২০২৫ : মানুষের স্বপ্ন কি পূরণ হবে
নতুন বছরটি শুরু হবে অনেক প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে। কেন অনেক প্রত্যাশা কেনই বা নতুন স্বপ্ন দ্যাখা তা সবার জানা আছে। বাংলাদেশের তিপ্পান্ন বছরের যাত্রায় কয়েকবারই সরকারের পতন ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে; কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে এবারের পরিবর্তনের মিল নেই। তিন বার ঘটেছে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে সংবিধান ও রাজনীতি সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে, একবার হয়েছে ছাত্রসংগঠন ও রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত প্রয়াসে। সামরিক হস্তক্ষেপগুলো কিন্তু একইভাবে হয়নি, তিনভাবে হয়েছিল। প্রথমবার পঁচাত্তর সালে বাহিনীর কিছু বিদ্রোহী সদস্য, যারা বিপথগামী হিসেবে পরিচিত হয়েছিল- এক অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা ও তার সরকার উৎখাত করেছিল। তবে তারা সরকার গঠন না করে আওয়ামী লীগেরই বঙ্গবন্ধুর প্রতিদ্বন্দ্বী এক জ্যেষ্ঠ নেতার মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার চালু রাখার চেষ্টা করেছিল। তবে সরকারে, রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং সামরিক বাহিনীতে অস্থিরতা তারা বন্ধ করতে পারেনি। শেষে নভেম্বরের প্রথমে ব্যাপক সহিংসতা ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় আসেন। শুরু হয় ক্ষমতায় থেকে রাজনীতি করা ও রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া।
১৯৮২ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নিয়ে ধীরে ধীরে জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই রাজনীতি শুরু করেন ও নিজের দল গঠন করেন। ১৯৯০ সালে ছাত্রসংগঠন ও রাজনৈতিক দলসমূহের আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নিলে এবং সেনাবাহিনী সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে জেনারেল এরশাদের জন্য পদত্যাগ ভিন্ন উপায় ছিল না। তার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে পুনরায় গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়; কিন্তু ২০০৬ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার লক্ষ্যে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নানা অপতৎপরতা শুরু করলে আবার সেনা হস্তক্ষেপ ঘটে। তবে এবার সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ স্বয়ং ক্ষমতা না নিয়ে একটি বেসামরিক সরকার গঠন করে পেছন থেকে ভূমিকা পালন করেছেন; কিন্তু এতসব ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও যে গণতন্ত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সরকারের ন্যূনতম জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়, তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বরং সর্বশেষ শেখ হাসিনা ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪- এই তিন দফার নির্বাচনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য নিজেই প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠেন। দীর্ঘ পনেরো বছর শাসন কাজের কেন্দ্রে থেকে তিনি হয়ে ওঠেন এক অতিক্ষমতাধর স্বৈরাচার। ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা থেকে কীভাবে একনায়কের উদ্ভব হতে পারে, তিনি হয়ে থাকবেন তার চরম দৃষ্টান্ত। ফলে নানা উন্নয়নমূলক কাজ, দরিদ্রবান্ধব সামাজিক-নিরাপত্তামূলক কাজ বা বিভিন্ন সময়ে কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলেও ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতি, গুম ও বিচারবহির্ভূত খুনসহ ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রশাসনের রাজনীতি ও দলীয়করণ কেবল থামানো যায়নি তা নয়, এসব ঘটেছে পূর্ববর্তী সব সীমারেখা পেরিয়ে। জনধারণা হলো- সরকারপ্রধানের জ্ঞাতসারেই এতসব অনিয়ম ও অপরাধ ঘটেছে।
এ কথা সত্য, আজ বাংলাদেশের অর্ধশত বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধুসহ যে পাঁচজন- শেখ মুজিব, জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা; প্রধানত দেশ শাসন করেছেন (আমরা ফখরুদ্দীন আহমদসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকার-প্রধানদের বাদ রাখলাম) তারা সবাই কম-বেশি একক ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। নিজেদের ব্যক্তিত্বের কারণে যতটা না এমন ঘটেছে তার চেয়ে বেশি হলো আমাদের শাসনব্যবস্থার কারণে। হয়তো সমাজব্যবস্থা এবং সনাতন রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেও এর কারণ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সরকারপ্রধান হিসেবে ক্ষমতা কখনও রাষ্ট্রপতি কখনও প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এভাবে সবাই বিভিন্ন দোসর-মহলসহ সামগ্রিকভাবে একনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। এই ধারা চলতে চলতে আমলাতন্ত্র জনবান্ধব ভূমিকার চেয়ে প্রভুর ভূমিকা পালন করেছে, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়নি এবং সরকার, আমলাতন্ত্র ও ক্ষমতাধর ব্যবসায়ীদের আঁতাত গড়ে ওঠায় জনস্বার্থ চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। মানুষ তাদের মতামত মুক্তভাবে প্রকাশ করতে পারেনি। ভিন্নমত প্রকাশ হলেও যেমন- টক-শোর মাধ্যমে, তা কখনও বিবেচনায় আসার মতো জোরদার হয়নি; বরং সহজেই এসব সমালোচনা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে। তাতে ব্যবসায়ীদের সরকার-ঘনিষ্ঠ একটি গোষ্ঠী ব্যাপক হারে দুর্নীতিতে ডুবে থেকেছে এবং নিজেদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। আরেক দল ক্ষমতাকে ঘিরে রাষ্ট্র ও সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং যুগপৎ নানা অপরাধে জড়িয়েছে, সেই সঙ্গে আর্থিক দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়েছে। বলা বাহুল্য, সর্বশেষ জন শেখ হাসিনা পনেরো বছর ক্ষমতায় থেকে অভূতপূর্ব ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন এবং তারই উপজাত হিসেবে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের পূর্ববর্তী সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন। বলা যায়- বাংলাদেশের শাসকদের পঞ্চাশ বছরের এই ধারা তার সময়ে ও তার নেতৃত্বে চূড়ান্ত ও চরম রূপ পেয়েছে।
ফলে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে পরিচালিত এরকম একটি ব্যবস্থা যে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। প্রকাশ্যে না হলেও বহু মানুষের মনে যে ক্ষোভ ও ক্ষত তৈরি হয়েছিল তা স্পষ্ট। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের ক্যাম্পাসভিত্তিক আধিপত্য ও নিপীড়ন, ছাত্র-অবমাননা, যা ছাত্র-তরুণদের মতাদর্শ-নির্বিশেষে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। এই বিদ্রোহী চেতনা সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। বলা যায়- গণজাগরণ মঞ্চ থেকে এর শুরু। স্কুলছাত্রদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন তাই সহজেই রাষ্ট্র মেরামতের আন্দোলনে রূপ নিতে পেরেছিল। একই ধারাবাহিকতায় জুলাইয়ের কোটাবিরোধী আন্দোলন সরকার পতনের একদফায় পরিণত হয়েছে এবং শেখ হাসিনার মতো দৃশ্যত শক্তিধর এক শাসকের এত দ্রুত আকস্মিক পতন ঘটে গেল। তার শক্তিধর মন্ত্রী, শক্তিমান পার্ষদবর্গ, আমলা, পুলিশ-র্যাব প্রভৃতি বাহিনী, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের পক্ষে তাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ ও অনেক প্রাণহানির পরও শেষরক্ষা করা যায়নি। দেশের সবচেয়ে পুরনো দল, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলকে চরম গ্লানিকর এক পরিণতির সম্মুখীন হতে হলো। তিনি নানাভাবে নিজের এক স্থায়ী শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু জনতার এবং তারুণ্যের শক্তির কাছে সব পরিকল্পনা, অভিসন্ধিই খড়কুটোর মতো উড়ে গেছে। তার দর্প, অন্ধ ক্ষমতার দম্ভ গুঁড়িয়ে গেছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বিগত বছরের এই বিশাল ঘটনা থেকে দেশের শাসনব্যবস্থায় একটা গুণগত পরিবর্তন ঘটবে বলেই জনগণের মধ্যে নতুন বছরের জন্য এত প্রত্যাশা, এত স্বপ্ন। বাংলাদেশের মানুষ সরকারের পতন ও পরিবর্তন অনেক দেখেছে, অনেক নতুনের সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতিও তারা শুনেছে; কিন্তু প্রতিবার তাদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে। এবার এমনটা ঘটুক তা কেউ চাইছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কণ্ঠেও বারবার এই কথাটাই উঠে আসছে- এটা একটা মস্ত সুযোগ এবং তাই প্রাপ্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার যেন করা হয়।
আমাদের দেশের মানুষ যেমন স্বৈরাচার সহ্য করে না, তার পতন ঘটায়; তেমনি আবার পরিবর্তনের ফল চায় দ্রুত, অপেক্ষার দিন দীর্ঘায়িত হলে তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। এটাও সবার মনে রাখতে হবে, বিশেষভাবে পরিবর্তনের সুযোগ তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা যাদের ছিল সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-তরুণদের মনে রাখতে হবে, যে সরকার পতনের আনন্দ ও তাদের ঘিরে পরবর্তী যে উদ্দাম-আবেগের প্রকাশ ঘটেছে, তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। সে কারণেই একটি সৎ-দক্ষ ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার তাগাদা জোরদার হচ্ছে। তবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আমরাও একমত হব যে, অন্তত সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিটি দুটোর প্রস্তাবের ওপর রাজনৈতিক দলের মতামত গ্রহণ করে ও তা চূড়ান্ত রূপ দিয়েই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে জাতীয় নির্বাচনে যাওয়া। এ কাজে যদি গণভোটের প্রয়োজন হয়, তা হলে সে কাজটা নির্বাচনের আগে সম্পন্ন করাই যুক্তিযুক্ত হবে। তবে এসব কাজ আগামী এক বছরের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব বলেই মনে করেন অধিকাংশ বিশ্লেষক।
সংস্কারের কাজে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ যে জরুরি তার কারণ শেষ পর্যন্ত তাদের হাতেই দেশ পরিচালনার ভার দিতে হবে বা তাদেরই সে দায়িত্ব নিতে হবে। এ কথাও ঠিক- সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, পরিবর্তন মানবসমাজ ও মানব সভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য বিষয়। তার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়াই হলো জরুরি। তাই সংশ্লিষ্ট অংশীজনসহ সমগ্র জাতিকেই এ বিষয়ে সচেতন, আন্তরিক এবং দায়িত্বশীল হতে হবে। আমরা সবার কাছ থেকে এই চরম দায়িত্বশীল ভূমিকাই প্রত্যাশা করি। সবার এও মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের সমাজ নানা সমস্যাক্রান্ত এবং নানান জটিলতায় ভারাক্রান্ত। আমরা লক্ষ করি বহু মানুষ এখন কথা বলছেন, সেটা ভালো বিষয়; কিন্তু এর মধ্যে বেশির ভাগের কথাতে অসহিষ্ণুতা, ক্রোধ এবং হিংসার প্রকাশই প্রাধান্য পাচ্ছে। কথা হলো- এসবই হলো মানুষের নেতিবাচক প্রবৃত্তি; কিন্তু অভ্যুত্থানের মূল চেতনা তো ইতিবাচক, এতে যে দায় এবং দরদের কথা উচ্চারিত হয়েছে তাতে মানুষের মানবিক গুণাবলি যেমন- ঔদার্য, পরোপকার, মহত্ত্ব, সহিষ্ণুতা ইত্যাদির প্রতি ইঙ্গিত করে। ফলে অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি ও মাঠের বিভিন্ন শক্তির উচিত-অনুচিত চাপের মুখে নিজেদেরও এক প্রবল শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিহিংসা বা অসহিষ্ণুতার ভাষা যেন প্রাধান্য না পায়, তা বিবেচনায় রাখতে হবে নতুনভাবে জাগ্রত ছাত্র-তরুণদের।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
জনগণের সঙ্গে আমরাও আশা করতে চাই- ২০২৫ সাল হবে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নপূরণের বছর।
আবুল মোমেন : কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!