ভারতীয় সবকের দ্বিচারিতা

জুবায়ের হাসান
০৮ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ভারতীয় সবকের দ্বিচারিতা

বাংলাদেশে যা ঘটেনি তা-ই প্রচার করে চলেছে ভারত। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপদ অবস্থা সম্পর্কে যথাযথভাবে অবগত থাকা সত্ত্বেও ভারত জেনে-বুঝেই সর্বত্র ভুয়া, মিথ্যা ও অপতথ্যের ডালপালা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে বিশ্বপরিম-লে কোণঠাসা করে ফেলা। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য ভারত যে সবক দিয়ে চলেছে তা মূলত ভারতীয় দ্বিচারিতা। কেননা খোদ ভারতেই বিশ কোটিরও অধিক সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার ভারত রাখে না। বাংলাদেশে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারতীয় উদ্বিগ্নতা প্রকাশ ও অহরহ বিবৃতি প্রদান মূলত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চালবাজি।

ভারত যখন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথিত কাহিনি প্রচার করে চলেছে ঠিক তখন সে দেশেই ২৪ নভেম্বর সম্ভল শহরের শাহি জামা মসজিদ রক্ষা করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে চারজন মুসলিম নওজোয়ান নিহত হয়েছেন। এ ঘটনার জেরে সম্ভলের স্থানীয় এমপি জিয়াউর রহমান বার্কসহ প্রায় তিন হাজার মুসলিমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো দাবি করেছিল, ওই মসজিদ এককালে মন্দির ছিল এবং ওই মসজিদে প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা চালানোর জন্য তারা আদালতে আবেদন করে। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে ওই মসজিদে সমীক্ষা চালানোর আদেশ দেন। অতঃপর মসজিদে সমীক্ষা চলাকালে মুসল্লিদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এতে ওই চারজন মুসলিম নওজোয়ানের মৃত্যু হয়। এর আগে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশের বেনারসের (কাশী) জ্ঞানবাপি মসজিদেও একইভাবে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর দাবি আমলে নিয়ে আদালত ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে সমীক্ষা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। মাত্র ছয় মাস পর (জানুয়ারি, ২০২৪-এ) ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ রিপোর্ট দেয় যে, জ্ঞানবাপি মসজিদ নির্মাণের আগে সেখানে মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল। ফলে জ্ঞানবাপি মসজিদটিকে মন্দিরে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

ভারতে মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণ করার কর্মসূচি সর্বপ্রথম ১৯৯০ সালে চালু করেছিল বর্তমান শাসক দল বিজেপি। বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির নির্মাণের দাবি নিয়ে রথযাত্রা শুরু করলে ১৯৯১ সালে কংগ্রেস দলের তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও ভারতীয় ধর্মীয় উপাসনালয় সুরক্ষা আইন পাস করেন। ওই আইনে বলা হয়, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় কোনো মন্দির, মসজিদ বা গির্জার যে অবস্থা ছিল তা বদলানো যাবে না। তবে ওই আইনে অযোধ্যার বাবরি মসজিদকে সুরক্ষার বাইরে রাখা হয়। অতঃপর ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিজেপির নেতৃত্বে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়। এরপর দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দেন। ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি মহাসমারোহে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মাধ্যমে সেই রামমন্দির উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে ভারতে আরও বারোটি ঐতিহাসিক মসজিদ ও দরগাহ নিম্ন আদালতের আদেশ কিংবা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সমীক্ষার ঝুঁঁকিতে রয়েছে। এছাড়া হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি নামক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ভারতের প্রায় দুই হাজার মসজিদকে অবৈধ ঘোষণা করে ২০২২ সালে একটি তালিকা প্রণয়ন করেছে।

বিজেপিসহ একাধিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ভারতের মুসলিম শাসনকালকে কালো অধ্যায় হিসেবে চিত্রিত করে থাকে। মুসলিম বাদশাহদের বিরুদ্ধে হিন্দু নির্যাতনের নানা কাহিনি প্রচার করে বলা হয়, মোগল সম্রাট বাবর, আওরঙ্গজেব কিংবা এর আগের মুসলিম শাসকগণ মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, টানা আটশ বছরের বেশি সময় ধরে মুসলিম শাসন জারি থাকার পরও ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবেই থেকে গেছে এবং মসজিদের তুলনায় মন্দিরের আধিক্য বজায় থেকেছে। মুসলিম শাসকরা যদি সত্যিই নিপীড়ক হয়ে থাকেন, তাহলে আটশ বছরের মুসলিম শাসনের পরও সমগ্র ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হয় কী করে এবং সে দেশে মসজিদের চেয়ে মন্দিরের সংখ্যা কীভাবে বেশি হতে পারল? বস্তুত ভারতে মুসলিম শাসকগণ অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী হওয়ার ফলেই এমন হয়েছে। একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, মুসলিম শাসনামলেই গুরু নানক (জন্ম-মৃত্যু : ১৪৬৯-১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ) ভারতে শিখ ধর্মের প্রবর্তন ও প্রচার করেন এবং পরবর্তীকালে তা সারা ভারতে বিস্তার লাভ করতে পেরেছিল মুসলিম শাসনামলেই।

ভারতের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের পরিবর্তন ঘটতে থাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে হিন্দুত্ববাদের উত্থানের ফলে। হিন্দুত্ববাদ হলো একটি জাতিবাদী শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই এবং হিন্দুত্ববাদ মূলত একটি রাজনৈতিক বিষয়। হিন্দুত্ববাদ ও নাৎসিবাদ- এ উভয় মতবাদই জাত শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার আর্যবাদ থেকে উদ্ভূত। এ উপমহাদেশে ১৯৩০-এর দশকে হিন্দুত্ববাদ ও নাৎসিবাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল। আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা হয়ে পড়েন হিটলারের বিশেষ ভক্ত এবং হিটলারের আর্য শ্রেষ্ঠত্বের নাৎসিবাদকে সমর্থন করেন। কিছুকাল আগেও অনেক বিজ্ঞজন বলতেন, হিন্দুত্ববাদ সেকেলে হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের সে কথা ভুল প্রমাণ করে ১৯৮০ দশকের শুরুতে আদভানি ও বাজপেয়ির নেতৃত্বে ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপির আত্মপ্রকাশ ঘটে। অতঃপর বিজেপি হয়ে পড়ে ভারতের অন্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর আদর্শিক অভিভাবক। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস, প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২৫), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (১৯৬৪), শিব সেনা (১৯৬৬), বজরং দল (১৯৮৪), হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি (২০০২), শ্রী রাম সেনা (এসআরএস, ২০০৫) প্রমুখ সংগঠন এখন ভারতীয় রাজনীতিতে ভীষণ পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী। এসব সংগঠনের সঙ্গে বিজেপির রয়েছে গাঁটছড়া। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি ভারতের লোকসভায় আসন পেয়েছিল মাত্র দুটি। তবে এর পর থেকে দলটি অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণ কর্মসূচি গ্রহণ করলে এর জনপ্রিয়তা দ্রুতই বাড়তে থাকে। বর্তমানে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সারা ভারতে বিস্তৃত হয়ে স্থায়ী রূপ লাভ করায় তা এ উপমহাদেশের মুসলমানসহ সব সংখ্যালঘুর মনে হিন্দুত্ববাদের ভীতি তৈরি করেছে। বিশেষ করে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার স্মৃতি মুসলিম মানসপটে এখনও ভীতির সঞ্চার করে।

গত ৭ ডিসেম্বর বিবিসি ইংরেজি বিভাগ প্রকাশিত ‘মুসলিম কাপল ফোর্সড টু সেল হাউস আফটার প্রটেস্টস বাই হিন্দু নেইবারস’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, হিন্দুত্ববাদ ভারতীয় সমাজে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কী পরিমাণ ঘৃণার সাগর তৈরি করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ শহরে ডাক্তার অশোক বাজাজ তার প্রায় ৪০ বছরের পুরনো মুসলিম সহকর্মীর কাছে বাড়ি বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর হিন্দু প্রতিবেশীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অবশেষে ওই মুসলিম ডাক্তার বাড়িটি এক হিন্দু পরিবারের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এই প্রতিবেশী হিন্দু বিক্ষোভকারীরা সবাই ছিল উচ্চশিক্ষিত, ধনী ও অভিজাত শ্রেণির। কিন্তু তার পরও তারা কোনো মুসলিম পরিবারকে তাদের প্রতিবেশী হিসেবে দেখতে রাজি নয়।

গত ১৩ ডিসেম্বর আলজাজিরা ‘আফটার দ্য বুলডোজার : ইন্ডিয়ান মুসলিমস গ্রাপল উইথ লস অ্যামিড ডেমোলিশড হোমস’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও হরিয়ানার বিভিন্ন এলাকার মুসলিম বসতি উচ্ছেদের করুণ কাহিনির বিবরণ তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বুলডোজার দিয়ে বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার কর্মকা-কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের কৌশল হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথকে বুলডোজার বাবা এবং মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা শিবরাজ সিং চৌহানকে বুলডোজার মামা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

গত ১ মে এবং ২ অক্টোবর মার্কিন প্রতিষ্ঠান কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম তাদের বার্ষিক ও হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই দুই প্রতিবেদনে ভারতকে গুরুতর ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনকারী দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয় এবং বিজেপির শাসনকালে ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্রমাগত অবনতির কথা উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে মুসলিম নিপীড়নের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি খ্রিস্টান, শিখ, দলিত, ইহুদি ও আদিবাসীদের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন, ধর্মান্তরবিরোধী আইন, বিবাহ-তালাক-উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন, সংশোধিত ওয়াকফ আইন, গোরক্ষা আইনসহ অন্যান্য নিপীড়নমূলক আইনের সমালোচনা করা হয়।

গত ২৮ নভেম্বর আসাম ক্রিশ্চিয়ান ফোরাম (এসিএফ) এক বিবৃতিতে আসামে কয়েক বছর ধরে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত ১৯ ডিসেম্বর ভারতীয় লোকসভায় সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের সংঘর্ষে আহত বিজেপির দুজন সংসদ সদস্যদের মধ্যে একজন হলেন প্রতাপ সারঙ্গি। ১৯৯৯ সালে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারক অস্ট্রেলীয় নাগরিক গ্রাহাম স্টেইনস এবং তাঁর দুই পুত্র ফিলিপ ও টিমোথিকে পুড়িয়ে মারার দায়ে তার যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছিল। পরে তিনি মুক্তি পান এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনে জিতে নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় স্থান লাভ করেন।

ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানকে ঠেকানো যায়নি মূলত তিনটি কারণে। প্রথমত, কংগ্রেসের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব ও নেতৃত্বের দুর্বলতা; দ্বিতীয়ত, ভারত পণ্য কেনাবেচার বিশাল বাজার হওয়ায় হিন্দুত্ববাদের উত্থান সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বের নীরবতা এবং তৃতীয়ত, ২০০১ সালে জর্জ বুশ কর্তৃক বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমনে ভারতকে সঙ্গী করা। কিন্তু পৃথিবী এখন বদলেছে। এ অবস্থায় ভারত যদি নিজেকে সংশোধন না করে, তবে হিন্দুত্ববাদের থাবায় সে নিজেকেই ধ্বংস করে ফেলবে।


জুবায়ের হাসান : রাজনৈতিক বিশ্লেষক