পরাজয়ের কোনো স্থান বা সুযোগ নেই
এ রকম কথা বলা হয় যে, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করলে আমরা প্রাদেশিক হয়ে যাব এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব। কথাটা সত্য নয়। বিশ্বে যেসব অগ্রসর জাতি রয়েছে, তারা কেউই মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে অন্যের ভাষায় বিদ্যা চর্চা করে না, অথচ তাদের প্রাদেশিক বা জগৎবিচ্ছিন্ন বলার কোনো উপায়ই নেই। বললেও তা নিতান্ত হাস্যকর শোনাবে। আসল সত্যটা হলোÑ ওই সব জাতি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত, তাই তাদের অতটা উন্নতি ও সম্মান লাভ কিছুতেই সম্ভব হতো না, যদি তারা মাতৃভাষাকে ত্যাগ করে অন্য ভাষার আশ্রয়প্রার্থী হতো। অন্য ভাষার দ্বারস্থ হওয়া স্বাধীনতার চিহ্ন নয়, অধীনতার চিহ্ন বটে। আমরা যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারছি নাÑ সেটা প্রমাণ করে যে, এখনও আমরা পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারিনি, পরাধীনই রয়ে গেছি এবং আমাদের ক্ষমতা নেই যে, নিজের পায়ে দাঁড়াব। নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে অন্যকে আশ্রয় করে চলার চেষ্টা খঞ্জের সাজে, সুস্থ মানুষের জন্য ওটি নিতান্তই অশোভন। অশোভনই বা বলব কেন, ওটি তো সামর্থ্য না থাকারই প্রমাণ। মাতৃভাষাকে ত্যাগ করে অবশ্যই ভীষণভাবে গ্রাম্য হয়ে যাচ্ছি আমরা, আন্তর্জাতিক না হয়ে। আন্তর্জাতিকতার প্রথম কথাটাই হলো নিজের পায়ে দাঁড়ানো; যে পরগাছা তার আবার আন্তর্জাতিকতা কী, সে তো ঝড়ের মুখে উপড়ে পড়বে এবং উড়ে যাবে খড়কুটোর মতো।
মাতৃভাষার যে প্রচলন চাই, সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু কাজটা কীভাবে করা যাবে, বড় প্রশ্ন তো সেটাই। করতে হলে প্রথমে যা দরকার সেটা হলো- রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, বলা যায় অঙ্গীকার। এটা মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরোপুরি ছিল; কিন্তু এখন নেই। ওই অঙ্গীকারটিকে ফেরত আনা চাই। কিন্তু আনা যাবে কী করে? এও তো সেই নটে গাছের কাহিনি। হ্যাঁ, আসল কারণ এই যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত রয়েছে, তারা ওই অঙ্গীকার ভুলে গেছে। ভোলার প্রধান কারণ তারা মনে করে, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি চালু রাখলে তাদের বিদেশমুখো ছেলেমেয়েদের খুব সুবিধা হবে; দ্বিতীয় কারণ, সেটাকে প্রধানও বলা চলে, তাদের ভেতর দেশপ্রেমের নিদারুণ অভাব দেখা দিয়েছে। মাতৃভাষার ব্যবহার না করতে পারাটা প্রমাণ করে যে, মুক্ত হব কী, আমরা এখন পর্যন্ত স্বাধীনই হইনি। বিশ্ব পুঁজিবাদ যে আমাদের ওপর প্রভুত্ব করছে তাতে যেমন প্রমাণ হয় যে আমরা স্বাধীন নই, মাতৃভাষার অপ্রচলনও কিন্তু সেই একই সংবাদ ঘোষণা করছে, ভিন্নভাবে যদিও। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা, সব ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা চাই এবং সেই স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে বিকল্প দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা, যে শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতাকে জনগণের কাছে নিয়ে আসবে। রাষ্ট্র তখন জনগণের হবে এবং জনগণের মাতৃভাষাতে শিক্ষাসহ সব কাজ সম্পন্ন হবে।
এ কাজটা কারা করবেন? করতে হবে দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীদের। তারা শুরু করবেন, শেষ করবেন জনগণ। বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বৈপ্লবিক ঐক্য গড়ে উঠবে, যে ঐক্য নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিকশিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতাকে জনগণের হাতে ফেরত দেবে। কিন্তু এটা তো সময়সাপেক্ষ কাজ। ইতোমধ্যে কী করা যাবে এবং করতে হবে?
করতে হবে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ। এখানেও বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্বটাই হবে প্রধান। অন্যসব কাজের মধ্যে একটি হবে বই লেখা। জ্ঞানের বই এবং বিজ্ঞানের বই চাই, যেমন চাই সাহিত্যের বই। সাহিত্যের বইয়েও দরকার হবে দার্শনিকতা ও ইতিহাস চেতনার, যাতে পৃথিবীটাকে জানতে ও বুঝতে সুবিধা হয়। বই নানা রকমের হয়। কোন বইয়ের কী বিষয় তাও জানা দরকার। অনুবাদ চাই, অন্য ভাষার বই যেমন বাংলায় অনুবাদ হবে, তেমনি বাংলা বইও অনূদিত হবে বিভিন্ন ভাষায়। এই আদান-প্রদানে আমাদের মাতৃভাষা ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
দরকার হবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। কেবল হালকা বইয়ের নয়, গভীর বইয়েরও। সে জন্য একটি গ্রন্থাগার আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এর জন্য কেন্দ্রীয় উদ্যোগ না হলেও চলবে। স্থানীয় উদ্যোগই যথেষ্ট। পাড়ায়-মহল্লায় যে শিক্ষিত ব্যক্তিরা আছেন, তারাই পারেন স্থানীয়ভাবে গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে। ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জেলা পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের অধীনে যেসব ভবন আছে, সেখানে গ্রন্থাগারের জন্য জায়গা চাওয়া যেতে পারে। উদ্বুদ্ধ হলে ব্যক্তিও ছেড়ে দিতে পারেন বাড়ির বাড়তি কোনো ঘর। গ্রন্থাগারকে ভ্রাম্যমাণ হিসেবে বিবেচনা করার উপায় নেই, তাকে অবশ্যই হতে হবে স্থানীয় ও যতটা সম্ভব স্থায়ী। প্রত্যেকটি শিক্ষায়তনে যে গ্রন্থাগার থাকবে, সেটা তো বলাই বাহুল্য। গ্রন্থাগার বিশেষভাবে আকর্ষণ করবে কিশোর-কিশোরীদের, বই যাদের সবচেয়ে উপকারী বন্ধুতে পরিণত হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বই সংগ্রহ করা কঠিন, সংগৃহীত বই সংরক্ষণ করাটাও সহজ নয়; এ ব্যাপারে গ্রন্থাগারের যে ভূমিকা তার কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু কেবল বই কেন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বহুবিধ আয়োজন প্রয়োজন। গান, নাটক, আবৃত্তি, প্রদর্শনী, খেলাধুলা, পত্রিকা প্রকাশ, দেয়াল পত্রিকা তৈরি করা, সব কিছুই চলবে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই উদ্দেশ্যহীন হবে না। পেছনে থাকবে একটি আদর্শ, সেটা হলো দেশপ্রেম ও গণতান্ত্রিকতা তৈরি করা, যাতে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটতে পারে।
রাজনীতিকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে আসছি। রাজনীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনীতি তো গভীর হবে না, যদি না তার অভ্যন্তরে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে। সমাজে আমরা পরিবর্তন চাই, তার জন্যও দরকার সাংস্কৃতিক কাজ। যারা নতুন সমাজ ও পরিবর্তিত রাষ্ট্র গড়তে চান, প্রতিষ্ঠা করতে চান যথার্থ গণতন্ত্র সংস্কৃতিকে তারা কোনোমতেই উপেক্ষা করবেন না। চাই কি প্রতি বছর একটি সাংস্কৃতিক, লংমার্চের আয়োজন করা যেতে পারে। যাতে অংশগ্রহণ করে সংস্কৃতিকর্মীরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হবেন, আদান-প্রদান করবেন অভিজ্ঞতার, উদ্বুদ্ধ করবেন এবং উদ্বুদ্ধ হবেন এবং সমৃদ্ধ হবেন বিভিন্নভাবে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নবজাগরণের জন্য এ ধরনের একটি কর্মসূচির উপযোগিতা রয়েছে। আমরা রেনেসাঁর কথা শুনেছি, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে তেমন একটি ঘটনা ঘটেছিল বলে দাবি করা হয়। তা কিছু একটা অবশ্যই ঘটেছিল; কিন্তু সেটা যথার্থ রেনেসাঁ নয়। পরাধীন দেশে এবং জনগণকে বাইরে রেখে রেনেসাঁ এটা সম্ভব নয় এবং সেটা ঘটেওনি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
কিন্তু ঘটা দরকার। একটি সাংস্কৃতিক মহাজাগরণের জন্য প্রতীক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ। মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষাদানের যে প্রয়োজনীয়তা, সেটি আসবে ওই মহাজাগরণের পথ ধরে এবং তাকে সম্ভব করে তোলার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করার মধ্য দিয়ে।
সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ আমাদের প্রধান লক্ষ্যগুলোর একটি হওয়া দরকার। এটি একটি মস্ত চ্যালেঞ্জ অবশ্যই, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ জয়ের চেয়ে কম নয়, সহজও নয়; কিন্তু এ যুদ্ধেও আমাদের অবশ্যই জয়ী হতে হবে, যদি আমরা মুক্তি চাই।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়