প্রত্যাশার নতুন আলো

মো. বায়েজিদ সরোয়ার
০১ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
প্রত্যাশার নতুন আলো

নতুন দিনের আভায় পুবের আকাশে উদিত হয়েছে নতুন সূর্য। কুয়াশার চাদর ভেদ করে ছড়িয়ে পড়েছে তার আলো। আজকের সূর্যোদয় নিয়ে এসেছে নুতন বারতা, নতুন আনন্দধারা। বিগত দিনের সব ভুল, হতাশা, দুঃখ, গ্লানি মুছে দিয়ে আজ শুরু হবে নতুন উদ্যমে সফলতার পানে এগিয়ে চলা। আজ ২০২৫ সালের প্রথম সূর্যোদয়। এতে আছে অন্ধকার কেটে আলোর পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।

আজ ২০২৫ সালের প্রথম দিন। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। নতুন বছরটি সবার আনন্দে ও শান্তিতে ভরে উঠুক। নতুন বছর মানেই নতুন প্রত্যাশা। উদ্যম আর সাহস নিয়ে আবার পথচলার শুরু।

২০২৪ ছিল স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির বছর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। ‘৫ আগস্ট ২০২৪ তথা ৩৬ জুলাই’, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব এক বিজয় অর্জন হয়েছে। ছাত্র-জনতার ২৩ দিনের দেশ কাঁপানো আন্দোলনে অবশেষে পতন হলো সাবেক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। ঐদিন শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের মধ্য দিয়ে তার টানা প্রায় ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হয়েছে। এই গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক ছিল নতুন প্রজন্মের সাহসী ছাত্রগণ। দেশের ক্রান্তিলগ্নে সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী অসাধারণ ভূমিকা পালন করে দেশকে চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে। এই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম বাঁক বদলকারী ঘটনা।

এবারের নুতন বছর বাংলাদেশের মানুষের সামনে নুতন চ্যালেঞ্জ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিজয় দিবসে দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে জনমনে যে অনিশ্চয়তা ছিল, তা অনেকটা কেটে যাবে আশা করা যায়।

জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ৬টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে এই সুপারিশগুলো ধরে কীভাবে এগোনো যায়, তারও রূপরেখা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই লক্ষ্যে তার নেতৃত্বে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হবে। এই কমিশনের কাজ হবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো দ্রুত ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া এবং এ ব্যাপারে পরামর্শ চূড়ান্ত করা। বলা যায়Ñ ২০২৫ সাল হলো সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়ে সকল দলের ঐকমত্যে আসার বছর। আশাকরি একটি টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের আত্মত্যাগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দেশে রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে ঐকমত্যে আসতে পারবে। ২০২৫ সালে সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে সেটি হবে বাংলাদেশের আরেকটি বাঁকবদলকারী ঘটনা।

জুলাই মাসের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসানের পর দেশের মানুষ নতুন করে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছে। জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নতুন আশাবাদ জেগেছে। আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, অতীত পেছনে ফেলে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে। দেশ এগিয়ে যাওয়া মানে প্রত্যেক নাগরিকের এগিয়ে যাওয়া। গণতন্ত্রমানে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রত্যেক মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চেতনাময় সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।

বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘দ্যা ইকনোমিস্ট’-এর বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের সেরাদেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অগ্রগতির জন্য প্রকৃত যে কারণে ২০২৪ সালের সেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচিত করা হয়, তা স্বৈরশাসনের পতন নয়, সে পতনের পর যে সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে এবং বাংলাদেশ যেভাবে তার সদ্ব্যবহার করছে তার জন্য গণতন্ত্রায়ন ও সুশাসনের পথে অগ্রসরের যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মানুষ নিয়েছে সেটা রাখতে পারব তো?

ছাত্র-জনতার স্বপ্নের ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর কথা এখন বহুল আলোচিত। এই নতুন বাংলাদেশ হবে- অসাম্প্রদায়িক, সুশাসিত, শোষণহীন, গণতান্ত্রিক, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। এখানে ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচার, দুর্নীতি ও উগ্রপন্থার স্থান থাকবে না। আইনের শাসন, সুশাসন, সরকার ও প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা ও মুক্ত-গণমাধ্যম জনগণের পরম আরাধ্য বিষয়। বাংলাদেশের প্রায় ৯১% মানুষ মুসলমান। ৯৯% মানুষ বাঙালি। একই সঙ্গে রয়েছে প্রায় ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষ। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ হয়ে উঠুক এই সকল মানুষের আকাক্সক্ষা, সকল ধারার স্রোতের, মতের ও ঐতিহ্যের অপরূপ এক সম্মিলনী। নানা বর্ণের অপরূপ ফুলের বাগান। এই মহাযাত্রায় কোনো দল, গোষ্ঠী বা মতের মানুষ যেন বাইরে না থাকে। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এই নতুন বাংলাদেশ গঠনের কাজ আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

রক্তাক্ত একটি অধ্যায় পেরিয়ে ক্রমেই শান্ত হয়ে আসছে বাংলাদেশ। তবে দেশে এখনও স্থবিরতা কাটেনি। দেশ এখনও সংকটমুক্ত হয়নি। এখনও জানা-অজানা কিছু অশুভ শক্তি ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে নসাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তাই সরকার ও সংগ্রামী ছাত্র-জনতাকে রাষ্ট্র পরিচালনা ও সংস্কারে বেশ সাবধানী ও কুশলী হতে হবে। গুজব মেশিন সক্রিয়। এক ধরনের অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। প্রশাসনে এখনও একধরনের শৈথিল্য দৃশ্যমান। এর বাইরে সংখ্যালঘু ইস্যুটি সামনে আনার চেষ্টা করছে কেউ কেউ। ৮ আগস্টে সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরও দেশে-বিদেশে সরকারবিরোধী অপতৎপরতা, ষড়যন্ত্র এখনও থামেনি। সরকার ও জনগণকে এ বিষয়ে এ বছর খুবই সতর্ক থাকতে হবে।

মিডিয়ার প্রপাগান্ডা, বিচ্ছিন্ন নাশকতা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ঢাল বানিয়ে এক ঢিলে বহু পাখি মারা এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক পকেটে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে অস্বীকার করার মতো কাজ এখনও চলমান। বিভিন্ন সংগঠন, গোষ্ঠী দাবি আদায়ের নামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেÑ এমন আলোচনা আছে। তবে সরকার, ছাত্র-জনতা এবং সামাজিক শক্তি একের পর এক এসব ষড়যন্ত্রের পর্দা ছিন্ন করে সফল হয়েছে। ২০২৫ সালেও এসব অপচেষ্টা, ষড়যন্ত্র ও চ্যালেঞ্জের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

জন আকাক্সক্ষার বিপরিত যাত্রাও কয় মাসে দেখা গেছে। ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের কারণে সংখ্যালঘু কিছু মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিছু মন্দির, মাজারসহ কিছু শিল্পকর্ম আক্রান্ত হয়েছে। জোর-জবরদস্তি, ট্যাগিং, মব ভায়োলেন্স ও নারী বিদ্বেষী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মাত্রায়। কিছু উগ্র পন্থার তৎপরতা আছে। চাঁদাবাজি আবার শুরু হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এখনও রোধ করা যায়নি। এতে মানুষের হতাশা বাড়ছে। সরকার অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগতÑ উভয় ধরনের হুমকির সম্মুখীন। ২০২৫ সালে সরকারকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে।

শুধু অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ নয়, ২০২৫ সালের বড় চ্যালেঞ্জ আসতে পারে বাইরে থেকে। গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারতের মিডিয়া ও রাজনীতিবিদদের একাংশ থেকে বাংলাদেশবিরোধী কার্যক্রম চলছে। অন্তত পক্ষে একধরনের ‘ইনফরমেশন ওয়ার’ চলছে। এদিকে দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে আরাকান আর্মি রাখাইনের প্রায় ৯০% অঞ্চল দখল করেছে। বলতে গেলেÑ বাংলাদেশের এক নতুন প্রতিবেশী তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের করণীয় নতুনভাবে ভাবতে হবে।

ফরেন সার্ভিস একাডেমিটি ঢাকার ২২, বেইলি রোডে ‘সুগন্ধা’ নামে পরিচিত ঐতিহাসিক এক ইমারতে অবস্থিত। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এ ঐতিহাসিক বিল্ডিং সবুজ রমনা পার্কের পাশেই অবস্থিত। স্বাধীনতার পর সুগন্ধা গণভবন-প্রধানমন্ত্রীর অফিস হিসেবে ব্যবহার হতো। পাখি ডাকা, অনুপম সবুজ বেষ্টনীর ভেতর এই ভবন। পাশেই রমনা পার্কে নেমেছে সবুজের বসন্ত। এই ভবনটি ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাক্ষী।

গত ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে (কনফারেন্স হলে) এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটল। ভারতের অবন্ধুসুলভ আগ্রাসী কর্মকাণ্ড, দেশে-বিদেশে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রের আলোকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন রজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে এখানে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। শেষ হেমন্তের একটি বিকালে বাগানে ফোটা সুন্দর ফুলগুলোর মতো কমলা আলোয় হেসে উঠল বাংলাদেশ। সকল বিভেদ ভুলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো এক হলো। জাতীয় ঐক্যের এই ডাক ছিল ২০২৪ সালের আরেক মহৎ অর্জন। বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে হবে।

গত ২৯ ডিসেম্বর গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তরুণ বাঙালি সেনা কর্মকর্তাগণ মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে ঐতিহাসিক কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, যা মুক্তিযুদ্ধকে নতুন জীবন দান করেছিল। এখানে পরে একটি মুক্তিযুদ্ধের স্মারক নির্মাণ করা হয়। এর পেছনেই অসাধারণ দৃশ্যের শাপলাবিল। চা বাগানের মাঝে অদ্ভুত প্রাকৃতিক দৃশ্যময় পরিবেশে ফুটে আছে শত শত লাল শাপলা। পৌষের দুপুরে বিলের ধারে দাঁড়িয়ে মনে হলোÑ আমাদের ’৭১-এর শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা যেন লাল শাপলা হয়ে এখানে ফুটে আছেন। তখন স্মরণে এলো ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের বীর শহীদদের কথা। ভাবছিলাম, আমাদের শহীদদের আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ আমরা এবার গড়তে পারব তো? নাকি এবারের বর্ষা-বিপ্লব বা গণ-অভ্যুথানের স্বপ্নগুলো শাপলাবিলের পরিযায়ী পাখির মতো উড়ে যাবে?

২০২৫ নিয়ে আমাদের অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন। কিছু শঙ্কাও রয়েছে। তবু আশাই তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। তুরস্কের বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমত লিখেছেনÑ

‘যে সমুদ্র সবচেয়ে সুন্দর

আমরা আজও তা দেখিনি।

আমাদের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলো

আজও আমরা পাইনি...।’

২০২৫ সাল আমাদের জীবনে প্রার্থিত সুন্দর দিনগুলো বয়ে আনুক। সকল চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে, বাধা পেরিয়ে নতুন এই বছরে এগিয়ে যাক আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রাণের বাংলাদেশ। সবাইকে নতুন বছরের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।


মো. বায়েজিদ সরোয়ার : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক ও বিশ্লেষক