নতুন বছরে ক্রীড়াঙ্গন হোক দলীয় প্রভাবমুক্ত

জাহিদ রহমান
০২ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
নতুন বছরে ক্রীড়াঙ্গন হোক দলীয় প্রভাবমুক্ত

শুধু আওয়ামী লীগ আমল বলে নয়, যখনই যে দল ক্ষমতায় থেকেছে তখনই ক্রীড়াঙ্গনে চলেছে নির্বিবাদে রাজনীতিকরণ, দলীয়করণ এবং স্বজনপ্রীতি। ফেডারেশন ও জেলা, উপজেলার ক্রীড়া সংস্থাগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যোগ্য, নিবেদিত এবং পরীক্ষিতদের দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অযোগ্যদের। কেউ কেউ আবার কোনো এক অদৃশ্য মধুর লোভে নানান উপায়ে পদ-পদবি ধরে রেখেছেন বছরের পর বছর। তবে গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ক্রীড়াঙ্গনে দলীয়করণ ছিল রীতিমতো দৃষ্টিকটু। ক্রীড়া ফেডারেশন থেকে শুরু করে জেলা ক্রীড়া সংস্থা, ডিএফএ সর্বত্র ছিল দলীয়করণের উৎসব। আর এ কারণেই প্রকৃত সংগঠকদের বেশির ভাগকেই ছিটকে পড়তে হয়েছিল, না হয় আড়ালে চলে যেতে হয়েছিল। নিবেদিত অনেক ক্রীড়া সংগঠক, ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেই গত ১৬ বছরে তাই দেখা যায়নি। তবে আওয়ামী লীগের আগে বিএনপির আমলেও এমন দৃশ্য ছিল। খেলাধুলার ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও সে সময় অনেককেই দেখা গেছে বিভিন্ন ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ার দখলে রাখতে।

ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে কিছু ফেডারেশন রয়েছে যেখানে বরাবরই দেখা গেছে কিছু পরিচিত মুখ যুগের পর যুগ ধরে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে বসে আছেন। এই অভিযোগ বেশি ছিল কুস্তি ফেডারেশন, হ্যান্ডবল ফেডারেশন, তায়কোয়ান্দো ফেডারেশন, ভলিবল ফেডারেশনসহ আরও কয়েকটি ফেডারেশনের বিরুদ্ধে। একই মুখকে বারবার সভাপতি, সম্পাদক পদে দেখা গেছে বছরের পর বছর, যুগ যুগ ধরে। কোনো এক জাদুবলে তারা চেয়ার ধরে রেখেছেন শক্ত করে। নিজ ফেডারেশনের সফলতা আসুক বা না আসুব কেউ সেই চেয়ার থেকে সরাতে পারেননি। তবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ক্রীড়াঙ্গনেও নতুন প্রত্যাশা সঞ্চারিত হয়। তাই দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়মে ডুবে থাকা বিভিন্ন ফেডারেশন ঢেলে সাজানোর তাগাদা জোরালো হয়ে আসে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ক্রীড়াঙ্গনে পরিবর্তনের সুর প্রতিধ্বনিত হয়। দ্রুতই তাই দেশের দুই জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট ও ফুটবলে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ক্রিকেটে বহুদিন ধরে সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান আওয়ামী লীগ আমলের প্রভাবশালী ক্রীড়া সংগঠক এবং পার্লামেন্টের সদস্য নাজমুল হাসান পাপন। তার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হন সাবেক ক্রিকেটার এবং নির্বাচক ফারুক আহমেদ। তিনিই এখন সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এর পর পরই বাফুফেতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সভাপতির পদে আসীন হন তরুণ নেতা, সাবেক ফুটবলার তাবিথ আওয়াল। তার নেতৃত্বে বাফুফের নতুন কমিটি কাজ করছে। এদিকে ফেডারেশনগুলো ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়ায় গত ১০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ৪২টি ফেডারেশন, অ্যাসোসিয়েশন ও সংস্থার সভাপতিকে অপসারণ করা হয়। একইভাবে ভেঙে দেওয়া হয় বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা, বিভাগীয় নারী ক্রীড়া সংস্থা, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, জেলা নারী ক্রীড়া সংস্থা, উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা ও উপজেলা নারী ক্রীড়া সংস্থার বিদ্যমান কমিটি। ফেডারেশনগুলোর কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর হকি, অ্যাথলেটিক্স, দাবা, কাবাডিসহ কয়েকটি ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু অ্যাডহক কমিটিগুলো প্রত্যাশামাফিক হয়নি বলে ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট অনেকেই মতপ্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

নতুন বছরে ক্রীড়াসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন রাজনীতি আর দলীয়করণের বাইরে গিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে একটি সুন্দর টেকসই পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে সমন্বিত ভালো ফলাফল আকাশের চাঁদ হয়েই থাকবে। সব জায়গায় তাই যোগ্য, নিবেদিতদের জায়গা করে দেওয়ার ভালো সময় এটিই। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, অ্যাথলেটিক্স, দাবা, সাঁতার সবখানেই তাই নতুন স্বপ্নও উঁকি দিচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় ফুটবলে এ বছরে কেমন প্রত্যাশাÑ এটি জানতে চেয়েছিলাম সাবেক তারকা ফুটবলার ইমতিয়াজ সুলতান জনির কাছে। তিনি বলেন, ‘সবকিছুর বিচার করলে গত ১৬ বছরে ফুটবলে যতটা এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। সময় এসেছে নতুন করে পরিকল্পনা করার। যেহেতু নতুন কমিটি হয়েছে সেহেতু এই কমিটির উচিত হবে ফুটবলের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আগামী দশ বছরের জন্য একটি সুন্দর, সুনির্দিষ্ট, টার্গেটেড পরিকল্পনা করা। যে পরিকল্পনার ভিত্তিতে ফুটবলে ট্যালেন্ট হান্ট থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের ক্যালেন্ডার সবকিছু চলবে। উপজেলা, জেলায় নিয়মিত ফুটবল হতে হবে। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফুটবল হবে। আর ফুটবল থাকবে সব রাজনীতির বাইরে, দলীয় প্রভাবমুক্ত। এটা হলে ফুটবলে আমরা অবশ্যই ভালো ফল পাব।’ এ বছর ফুটবলে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এএফসি এশিয়ান কাপ ফুটবল। এই টুর্নামেন্টের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মাত্র একবার এশিয়ান কাপে খেলেছে। ২০২৭ সালে সৌদি আরবে এশিয়ান কাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। এবারের এএফসি এশিয়ান কাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে বাংলাদেশ রয়েছে গ্রুপ ‘সি’তে। এই গ্রুপে রয়েছে ভারত, হংকং এবং সিঙ্গাপুর। মোট ২৪টি দল বাছাই পর্বে খেলবে। ২৫ মার্চ বাংলাদেশ ভারতের মাটিতে প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হবে। ভারত, হংকং এবং সিঙ্গাপুরকে গ্রুপে পেয়ে বাংলাদেশ খুশি হলেও বাংলাদেশকে চূড়ান্ত পর্বে খেলতে হলে বাংলাদেশকে বিশেষ সক্ষমতা দেখাতে হবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গত বছর মাত্র আটটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। জয় আসে মাত্র দুটিতেÑ ভুটান ও মালদ্বীপের বিপক্ষে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে দেশের মাটিতে ফিলিস্তিনের বিপক্ষেও বাংলাদেশ ১-০ গোলে পরাজিত হয়। এর পর আবার কুয়েতে ফিরতি লীগে ফিলিস্তিনের কাছে ৫-০ গোলে বিধ্বস্ত হতে হয় বাংলাদেশকে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভুটানের কাছে হেরে যাওয়াও ছিল খুবই লজ্জার ব্যাপার। তবে বছরের শেষলগ্নে প্রীতি ম্যাচে দেশের মাটিতে মালদ্বীপের বিপক্ষে জয়টা ছিল খুবই প্রেরণাদায়ক। এদিকে এ বছর দেশের ফুটবলে নতুন এক প্রেরণা তৈরি করতে পারেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের দল লেস্টার সিটিতে খেলা এই ফুটবলারের নতুন বছরে বাংলাদেশে খেলতে দেখা যাবে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট তিনি পেয়েছেন। এ ছাড়া যত ধরনের অনুমতি প্রয়োজন সেসব সম্পন্ন হয়েছে। ইংল্যান্ডে জন্ম ও বেড়ে ওঠা হামজা বাংলাদেশকে কতটা দিতে পারবে সেটাও দেখার বিষয়।

ক্রিকেট, ফুটবলের বাইরে সম্ভাবনাময় খেলা অ্যাথলেটিক্স। বিগত দিনে অ্যাথলেটিক্স ছিল ভীষণ বর্ণিল ও বর্ণময়। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের লড়াইয়ে প্রয়াত শাহ আলম, বিমল, প্রয়াত মাহবুব উজ্জ্বলের নাম। সাফ গেমসে দ্রুততম মানব হয়েছিলেন শাহ আলম ও বিমল। কিন্তু বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের কাছে অধরাÑ সাফ গেমস বা এস গেমসে দ্রুততম মানব হওয়ার বিষয়টি। অ্যাথলেটিক্সের এখন আগের মতো জৌলুস নেই, কোনো আলোচনায়ও নেই। সেই অর্থে নেই কোনো স্বপ্নও। অ্যাথলেটিক্সে তৃতীয়বারের মতো নতুন সাধারণ সম্পাদক হয়ে এসেছেন শাহ আলম। তিনি কিছু স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করেছেন। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত হবে চৌদ্দতম দক্ষিণ এশিয়ান গেমস। মোট সাতটি দেশ অংশগ্রহণ করবে। কী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন তা এখনও কারও কাছে স্পষ্ট নয়।

তবে হকির প্রতি যে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন তা হকির যুবদল প্রমাণ করেছে। হকিতে বাংলাদেশের প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও বিগত সরকারের আমলে বহুবিধ জটিলতার কারণে হকি প্রত্যাশা অনুযায়ী এগোতে পারেনি। প্রথমবারের মতো যুব হকিতে বিশ^কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে হকিতে আমাদের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে সুন্দর পরিকল্পনার মধ্যে আনতে হবে। এ বছরের ডিসেম্বরে ভারতে যুব হকি বিশ^কাপ অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে অংশগ্রহণ করবে বাংলাদেশ। অনেক দিন ধরেই হকির অবস্থা যা-তা। নিয়মিত খেলা হয় না। হকির প্রতি তাই বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।

৫ আগস্টের পর ক্রীড়াঙ্গনে যে নতুন অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। কেননা দলীয়করণ ও রাজনীতিকরণের বাইরে ক্রীড়াঙ্গন যত দৃশ্যমান হবে ততই মঙ্গল হবে। ক্রীড়াঙ্গনে অবশ্যই যোগ্য ও নিবেদিতদের জায়গা করে দিতে হবে। ক্রীড়াঙ্গন থেকে সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে সব ধরনের অপচয়, দলবাজি, আত্মীয়করণ এবং দলীয়করণ। খেলার নামে বিদেশ ভ্রমণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। খেলোয়াড় তৈরিতেই বেশি মনোযোগী হতে হবে।


জাহিদ রহমান : ক্রীড়ালেখক, গবেষক