ার প্রস্তাব করেছেন, এর প্রতিক্রিয়ায় কানাডার নেতারা কী বলেন, কী করেন, সেখানকার নাগরিকরাই বা কী প্রতিক্রিয়া দেখান, এখন সেটাই দেখার বিষয়। আগামী দিনের রাজনীতিতে এর প্রভাব দেখা যেতে পারে। তবে ট্রুডো এবং তার দল যে মার্কিন সমর্থন হারিয়েছেন, তা স্পষ্ট।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন আমেরিকার হবু প্রেসিডেন্ট তথা ট্রাম্পের ‘অতি ঘনিষ্ঠ’ ধনকুবের ইলন মাস্ক। ট্রুডো সম্বন্ধে টেসলা কর্ণধার জানিয়েছিলেন, আগামী নির্বাচনেই নতুন প্রধানমন্ত্রী পাচ্ছে কানাডা। ট্রুডো আর ফিরবেন না। নিজের মালিকানাধীন এক্স হ্যান্ডলে এ কথা লিখেছিলেন তিনি। সেই ভবিষ্যদ্বাণীও সত্যি হলো!

এ বছর কানাডায় সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। নির্বাচনকে সামনে রেখে পরিচালিত জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে, কয়েক বছর আগেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা ট্রুডো ক্রমেই ভোটারদের আস্থা হারাচ্ছেন। এর অর্থ হলো এবারও যদি তিনি লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে থাকেন, তা হলে দলটি আগামী নির্বাচনে হেরে যেতে পারে। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিরোধীদের পাশাপাশি নিজ দলের ভেতর থেকেও বেশ চাপে ছিলেন ট্রুডো।

ট্রুডোর উত্তরসূরি কে হতে যাচ্ছেন, সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। তবে বেশ কয়েকজনের নাম শোনা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ট্রুডোর সরকারের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড, পরিবহনমন্ত্রী অনিতা আনন্দ এবং কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা মার্ক কারনির নাম বেশ আলোচনায় রয়েছে। তবে ট্রুডোর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রক্ষণশীলরা পরের নির্বাচনে জিততে পারে বলে জনমত সমীক্ষায় বলা হচ্ছে। তারা যদি জেতে তাদের নেতা পিয়েরে পোইলিভরে কানাডার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন।

২০২২ সালে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর একজন কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন এবং বারবার আগাম নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছেন। পলিয়েভ্রে নিজেকে ‘অ্যান্টি-এলিট’ এবং ‘অ্যান্টি-ট্রুডো’ হিসেবে উপস্থাপন করেন, যিনি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন।

কানাডার মহাশক্তিধর প্রতিবেশী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় আসতে চলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী ২০ জানুয়ারি তার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। অনেকের মতে, ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারার মতো সরকার চায় কানাডা। ট্রুডোর পদত্যাগের পর দেশটিতে নির্বাচন এগিয়ে আনার দাবিও জোরালো হতে পারে।

তবে যাই ঘটুক, জাস্টিন ট্রুডোকে কানাডা এবং বিশ্ববাসী মিস করবে।


চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক