বড়দিন : পৃথিবীতে শান্তিদাতা যিশুর আগমন

অগাস্টিন সুজন
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বড়দিন : পৃথিবীতে শান্তিদাতা যিশুর আগমন

বড়দিন বা ক্রিসমাস। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। ত্রাণকর্তা ও মুক্তিদাতা যিশু খ্রিস্টের জন্মোৎসব। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখ বড়দিন বা ক্রিসমাস পালন করা হয়। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বড়দিনের আনন্দে মেতে ওঠেন।

বর্তমানে বিশ^জুড়ে বড়দিন পালন করা হয় মহাআড়ম্বরে। এ উৎসবের ছবি-ভিডিও গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয়। ফলে খ্রিস্টধর্মের পাশাপাশি সকল ধর্মের ও বর্ণের মানুষের মাঝে বড়দিনের উৎসবের আবহ সহজেই ছড়িয়ে পড়ে।

খ্রিস্টধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী যিশু হলেন শান্তিদাতা। তিনি মানুষকে তাদের পাপ থেকে পরিত্রাণ করেন। জগতে শান্তি নিয়ে আসেন। সেজন্য যিশুকে ত্রাণকর্তা ও মুক্তিদাতা হিসেবেও সম্বোধন করা হয়।

বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী যিশুর জন্ম হয়েছিল যিহুদিয়ার বৈৎলেহম নগরে। যিশুর পিতা যোসেফ ছিলেন গালিলের নাসরৎ নগরের একজন কাঠমিস্ত্রি। তার সঙ্গে বাগদান হয়েছিল মরিয়ম নামের এক কুমারী মেয়ের; কিন্তু তারা একসঙ্গে বসবাস করার আগেই জানা গেলো মরিয়ম গর্ভবতী হয়েছেন, পবিত্র আত্মার প্রভাবে। যোসেফ ধার্মিক ছিলেন। তাই তিনি মরিয়মের নিন্দা হওয়ার ভয়ে গোপনে তাকে ত্যাগ করার কথা ভাবছিলেন। তখন এক স্বর্গদূত তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে জানালেন মরিয়ম সন্তান ধারণ করেছেন পবিত্র আত্মার প্রভাবে। আর যে সন্তান জন্ম নেবে তার নাম যিশু অর্থাৎ ত্রাণকর্তা রাখবে। কারণ এই সন্তানই মানুষকে পাপ থেকে পরিত্রাণ বা মুক্ত করবেন।

স্বর্গদূতের কথা শুনে যোসেফ মরিয়মকে তার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলেন; কিন্তু যিশুর জন্ম না হওয়া পর্যন্ত তারা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে মিলিত হওয়া থেকে বিরত থাকলেন।

যিশুর জন্মের বিষয়ে বাইবেলে লেখা আছে সেই সময়ে নাম লেখানোর (আদমশুমারি) আদেশ জারি হলে যোসেফ তার স্ত্রী মরিয়মকে নিয়ে গালিলের নাসরৎ থেকে যিহুদিয়ার বৈৎলেহম নগরে গেলেন। কারণ যোসেফ ছিলেন দায়ুদের বংশধর। তবে তাদের থাকার মতো কোনো ভালো জায়গা না মেলায় একটি গোয়ালঘরে আশ্রয় নেন। বৈৎলেহমে থাকতেই মরিয়মের সন্তান জন্মের সময় হয়ে যায়। আর তিনি একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। স্বর্গদূতের কথা অনুযায়ী যোসেফ শিশুটির নাম রাখেন যিশু।

যিশুর জন্মের সময় বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটে। সেই সময়ে ওই এলাকায় মাঠে মেষপালকেরা মেষ বা ভেড়া পাহাড়া দিচ্ছিল। তখন এক স্বর্গদূত তাদের কাছে উপস্থিত হন, যা দেখে মেষপালকরা ভয় পেয়ে যান।

পবিত্র বাইবেলের লুক লিখিত সুসমাচারের ২য় অধ্যায়ের ১০ এবং ১১ পদে এই কথা লেখা আছে তখন স্বর্গদূত তাদের বললেন, ভয় পেয়ো না। কারণ আমি তোমাদের জন্য এক মহা আনন্দের সুসমাচার নিয়ে এসেছি। সেই আনন্দ সমগ্র মানবজাতির হবে। আজ দায়ুদের নগরে তোমাদের জন্য একজন ত্রাণকর্তা জন্মিয়াছেন। তিনি খ্রিস্ট প্রভু। তোমরা তাকে কাপড়ে জড়ানো ও যাবপাত্রে শোয়ানো দেখতে পাবে।

সেই স্বর্গদূতের সঙ্গে পরে আরও অনেক স্বর্গদূত যোগ দেন এবং তারা সবাই ঈশ^রের মহিমা-গান করতে থাকেন। তারা চলে গেলে পর মেষপালক বা রাখালগণ বৈৎলেহমে যান এবং যিশুকে তার মা মরিয়ম ও বাবা যোসেফের সঙ্গে গোয়ালঘরে দেখতে পান।

বাইবেলের মথি লিখিত সুসমাচারে উল্লেখ আছে যিশুর জন্মের সময়ে আকাশে নতুন এক তারা দেখা যায়। সেটি দেখে কয়েক প-িত ব্যক্তি বুঝতে পারেন একজন মহান মানুষের জন্ম হয়েছে। তারাও যিশুকে খুঁজতে বের হন এবং সেই তারাটি তাদের পথ দেখিয়ে যিশুর কাছে নিয়ে যায়।

বড়দিনে যিশুর জন্মের এই ঘটনাগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। বিশেষ করে চার্চের উপাসনা, খ্রিস্টধর্মীয় সভা ও কীর্তন-গানের মাধ্যমে যিশুর জন্মের সময়কার ঘটনাগুলো নিয়ে বিশেষ প্রচার করা হয়।

খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে যিশু ত্রাণকর্তা বা মুক্তিদাতা। তাদের বিশ^াস যিশু পৃথিবীর সকল মানুষের মুক্তির জন্য আগমন করেছেন। তাই যিশুর জন্ম একটি মহা আনন্দের সংবাদ। এই আনন্দ উৎযাপনে বড়দিন বর্তমানে ব্যাপক আকার পেয়েছে। বাইবেলের বর্ণনার সঙ্গে মিল রেখে ধর্মীয় অনুসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন দেশের রীতি ও সংস্কৃতি। ক্রিসমাস ট্রি সাজানো, ঘর এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আলোকসজ্জা, নতুন পোশাক পরিধান, উপহার আদান-প্রদান, ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন সব মিলিয়ে বড়দিন একটি সর্বজনীন উৎসবের রূপ পেয়েছে।

কর্মব্যস্ত সময়ে প্রি-ক্রিসমাস বা প্রাক-বড়দিন উৎযাপন বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ২৫ ডিসেম্বরের আগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি-উদ্যোগে প্রাক-বড়দিন উৎযাপন করা হচ্ছে। তাই বলা যায় বড়দিনের আবহ ও উৎসব বিশ্বজুড়ে ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই চলতে থাকে, যা চূড়ান্ত রূপ পায় ২৫ ডিসেম্বর এবং শেষ হয় নতুন বছর বা থার্টি ফাস্ট নাইটে গিয়ে।

বড়দিন উদযাপনের এই আনন্দময় ক্ষণে আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন, যিশুর জন্মের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মুক্তি ও কল্যাণ সাধন। তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন শান্তির বার্তা নিয়ে। তার জন্ম তাই সকল মানুষের কাছে এক মহা আনন্দের সংবাদ। কারণ তিনিই সেই মুক্তিদাতা, যিনি সব মানুষের পাপ নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সকলের জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন।

যে স্বর্গদূতগণ রাখালদের কাছে যিশুর জন্মের সংবাদ নিয়ে এসেছিলেন তারা এই বলে ঈশ্বরের স্তবগান করেছিলেনÑ ‘ঊর্ধলোকে ঈশ্বরের মহিমা, পৃথিবীতে তাঁর প্রীতিপাত্র মানুষদের মধ্যে শান্তি’।

যিশুর জন্মোৎসব উদযাপনের মাঝে এই বার্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়–ক পৃথিবীতে এক শান্তিদাতা ও মুক্তিদাতার আগমন হয়েছে। তিনি আমাদেরকে সকল পাপ থেকে মুক্ত করে নতুন জীবন দান করেন। এই শান্তিদাতা ও মুক্তিদাতার কাছে আমরা নিজেদের সপে দেই। তাঁর দেখানো পথে জীবনযাপন করি।

যিশু খ্রিস্টের প্রদত্ত শান্তি সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়–ক। পৃথিবী হয়ে উঠুক সকল প্রকার অন্যায়মুক্ত ভেদাভেদহীন এক শান্তিময় স্থান।

সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা। শুভ বড়দিন।


অগাস্টিন সুজন : প্রাবন্ধিক