গরিবের জন্য ভ্যাট আর অতি ধনীদের অট্টহাসি
বছরের প্রথম দিনেই মধ্যবিত্ত আর উচ্চ নিম্নবিত্তদের জন্য সুখবর তো ছিলই না বরং ছিল নুতুন ভ্যাটের বোঝা নিয়ে চিন্তা। তবে সবার আগে উচ্চ নিম্নবিত্ত কারা এটা জানা দরকার। উচ্চ নিম্নবিত্ত হলেন যারা নিজেদের মধ্যবিত্ত মনে করেন, মধ্যবিত্তের জীবন ধারণ করার চেষ্টা করেন কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে নিম্নবিত্তের গণ্ডি থেকে বের হতে পারেন না তারা। অর্থাৎ মাসে দুবার বৌ-বাচ্চাসহ রেস্টুরেন্টে যেতে পারেন তারা, কিন্তু মনোমতো সব খাবার একবারে অর্ডার করতে পারেন না। একবার গরুর মাংসের কালাভুনা অর্ডার করলে সঙ্গে খাসির লেগ রোস্ট অর্ডার করতে পারেন না। সেটা পরের বারের জন্য তুলে রাখতে হয়। বাচ্চাটা হুট করে এক স্কুপের পর আরেক স্কুপ আইসক্রিম চাইলে এক বেলা বাসায় আমিষ কম হয়। তারাই উচ্চ নিম্নবিত্ত।
এখন আসল কথায় আসা যাক। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, বছরে ৫০ লাখ টাকা বিক্রি হলেই সেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। বছরে ৫০ লাখ অর্থ হলো মাসে চার লাখ ১৬ হাজার টাকার মতো অথবা দিনে ১৩ হাজার ৯০০ টাকা বিক্রি হলেই সেই ব্যবসাকে ভ্যাট দিতে হবে। ভ্যাট মানে সরকারকে ট্যাক্স দেবে ব্যবসা, কিন্তু সেই টাকা ব্যবসা নেবে ক্রেতার কাছ থেকে।
এখন মনে করি আপনার একটা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা আছে। দিনে যদি আপনার ১৩ হাজার ৯০০ টাকা বিক্রি হয় তাহলে আপনাকে ভ্যাট দিতে হবে ১৫ শতাংশ। ধরি আপনার রেস্টুরেন্ট শুধু কাচ্চি বিক্রি করে, যার দাম ২৮০ টাকা। এখন যদি আপনার দিনে ৫০ প্লেট কাচ্চি বিক্রি হয় তাহলে আপনাকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এটা কিন্তু বিক্রির হিসাব, মুনাফার না। এখন কি আপনি পারবেন ২৮০ টাকায় সেই আগের কাচ্চি বিক্রি করতে? আপনার মুনাফা থাকবে? আপনাকে তাহলে এখন কী করতে হবে? হয় আপনার কাচ্চির পরিমাণ কমাতে হবে, অথবা গুণগত মান কমাতে হবে অথবা দাম বাড়াতে হবে। এর প্রভাব পড়বে সরাসরি ক্রেতার ওপর। মানে আমার, আপনার ওপর। অথচ অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, ভ্যাট বাড়ানোর ক্ষেত্রে ‘মনে হয় না কষ্ট হবে। জনগণের স্বস্তি না পাওয়ার তো কোনো কথা না।’ ভ্যাট বসছে মোট ৪৩টি পণ্য ও সেবার ওপর।
সরকারের দেশ ও নিজেকে চালাতে টাকা লাগে। এই টাকা সরকারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জোগান দেয় দেশের জনগণ ব্যবসা-চাকরি করে, রেমিট্যান্স পাঠানোসহ আরও কিছু উপায়ে। সরকারকে এই টাকা দেওয়ার কারণ হলো সরকার জনগণের খেয়াল রাখবে, নিরাপত্তা দেবে, বৈষম্য দূর করবে ইত্যাদি। পুরো পৃথিবীতে এই জিনিস চলে। কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু ‘পুরো বিশ্বের বুকে বিস্ময়’, তাই এর হিসাব একটু আলাদা।
পুরো পৃথিবীতে সরকার যাদের টাকা বেশি থাকে, যেসব পণ্য ও সেবা ধনী বা অতি ধনীরা ব্যবহার করেন, সেই সব পণ্য ও সেবায় ট্যাক্স বেশি বসায়, ধনীদের কাছ থেকে ট্যাক্স বেশি নেয়। সেই বেশি ট্যাক্সের টাকা দিয়ে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের কিছু সুবিধা সরকার দেয়। সেটা জীবনধারণ থেকে শুরু করে সেবা ও পণ্যের ক্ষেত্রে পর্যন্ত। এখন দেখা যাক ‘বিশ্বের বিস্ময়ৎ বাংলাদেশ কী কী জিনিসে ভ্যাট বসিয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনে নন-এসি রেস্টুরেন্টের ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে, এসি রেস্টুরেন্টে ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ, সব ধরনের পোশাকের ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ, মিষ্টিও ৭.৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর সব মধ্যবিত্ত, নিম্ন-উচ্চবিত্ত, এমনকি মাঝে মাঝে নিম্নবিত্তরাও ব্যবহার করে। এখন বলতে পারেন, এসব কি উচ্চবিত্ত বা অতি উচ্চবিত্তরা ব্যবহার করেন না? করেন। মিষ্টি মনে হয় আমাদের দিনমজুর ভাই থেকে শুরু করে অতি উচ্চবিত্ত মানুষটি পর্যন্ত খান। দিনমজুর ভাইটি মিষ্টি খেতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেবেন, একই সঙ্গে প্রাডো থেকে নামা ভদ্রলোকও দেবেন ১৫ শতাংশ ভ্যাট। একদম সাম্যাবস্থা বিরাজমান।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
যেসব পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বসানো হয়েছে তাদের ব্যবসার মূল ক্রেতা মধ্যবিত্ত ও উচ্চ নিম্নবিত্তরা। সরকার মধ্যবিত্ত , উচ্চ নিম্নবিত্ত ও নিম্নবিত্তের কাছ থেকে টাকা বেশি করে নেবে। অথচ নেওয়ার কথা ছিল উচ্চবিত্তের কাছ থেকে। তাদের কাছ থেকে, তাদের ব্যবহার্য পণ্যের ওপর ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়ানো দরকার ছিল।
আগের রাজনৈতিক সরকারগুলো যেমন গরিবের টাকায় বড়লোকদের পেলেছে, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের ব্যাংকে জমানো টাকা উচ্চবিত্তদের মাঝে ঋণের নামে বিলিয়েছেÑ এখনকার অরাজনৈতিক সরকারও ঠিক একইভাবে মধ্যবিত্ত আর উচ্চ নিম্নবিত্তের টাকা দিয়ে বিত্তবানদের খুশি করতে চায়। এ ব্যাপারে সবাই সহমত ভাইয়ের মতো আচরণ করছে। এনবিআরের পাঠানো প্রস্তাবনা থেকে শুধু ওষুুধ আর মোবাইল টকটাইমের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব বাদে প্রায় পুরোটাই মেনে নেওয়া হয়েছে।
সরকারের টাকা লাগবে। এনবিআর সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে পারছে না তার নিজের দোষ এবং অসক্ষমতার জন্য। তাই যেসব জায়গা থেকে টাকা আসছে সেসব জায়গায় চিপে আরও টাকা বের করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই অরাজনৈতিক সরকারের তো এনবিআরকে এই ধারা থেকে বের করার চেষ্টা করার দরকার ছিল।
বাংলাদেশে কর প্রদান করেন মাত্র ১৮ লাখ মানুষ, যার মধ্যে ১০ লাখই সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবী। এর অর্থ মাত্র আট লাখ ব্যবসায়ী ট্যাক্স দেন। তাহলে দেশে ধনী বা অতি ধনী মানুষের সংখ্যা মাত্র আট লাখ? ২০ কোটি মানুষের দেশে ১৮ লাখ ট্যাক্স প্রদানকারী! ১০ শতাংশ মানুষ ট্যাক্স প্রদান করলেও দুই কোটি মানুষের ট্যাক্স প্রদান করার কথা। এনবিআর এই ধনী, অতি ধনীদের ট্যাক্স জালে আনতে না পেরে দ্রুত সরকারকে টাকার জোগান দেওয়ার জন্য মধ্যবিত্ত ও উচ্চ নিম্নবিত্তদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করার সহজ পথ নিয়েছে। কারণ এই দুই শ্রেণি নিরুপায়, দুর্বল ও অসংগঠিত। তাই তাদের সঙ্গে বৈষম্য করা সহজ।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
সংস্কার কথাটা বলা সহজ। করাটা বেশ কঠিন। করজাল বাড়ানোর অনেক উপায় থাকার পরও সেগুলোর প্রয়োগ করা হচ্ছে না। একদম ফ্রিতে উপায় বলে দিলে সেটার কোনো মূল্য থাকে না এর পরও একটা বলে দিই। দেশের মোটামুটি সবার এনআইডি আছে। সেই এনআইডির সঙ্গে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, মোবাইল ব্যাংকিং, মোবাইল নম্বর , টিন সবই যুক্ত। তাদের মধ্যে যাদের বয়স ৩৫-এর বেশি এবং টিন নেই, তাদের লিস্ট বের করে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কোনো মাসে দিয়েছে কি না এটা দেখলেই কারা ট্যাক্স জালের বাইরে আছে তা বের করে ফেলা যায়। এই লিস্ট বানানো এবং ব্যাংকের সঙ্গে টাকার হিসাব মেলানো ১০ মিনিটের কাজ সফটওয়্যার দিয়ে। এরপর সেসব মানুষকে ট্যাক্সের আওতায় আনার জন্য এনবিআর তো আছেই। তবে মনে হয় না এনবিআর চায় এসব করতে। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যেন এনবিআর এসব চায়।
২০২৫ মধ্যবিত্ত আর উচ্চ মধ্যবিত্তের জন্য কঠিন এক বছর হতে চলেছে। কারণ তাদের পক্ষে কখনো কেউ ছিল না, এখনো কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। এই দুই শ্রেণিকে নিজেদেরই নিজেদের বাঁচাতে হবে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বেতনে কম ইনক্রিমেন্ট, সরকারের বৈরী মনোভাব, আমলাতন্ত্রের বৈষম্যমূলক নীতির সঙ্গে তাদের নিজেদেরই যুদ্ধ করতে হবে বাঁচার জন্য। এই যুদ্ধ করতে করতে কখনো তারা মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ নিম্নবিত্ত হয়ে যাবে। তাদের হেরে যাওয়ার জন্য এই যুদ্ধ দেখে উচ্চবিত্তদের অট্টহাসি অমানবিক লাগলেও অযৌক্তিক না।
কোন স্বাভাবিক বুদ্ধির মানুষ নিশ্চিত পরাজয় জেনেও যুদ্ধ করবে? এমন বুদ্ধি-বিবেচনাহীন মানুষদেরই আগেকার যুগের মানুষ জোকার বলত, তাদের দেখে হাসত। ঠিক সেভাবেই সরকার আর অতি ধনীরা মধ্যবিত্ত আর উচ্চ নিম্নবিত্তদের দেখে হাসে অট্টহাসি।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী :
সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ফিনটেক
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি