শত্রুকে কখনও অবমূল্যায়ন কর না
১৯৯০ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশনের (পিএলও) তৎকালীন চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, ইসরায়েলের দশ মূল্যমানের ধাতব মুদ্রা আগোরোতে গ্রেটার ইসরায়েলের মানচিত্র আঁকা আছে। তিনি দাবি করেছিলেন, এ থেকে জায়নিস্টদের সম্প্রসারণবাদের প্রমাণ মেলে। বলা বাহুল্য, সে সময় আরাফাতের ওই দাবি নাকচ করে দিয়েছিল ইসরায়েল।
এ ধরনের আরও একটি দাবি ছিল। সেটা ইসরায়েলের পতাকা সম্পর্কিত। ইসরায়েলের পতাকা হচ্ছে সাদা জমিনের মাঝখানে নীল রঙের ছয় বিন্দুর একটি তারকা এবং তারকাটির উপরে ও নিচে দুটো লম্বা ডোরা দাগ। দাবি করা হয়, এই দাগ দুটো হচ্ছে নিল নদ ও ইউফ্রেটিস নদীর প্রতীক; এ দুই নদ-নদীর মধ্যবর্তী ভূমিতে সম্প্রসারণের ইসরায়েলি আকাক্সক্ষাই প্রতিফলিত হচ্ছে ইসরায়েলের পতাকায়। এ দাবিও নাকচ করে দিয়েছিল ইসরায়েল।
আপনি যদি মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নেন, গভীরভাবে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করেন, তাহলে উপরের দাবি দুটো নেহাৎ অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন ইসরায়েল-অধিকৃত সিরিয়ার গোলান মালভূমি চিরকালের জন্য ইসরায়েলের অংশ হয়ে থাকবে। সিরিয়া তার ওই ভূখ- আর কোনোদিন ফেরত পাবে না। আরাফাতের ১৯৯০ সালের বক্তব্য, পাতাকা সম্পর্কিত দাবি এবং এখন নেতানিয়াহুর ঘোষণা সব যদি মিলিয়ে দেখেন তাহলে নিশ্চয় আপনি বিস্মিত হবেন না। বরং আপনার মনে হবে, গ্রেটার ইসরায়েলের তত্ত্ব আদৌ ফাঁকা আওয়াজ নয়; এটি ইসরায়েলের দীর্ঘকালের লালিত স্বপ্ন, যে স্বপ্ন একটু একটু করে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে জায়নবাদীরা।
গ্রেটার ইসরায়েল অর্থ বৃহত্তর ইসরায়েল। মিশরের নিল নদ থেকে ইরাকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত যে আরব ভূমি, সেই ভূমি দখল করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই জায়নবাদীদের লক্ষ্য। এটাকেই তারা বলছে গ্রেটার ইসরায়েল। লক্ষ্যে পৌঁছতে তারা বারবার যুদ্ধ করেছে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে। ইসরায়েলের হাতে মার খেতে খেতে স্বভূমি থেকে প্রায় উৎখাত হয়ে গেছে ফিলিস্তিনিরা। গাজা উপত্যকা আর পশ্চিম তীরে যেসব ফিলিস্তিনি আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে, সেখান থেকেও তারা উৎখাত হয়ে যাওয়ার দশায়। বিশেষ করে গাজা উপত্যকায় পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। সেখান থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিতে তিন মাস ধরে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গাজায় অধিকাংশ বাড়ি-অফিস-এবাদতখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছে ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ, এর তিন ভাগের এক ভাগই শিশু। আরেক প্রান্তে পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি একই রকম না হলেও মাঝে মাঝে হামলা হচ্ছে, হানা দেওয়া ও ধরপাকড় চলছে, ফিলিস্তিনিদের জলপাই বাগানসহ ঘরবাড়ি দখল করে ইহুদিরা বসতি স্থাপন করছে। একই সঙ্গে লেবানন ফ্রন্টে হিজবুল্লাহ্-এর সঙ্গে যুদ্ধ করছিল ইসরায়েল, যা এখন কিছুটা স্তিমিত; ইয়েমেনেও হামলা চালিয়েছে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাব দিতে। এসবেরই মধ্যে ঘটে গেছে সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করে সশস্ত্র গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখলের ঘটনা, যার সঙ্গে ইসরায়েলের জড়িত থাকার খবর প্রকাশ করেছে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম। এ
সব সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে সিরিয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখলের ঘটনা ইসরায়েলের জন্য বিজয়। এটি গ্রেটার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পথে আরও এক ধাপ অগ্রগতি। আপনারও তো সেটাই মনে হবে, বিশেষ করে নেতানিয়াহু যখন বলেন মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলে দেবেন তিনি। তার কথা উড়িয়ে দেওয়া বা অবহেলা করা নেহাৎ বোকামি। কারণ ফিলিস্তিন ভূখ-ে যেদিন বহিরাগত শরণার্থী ইহুদিরা নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেদিনই তো বদলে গিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র। স্থানীয় আরবরা ফিলিস্তিনকে দখলমুক্ত করার জন্য প্রথমবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল; কিন্তু যেখানে গিয়ে থামা উচিত ছিল সেখানে পৌঁছানোর আগেই তারা থেমে গিয়েছিল। সুতরাং ফসকে গিয়েছিল নিশ্চিত জয়। তার খেসারত দিয়েছে ফিলিস্তিনিরা, তাদের দেশের পুরোটাই এখন ইসরায়েলের দখলে। এমন অবস্থায় গ্রেটার ইসরায়েল যে ফিকশন নয়, ফ্যাক্ট; তা বুঝতে আপনার আইনস্টাইন হওয়ার দরকার নেই।
সিরিয়া এখন ইসরায়েলের মদদপুষ্ট গোষ্ঠীর কবজায় চলে যাওয়ায় গ্রেটার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পালে জোরাল বাতাস লেগেছে। মাস তিনেক আগে জাতিসংঘে একটি মানচিত্র প্রদর্শন করেছিলেন নেতানিয়াহু, সেই মানচিত্রে লেবানন, সিরিয়া ও ইরাককে দেখানো হয়েছিল অভিশপ্ত হিসেবে, যে অভিশাপ কেটে যাবে ওই দেশগুলো ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের অঙ্গীভূত হয়ে গেলে। আপনি একবার ভেবে দেখুন, এতেও কি প্রতিফলিত হচ্ছে না জায়নবাদীদের সম্প্রসারণবাদী আকাক্সক্ষা?
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এই গ্রেটার ইসরায়েলের কনসেপ্ট শুধু নয়া-ঔপনিবেশিকতা থেকে আসেনি; এটি এসেছে প্রাচীন ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তোরাহ্ থেকে। সেখানে বলা হয়েছে ইউফ্রেটিস থেকে নিল পর্যন্ত বিস্তৃত ভূমি হচ্ছে ইহুদিদের জন্য ঈশ^রের প্রতিশ্রুত ভূমি। আপনি এ কথার বিশ্লেষণ করলে দেখবেন, এ যুগের ইসরায়েল ছাড়াও লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাক এই ভূমির অন্তর্ভুক্ত; গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরের কথা তো বলাই বাহুল্য। ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের যুদ্ধে সিরিয়ার গোলান মালভূমি, জর্ডানের পশ্চিম তীর ও মিশরের সিনাই দখল করে নেয় ইসরায়েল। সে সময় গ্রেটার ইসরায়েল আন্দোলন গড়ে ওঠে ইসরায়েলে। দখলকৃত ভূখ- ফেরত না দিয়ে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনের দাবি জানানো হয়েছিল আন্দোলনের পক্ষে। সম্প্রতি ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জেরুসালেমের ভবিষ্যৎ হচ্ছে দামেস্ক পর্যন্ত সম্প্রসারণ। গত সেপ্টেম্বরে জেরুসালেম পোস্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেটির শিরোনাম ছিল ‘লেবানন কি ইসরায়েলের প্রতিশ্রুত ভূমির অংশ?’ এতেও প্রকাশ পায় জায়নবাদী সম্প্রসারণবাদের লক্ষ্য।
ইসরায়েল মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত, ইসরায়েল হিংস্র এবং রক্তপিপাসু। তার বিরুদ্ধ প্রতিরোধ-বলয় এ মুহূর্তে নাস্তানাবুদ; এর অনেক কারণের মধ্যে রয়েছে পলিসিগত কারণ। আপনি জানতে চাইতে পারেন, সেটা কী? সেটা হতে পারে, ইসরায়েল যে পলিসিতে চলে সেই পলিসি আত্মস্থ করে সেই পলিসিই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা। প্রতিরোধ-বলয়ের বিদ্যমান পলিসি গ্রেটার ইসরায়েলকে রুখতে পারবে না। এখানে ইসরায়েলের কাছ থেকে শেখার আছে তার বিরুদ্ধ-শক্তির। সিরিয়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো প্রচুর অস্ত্র জমা করে রেখেছিল; কখনও প্রয়োগ করেনি। ইসরায়েল এ মাসের প্রথমার্ধে ব্যাপক হামলা চালিয়ে সেসব অস্ত্র ধ্বংস করেছে এবং সিরিয়ার সামরিক মেরুদ- ভেঙে দিয়েছে। সিরিয়া কি ভেবেছিল হাতে অস্ত্র জমা রেখে ইসরায়েলকে রোখা যাবে? জ্ঞানীদের উপদেশ, শত্রুকে কখনও অবহেলা করতে নেই। জায়নবাদীদের গ্রেটার ইসরায়েলের ধারণাকে অবহেলা করলে ভবিষ্যতে সর্বনাশা খেসারত দিতে হবে।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২
প্রমিত হোসেন : গল্পকার, ঔপন্যাসিক, বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদক; আমাদের সময়-এর সহযোগী সম্পাদক