শিশুশ্রমের বেড়াজালে আটকে থাকা শৈশব
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশে শিশুশ্রম একটি গভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারতের মতো দেশে, যেখানে দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক চাপ প্রকট, সেখানে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। শিশু শ্রমের বেড়াজালে আটকে পড়া এসব শিশুরা হারিয়ে ফেলে তাদের শৈশব, কল্পনা, আনন্দ সবকিছুই। তারা হয় কাজের খাতিরে, নয়তো পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে কঠিন পরিশ্রমে নিযুক্ত থাকে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর।
শিশুশ্রমিকের জীবন কেমন হতে পারে, তার প্রকৃত চিত্র আমরা খুঁজে পাই আমাদের আশপাশের বহু বাস্তবতায়। শিশুদের শৈশব তো হলো খেলার মাঠে হাসিখুশি সময় কাটানো, বন্ধুর সঙ্গে গল্প করা এবং নতুন কিছু শিখে নিজেদের বিকাশের সুযোগ পাওয়া। কিন্তু যখন শিশুরা শ্রমের বেড়াজালে আটকে যায়, তখন তার জীবন হয়ে ওঠে শুধুই কাজের।
শিশুশ্রমিকরা বেশিরভাগ সময়ই কারখানা, মাঠ, দোকান বা রাস্তায় কাজ করে। এ ধরনের কাজে তাদের শরীরিক অবস্থা সঠিকভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। বয়সের তুলনায় তাদের শরীর অনেক আগেই দুর্বল হয়ে পড়ে।
শ্রমের কারণে তাদের পড়াশোনার সুযোগ একদম কমে যায়। এ কারণে শিশুশ্রমিকরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে না, যার ফলে তাদের ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতার জন্য একেবারেই অযোগ্য হয়ে পড়ে।
শিশুশ্রমিকদের ওপর কাজের চাপ, নিগ্রহ এবং অভাবের তাড়না তাদের মানসিকভাবে হতাশ ও বিপথগামী করে তোলে। তারা শৈশবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।
শিশুশ্রমের পেছনে অনেক কারণ কাজ করে, যা শিশুদেরকে এই কঠিন পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়।
অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের কাজের জন্য পাঠায়। কারণ তারা চায় তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি। পরিবারের অভাব-অনটন শিশুদের শ্রমের দিকে ঠেলে দেয়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
পারিবারিক অশান্তি, বাবা-মায়ের অশিক্ষা অথবা একাধিক সন্তান থাকার কারণে অনেক সময় শিশুদের কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ে, কারণ তারা মনে করে যে কাজের মাধ্যমে পরিবারকে সহায়তা করা যাবে।
কিছু সমাজে বিশেষ করে গ্রাম-অঞ্চলে, শিশুদের কাজে লাগানোর একটি প্রচলিত অভ্যাস রয়েছে। এখানে শিশুকে স্কুলে পাঠানো অপেক্ষা কাজে পাঠানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।
শিশুশ্রমে শুধু শারীরিক ক্ষতি নয়, এটি তাদের মানসিক ও সামাজিক জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
শিশুরা যখন ছোটবেলায় কঠোর কাজ করতে শুরু করে, তাদের শরীর আরও উন্নতি করতে পারে না। এতে তারা দীর্ঘদিন শারীরিক অসুস্থতায় ভোগে। যেমন- পিঠ, হাড়ের সমস্যার পাশাপাশি দুর্বল শরীরের কারণে রোগবালাইয়ের শিকার হয়।
শিশুশ্রম শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তারা হতাশাগ্রস্ত, অস্থির ও বিপথগামী হয়ে পড়ে। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে তারা মানসিক নির্যাতন ও শোষণের শিকার হয়।
শিশুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো- তার শৈশব, যেখানে সে কল্পনা, খেলা এবং নতুন কিছু শিখে বেড়ে ওঠে। কিন্তু যখন সে শ্রমের মধ্যে আটকে যায়, তখন তার শৈশব হারিয়ে যায় এবং তা কখনও ফিরে আসে না।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য সরকার, সমাজ এবং পরিবারকেই একযোগে কাজ করতে হবে।
১. আইন ও নীতি : শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কঠোর আইন কার্যকর করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে না। এর জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো।
২. শিক্ষা নিশ্চিতকরণ : শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে প্রথমে তাদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি শিশুর জন্য বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. পারিবারিক সহায়তা : দারিদ্র্য দূরীকরণ ও পারিবারিক সহায়তা বৃদ্ধি করা জরুরি। পরিবারের সদস্যদের আয়ের উৎস বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করা গেলে শিশুশ্রমের প্রবণতা অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
৪. সামাজিক সচেতনতা : শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
খায়রুল আলম রাজু : নির্বাহী সম্পাদক
ছোটোদের পত্রিকা শিশুটামি।
বানিয়াচং, হবিগঞ্জ