বাংলাদেশ সেনাবাহিনী : পার্বত্য অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কাণ্ডারি

মো. রফিকুল আলম
০৪ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী : পার্বত্য অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কাণ্ডারি

‘শান্তি, সম্প্রীতি এবং উন্নয়ন’ মূলমন্ত্র সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এমন একটা সময় ছিল যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ছিল না তেমন শিক্ষার আলো। গুরুতর অসুস্থ কিংবা আহত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাব ছিল। পাহাড়ি জনপদে ছিল অন্ধকারে পর্যবসিত এক অনিশ্চিত জীবনযাত্রা। সময় গড়িয়ে বদলে গেছে সেই পাহাড়ি জনপদ। ব্যাপক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সেই পাহাড়ে এখন পরিলক্ষিত হয় সতেজ প্রাণের স্পন্দন। আর সেই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল ধারক হিসেবে অবিরাম কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাত ধরেই অভূতপূর্ব উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে গেছে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং রাঙামাটি জেলার পাহাড়ি জনপদ। কুসংস্কার, অসচেতনতা, দারিদ্র্য, বিদ্যালয় সংকট, শিক্ষক সংকট, অনুন্নত রাস্তাঘাট, সর্বোপরি শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে পাহাড়ি জনপদে স্কুলগামী শিক্ষার্থীর হার ছিল নগণ্য। পাহাড়ি অধিবাসীরা কখনো ভাবেনি তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়বে এবং শিক্ষিত হয়ে দেশসেবায় নিয়োজিত হবে। অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে জুমে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারে নেয়ার আগে বেশির ভাগ সময় ক্ষেতেই পচে যেত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চারটি রিজিয়ন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামো উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করার ফলে আজ পার্বত্য অঞ্চলের সেই অবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে।

পাহাড়ি জনপদে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সেনাবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। দুর্গম পাহাড়ে এখন জ্বলছে বিদ্যুতের বাতি, গড়ে উঠেছে উন্নত সড়কব্যবস্থা আর পর্যটনকেন্দ্র্র্র। ফলে পাল্টে যাচ্ছে সেখানকার জীবনধারা। তবে এখনো পাহাড়ি জনপদে বিদ্যমান কয়েকটি উগ্রবাদী গোষ্ঠীর কারণে মাঝেমধ্যেই উত্তপ্ত হয় পার্বত্য এলাকা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেই উগ্রতা দমন করে পাহাড়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বহুমুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা ঝুঁঁকি সামাল দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যাপক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছে।

স্কুল এবং ভালো যোগাযোগব্যবস্থার স্বল্পতার কারণে পার্বত্য এলাকার অনেকেই শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজসহ দেড় হাজারেরও বেশি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়াও সার্বিক পরিস্থিতি উত্তরণের মাধ্যম হিসেবে সেনাবাহিনীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং অর্থায়নে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবানে অনেক ইংরেজি এবং বাংলা মাধ্যমের স্কুল (দিবা এবং নৈশ) পরিচালনা করা হয়। সেনাবাহিনী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো থেকে শুরু করে বই বিতরণ, আর্থিক অনুদান, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, বিভিন্ন শিক্ষাসামগ্রী প্রদান, ছাত্রছাত্রী পরিবহন, খেলাধুলার সামগ্রী, ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ড্রেস এবং কম্পিউটার বিতরণ করে সর্বদা উপজাতি এবং বাঙালিদের পাশে দাঁড়িয়ে পাহাড়ি জনগণের শিক্ষার মানোন্নয়নে ইতিবাচক অবদান রেখেছে। সেনা রিজিয়ন এবং জোন পরিচালিত কম্পিউটার কিংবা কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উপজাতি এবং বাঙালি প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করার ফলে তাদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।

চিকিৎসাব্যবস্থা সর্বদাই পাহাড়ি জনপদে একটি দুশ্চিন্তার কারণ ছিল। দুর্গম পাহাড়ের বাসিন্দাদের কেউ অসুস্থ হলে মাইলের পর মাইল হেঁটে অথবা রোগীকে কাঁধে তুলে নিকটস্থ হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে নিতে হতো। এখন আর রোগীকে হেঁটে অথবা কাঁধে তুলে নিয়ে যেতে হয় না। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে সহস্রাধিক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করার ফলে পার্বত্য অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে শতাধিক ব্রিজ এবং কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। এ ছাড়াও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫৩২ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা তৈরি এবং মেরামত, যাতায়াতের সুবিধার্থে ছোট ছোট নদী এবং খালের ওপর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেতু এবং সাঁকো তৈরি করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা-বাঘাইহাট সড়ক, বাঙ্গালহালিয়া-রাজস্থলী সড়ক, বাঘাইছড়ি-মাসালং-সাজেক সড়ক, দীঘিনালা-ছোটমেরুং-চঙ্গরাছড়ি-লংগদু সড়ক, দীঘিনালা-মারিশ্যা সড়ক, চিম্বুক-থানচি সড়ক, বান্দরবান-বাঙ্গালহালিয়া-চন্দ্রঘোনা-ঘাগড়া সড়ক এবং থানচি-আলীকদম সড়ক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করার কারণে পাহাড়ি জনপদে এসেছে প্রাণের স্পন্দন। ফলে পর্যটনশিল্পের ব্যাপক বিকাশের মাধ্যমে পাহাড় এবং সমতলের মানুষের মধ্যে সহযোগিতা এবং সৌহার্দের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও খাগড়াছড়ির বেতলিং, রাঙামাটির মাঝিরপাড়া এবং দুর্গম সাইচল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ শেষ হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে, যেটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উঁচু সড়ক নির্মাণের কীর্তি। ফলে ওই জনপদের জনসাধারণ দুই-তিন দিনের গন্তব্যে এখন মাত্র কয়েক ঘণ্টাতেই পৌঁছতে পারে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে পাহাড়ি জনপদের শিক্ষা, অর্থনীতি, বাণিজ্য এবং কৃষিতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চল ছিল স্বাস্থ্যসেবায় পিছিয়ে পড়া জনপদের মধ্যে অন্যতম। একসময় পার্বত্য তিন জেলায় হাসপাতাল এবং ক্লিনিক ছিল মাত্র চব্বিশটি। নিয়োজিত হওয়ার শুরু থেকেই পার্বত্য দুর্গম এলাকার মানুষের চিকিৎসায় সব সময় পাশে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনী। কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অনেক কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং রাঙামাটির দুর্গম অঞ্চলের কোভিড আক্রান্ত মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া এবং ঘরে ঘরে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর প্রতিটি ক্যাম্প থেকে বিতরণ করা হয় হাজার হাজার মাস্ক এবং গ্লাভস। সেনাবাহিনী প্রতিবছর নিয়মিতভাবে পার্বত্য তিন জেলায় বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে, যেখানে পার্বত্য এলাকার সুবিধাবঞ্চিত পাহাড়ি এবং বাঙালি জনসাধারণের চোখের ছানি অপারেশনসহ বিভিন্ন ধরনের চক্ষুসেবা প্রদান করা হয়। জন্মকালীন মৃত্যু রোধে সেনাবাহিনী ধাত্রী প্রশিক্ষণের আয়োজন করার ফলে পার্বত্য অঞ্চলে মা এবং শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমেছে। সেনাবাহিনী নিয়মিতভাবে মেডিকেল ক্যাম্পেইন পরিচালনা করার ফলে বহু দুস্থ উপজাতি এবং বাঙালি বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে। পাহাড়ি জনপদের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের চিকিৎসাসেবায় সেনাবাহিনীর এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় থেকে শুরু করে বান্দরবান জেলার সীমান্তসংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত মোট ১০৩৬ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হবে। বলা যায়, অসাধ্য সাধন করে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তিন জেলার দুর্গম পাহাড়ে এই সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। কারণ সমতলে যত সহজে শ্রমিক এবং নির্মাণসামগ্রী পাওয়া যায়, পাহাড়ে তা তত সহজ নয়। প্রথম পর্যায়ে ৩১৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের দিকে। প্রকল্পটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত হলে পার্বত্য জেলাগুলোর সীমান্ত বরাবর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতিসাধন, সীমান্তের দুই পাশের অবৈধ ব্যবসা (অবৈধ অস্ত্র, মাদক, মানব পাচার ইত্যাদি) বন্ধের পাশাপাশি পাহাড়ি জনগণের যেমন কর্মসংস্থান বাড়বে, তেমনি স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটবে। শিশু শিক্ষার্থীরা দূরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়াশোনা করতে পারবে। অসুস্থ রোগীদের সীমান্ত সড়ক ব্যবহার করে দ্রুত উপজেলা বা জেলা সদরের হাসপাতালে নিয়ে আসতে পারবে, ফলে রক্ষা পাবে অসংখ্য জীবন। সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে স্থানীয় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য সাশ্রয়ী খরচে এবং সহজে বাজারজাত করতে পারবে। একইভাবে আমদানিকারকরা সহজে স্থানীয় বাজার থেকে পাহাড়ি পণ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। এ ছাড়াও বাড়বে পর্যটকদের বিচরণ। সড়কের পাশে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে বসতি এবং দোকান। ফলে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান বেড়েছে, যা এখানকার মানুষের কাছে এখনও স্বপ্নের মতো। পাশাপাশি পার্বত্য জেলাসমূহের মধ্যে আন্ত আঞ্চলিক সংযোগ স্থাপিত হবে, যার মাধ্যমে নিরাপত্তা কার্যক্রম এবং ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ফলে সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে নির্মিত সীমান্ত সড়ক পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নতিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে কৃষির এক অপার সম্ভাবনা। কৃষি এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন যথাযথ সেচ প্রকল্প। স্থানীয়দের সমবায় সমিতির মাধ্যমে গভীর নলকূপ স্থাপনে সেনাবাহিনী প্রয়োজনীয় সহায়তা করছে। এ ছাড়া কৃষিকাজের জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে পাওয়ার টিলার, পাম্প মেশিন, সার, ধান মাড়াই কল এবং স্প্রে মেশিন। ফলে বেড়েছে চাষাবাদ এবং কৃষি উৎপাদন। পাহাড়ি চাষিরা প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা থেকে বিভিন্ন উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করে নিজেদের জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন করছেন। এ ছাড়াও বনজ সম্পদ রক্ষাকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিজ ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত বনায়ন কর্মসূচি পালন করছে।

পর্যটনের জন্য পার্বত্য ভূখণ্ড বরাবরই আকর্ষণীয়। তথাপি পর্যাপ্ত যোগাযোগ এবং আবাসন সুবিধার অভাবে এই সম্ভাবনার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রমে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অবকাঠামো নির্মাণ এবং রাত্রিযাপনের সুবিধা তৈরি হওয়ায় সৌন্দর্যপিপাসু হাজারো মানুষ এখন পাহাড়ের বিভিন্ন দুর্গম স্থানে ভ্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছে। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে নির্মিত নীলগিরি, সাজেক এবং কাপ্তাই লেকের রিসোর্ট পর্যটনশিল্পকে অনেক সম্প্রসারিত করেছে। শুভলং জলপ্রপাত, বগা লেক, আলুটিলা, চিম্বুক হিল, স্বর্ণমন্দির প্রভৃতি এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তাবিধানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী পর্যটনশিল্প বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ফলে স্থানীয় পাহাড়ি এবং বাঙালিদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে।

সেনাবাহিনীর উদ্যোগে বিগত বছরে পার্বত্য অঞ্চলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গভীর নলকূপ এবং টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে। ফলে তাদের সুপেয় এবং বিশুদ্ধ পানির কষ্ট লাঘ হয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলার আলুটিলা পুনর্বাসন এলাকায় ১৬০টি পরিবারের চারশত জন ব্যক্তি সুপেয় পানির উৎসের অভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ পানির সমস্যায় ভুগছিল। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে খাগড়াছড়ি রিজিয়নের উদ্যোগে দশ হাজার লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি পানির ট্যাংক স্থাপন করা হয়। পাঁচশত মিটার গভীর থেকে পানি সংগ্রহ করে ওই ট্যাংকে সংরক্ষণ করা হয় এবং সেখান থেকে স্থানীয়রা এখনো সুপেয় পানি সংগ্রহ করছে।

পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি-বাঙালি মহিলাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে সেনাবাহিনীর প্রতিটি জোন থেকে বিনামূল্যে সেলাই মেশিন বিতরণ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়া ক্যাম্পের সন্নিকটে অথবা সুবিধাজনক স্থানে কুটির শিল্প প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করে মহিলাদের বিভিন্ন তাঁতসামগ্রী তৈরির প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়, যেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিভিন্ন কাঁচামাল ক্রয় বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করে। সেনাবাহিনী নিয়মিত দুস্থ পরিবারকে গাভী কিংবা ছাগল প্রদান করার ফলে তাদের পারিবারিক উপার্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়াও সেনাবাহিনীর উদ্যোগে বিভিন্ন পাহাড়ি পাড়ায় পুরুষ এবং মহিলাদের মুরগির ফার্ম পরিচালনা, বিভিন্ন ফল (ড্রাগন, মাশরুম, স্ট্রবেরি) এবং মৎস্য চাষের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়, যা তাদের পারিবারিক সচ্ছলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তিন পার্বত্য জেলায় প্রতিবছর হাজার হাজার দুস্থ মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ এবং আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়।

বিদ্যুতায়ন ছাড়া কোনোভাবেই পাহাড়ি জনপদের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিষয়টি মাথায় রেখে সেনাবাহিনীর প্রতিটি জোন শুরু থেকে স্থানীয় প্রশাসন এবং জেলা বিদ্যুৎ অফিসের সঙ্গে অবিরাম সমন্বয় করার ফলে অধিকাংশ পার্বত্য এলাকা আজ বিদ্যুতের ছোঁয়া পেয়েছে। এ ছাড়াও সেনাবাহিনীর উদ্যোগে হাজারো পরিবারের মধ্যে সোলার প্যানেল বিতরণ করার ফলে দুর্গম পাহাড়ের ঘরে ঘরে এখন জ্বলছে বিদ্যুতের আলো। বিদ্যুতের মাধ্যমে সেচ প্রকল্প হয়েছে ত্বরান্বিত। বৃদ্ধি পেয়েছে কৃষি উৎপাদন। প্রতিটি বাজারে বিদ্যুৎ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বিদ্যুৎ আসার ফলে আজ পুরো পার্বত্য অঞ্চল মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে এবং পাহাড়ি-বাঙালি সবাই সুলভে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছে, যা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল।

আঞ্চলিক দল এবং উপজাতি স্বার্থান্বেষী মহল সাম্প্রদায়িক উসকানির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে সেনাবাহিনীবিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসীরা সড়ক, সেতু, কালভার্ট নির্মাণসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে চাঁদাবাজি এবং হুমকি প্রদানের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসীদের চাঁদা দাবিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পার্বত্য সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজে বারবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর সজাগ দৃষ্টির কারণে পার্বত্য অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তারা কখনো থামাতে পারেনি।

পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে পাহাড়ি সন্ত্রাসী বাহিনীর গুলিতে সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য আহত এবং শহীদ হয়েছেন। এ ছাড়া অনেক সেনা সদস্য ম্যালেরিয়া, সাপের কামড়ে কিংবা বন্য জন্তুর আক্রমণে মারা গেছেন। তথাপি পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের সীমিত সম্পদ এবং জনবল দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বেসামরিক প্রশাসন এবং পাহাড়ি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, যাতায়াতব্যবস্থা এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেনাবাহিনীর নিরলস প্রচেষ্টায় সামাজিক সব সূচকে ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি পাহাড়ি জনপদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।


লে. কর্নেল মো. রফিকুল আলম, পিএসসি, (সেনাবাহিনীর একজন অফিসার)