স্বাস্থ্য খাতে পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে করণীয়

ডা. মো. ছায়েদুল হক
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
স্বাস্থ্য খাতে পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে করণীয়

শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার প্রাথমিক শর্ত হলো স্বাস্থ্যসেবা। একটা জাতির স্বাস্থ্যব্যবস্থাই বলে দেয় সে জাতি কতটুকু উন্নত। স্বাস্থ্য খাতে দুটি উল্লেখযোগ্য ধারা বিদ্যমান। একটি হলো কেউ যাতে অসুস্থ না হয়ে পড়েন অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ। আর যদি অসুস্থতা প্রতিরোধ করা না যায় অর্থাৎ কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন তবে চিকিৎসার সাহায্য নিয়ে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করবেন। একজন ব্যক্তির সুস্থতা দুটি কারণে প্রয়োজন একটি হলো স্বাচ্ছন্দ্যে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা এবং দ্বিতীয়টি হলো জীবিকা অর্জনের জন্য নিজের সক্ষমতাকে প্রয়োগ করা। একজন অসুস্থ ব্যক্তি যদি জীবিকা অর্জনে অক্ষম হয়ে পড়েন তবে তিনি পরমুখাপেক্ষী হয়ে পড়বেন। এমতাবস্থায় তিনি নিজে সমাজে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না। ফলে সমাজের উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হবে। প্রাকৃতিক নিয়মেই মানুষ শিশু অবস্থায় এবং বার্ধক্যের একটি নির্দিষ্ট সময় পরমুখাপেক্ষী থাকেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এদের জীবিকার ভার বহন করতে হয় যারা কর্মক্ষম মধ্যবয়সী। যত দিন যাচ্ছে শিশু মৃত্যুহার কমে এবং গড় আয়ু বাড়ার ফলে সক্ষম জনসংখ্যার তুলনায় অক্ষম জনসংখ্যা বাড়ছে। ফলে উৎপাদনশীলতার ওপর এক ধরনে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। অসুস্থ মানুষের সৃজনশীলতাও ব্যাহত হয়। ফলে অসুস্থতা ব্যক্তির জীবনযাপনে যেমন অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করে, তেমনই সমাজেও এর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়; এটি কাম্য নয়। ফলে একটি সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনের পূর্বশর্ত একটি সুস্থ জাতি। সুস্থ জাতির পূর্বশর্ত হলো একটি স্বনির্ভর স্বাস্থ্য খাত।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে জনতুষ্টির চেয়ে অসন্তুষ্টিই বেশি। সমাজে বিরাগভাজন ব্যক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও নেহায়েত কমও নয়। স্বাস্থ্য খাতে আস্থার সংকট আছে। এটিকে অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। যদিও স্বাধীনতা-উত্তরকালে চিকিৎসাসেবা যেখানে ছিল সেখান থেকে আমরা বহুদূর এগিয়ে এসেছি। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা দ্রুতগতিতে বিকশ হয়েছে। সেই তুলনায় বাংলাদেশ তার সক্ষমতাকে এগিয়ে নিতে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল নিকট অতীতে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি বিনিয়োগে দ্রুত পাল্টে যায় আমাদের স্বাস্থ্য খাত। বিশেষায়িত চিকিৎসায় দেশ দ্রুত উন্নতিলাভ করতে থাকে। স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন শাখা-উপশাখা দ্রুত বিকশ হতে থাকে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চাহিদা মেটাতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর মেডিক্যাল কলেজ গড়ে উঠতে থাকে। বর্তমানে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ থেকে এসে বিপুল ছাত্রছাত্রী এদেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করছে। দূরারোগ্য ক্যানসার চিকিৎসা, কার্ডিয়াক সার্জারি, কিডনি প্রতিস্থাপন, চোখের অত্যাধুনিক ছানি ও ভিট্রিওরেটিনার চিকিৎসাসহ প্রচুর চিকিৎসা এখন দেশেই সম্ভব হচ্ছে। এসব চিকিৎসা ২৫-৩০ বছর আগে বাংলাদেশে তেমন একটা হতো না। চিকিৎসা খাতে এগুলো আমাদের ঈর্ষণীয় অর্জন। এগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। অথচ বেশিরভাগ সময়ে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সাধারণের মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতা দেখা যায়, যেটি মোটেও কাম্য নয়।

স্বাস্থ্য খাত নিয়ে হীনমন্যতার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয়কে আলোচনায় রাখা যেতে পারে। অসন্তুষ্টি যে আছে, সেটি বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীর মিছিল দেখলেই অনুমান করা যায়। এর জন্য চিকিৎসা খাত দায়ীÑ এটি মেনে নেওয়া যায়। রোগীরা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায় তার কারণ কেবল অপ্রতুল চিকিৎসা তা নয়। অপ্রতুল চিকিৎসার পাশাপাশি দেশে চিকিৎসাব্যয় তুলনামূলক বেশি। ১৮ কোটি লোকের চিকিৎসা প্রদানে আমাদের ক্যাপাসিটি বা সক্ষমতার ঘাটতি আছে। বিশেষ করে বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপনা বা হাসপাতালের সংখ্যা এবং দক্ষজনবল অপ্রতুল। চিকিৎসাব্যয় সাশ্রয়ী না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ বা বাজেট স্বল্পতা। একই সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অতি মুনাফালোভী দৃষ্টিভঙ্গিও অনেকাংশে দায়ী। দেশে স্বাস্থ্য খাতে অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মেডিক্যাল ট্যুরিজমের প্রভাবকে কিছুটা দায়ী করা যায়। বিশ্বব্যাপী মেডিক্যাল ট্যুরিজম বা বিদেশিদের জন্য চিকিসাসেবা একটি নতুন শিল্প। অনেক দেশেরই রাজস্ব আহরণের একটি উল্লেখযোগ্য খাত হলো এই মেডিক্যাল ট্যুরিজম। বর্তমানে দ্রুত বিকাশমান এই খাতে প্রচুর বিনিয়োগ এবং একই সঙ্গে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের প্রচার বিদ্যমান। মেডিক্যাল ট্যুরিজম বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পেছনে প্রধানত দুটি বিষয় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে- একটি হলো উন্নততর চিকিৎসাপ্রাপ্তি এবং দ্বিতীয়টি হলো সাশ্রয়ী ব্যয়ে চিকিৎসা। মেডিক্যল ট্যুরিজমে বিশ্বে যে কয়টি দেশ উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি অর্জন করেছে তার মধ্যে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং ভারত অন্যতম। পার্শবর্তী দেশগুলোর মেডিক্যাল ট্যুরিজমের প্রভাব আমাদের স্বাস্থ্যসেবার ওপর পড়ছে। ফলে এখানকার সাধারণের কাছে স্বাস্থ্যসেবার একটি তুলনামূলক চেহারা খুব সহজেই প্রতিভাত হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে কোনো দোষ খোঁজার কিছু নেই। এগুলো বাস্তবতা। তবে এখানে একটি ন্যায্যতার প্রশ্ন থাকে, যেটি দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। মেডিক্যোল ট্যুরিজমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো প্রেতিবেশী দেশগুলো থেকে রোগীদের আগ্রহী করে তুলতে বিশেষ প্রচার ও অনেক সময় প্রণোদনার ব্যবস্থা করে থাকে। তারা সরকারি যন্ত্র, মিডিয়া এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ওপর এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করে একটি বিশেষ আনুগত্যশীল শ্রেণি তৈরি করতে সচেষ্ট থাকে। এই আনুগত্যশীল গোষ্ঠীর একটি বড় অংশই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যারা আগে ওই দেশগুলোতে ট্রেনিং, কনফারেন্স, বিভিন্ন ধরনের অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি গ্রহণ করেছেন। এদের অনেকেই অনেকটা স্থানীয় এজন্টের মতো কাজ করেন। তারা প্রচার করে থাকেন- তাদের সেবা সবার সেড়া। সেটি অনেক ক্ষেত্রে কেবলই মিথ্যা প্রচারণা। মেডিক্যাল ট্যুরিজমের এই প্রতারণা নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগ আছে। এর সমাধানে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছেÑ এগুলোই বাস্তবতা। আমাদের সমস্যা হচ্ছেÑ প্রতিবেশী একটি দেশ স্বাস্থ্যসেবাকে পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে একীভূত করে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তারা প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রকে, বিশেষ করে বাংলাদেশকে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের রাজস্ব আয়ের চেতনার বাইরে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, যাতে দেশটি পরনির্ভরশীল হওয়ায় একধাপ এগিয়ে থাকে। এ কাজে প্রতিবেশী দেশটির সরকার এবং রাষ্ট্রÑ দুটিই জড়িয়ে গেছে। এর প্রভাব বিগত পতিত সরকার এবং তাদের দোষরদের মাঝে স্পষ্ট প্রতীয়মান ছিল।

জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র-ক্ষমতার আমূল পরিবর্তনে প্রতিবেশী দেশটি যখন বাংলাদেশের সঙ্গে নজিরবিহীন কূটনৈতিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ল, তখন সংগত কারণেই স্বাস্থ্য খাতও এর বাইরে থাকল না। প্রতিবছর দেশটি মেডিক্যাল ট্যুরিজম বাবদ আনুমানিক ৫০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে থাকে। এই বিশাল রাজস্ব হারানোর মাঝেও তারা বাংলাদেশকে কেবল কূটনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করার মানসেই ভিসাপ্রাপ্তি সংকোচিত করে চিকিৎসা প্রদানের কাজটিকে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি হলোÑ প্রতিবছর বিশাল আকারের রাজস্ব হারানো এবং পরনির্ভরশীলতা। পাগলেও নাকি নিজের স্বার্থ বোঝে। পতিত সরকারের সময়ে আমরা কী বুঝলাম মাথায় ঢুকছে না। আমাদের এখান থেকে অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে।

অনেকেই ভ্রূ কোঁচকাতে পারেন। আমাদের কি সেই সক্ষমতা আছে? বিনীতভাবে বলি- আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে হেয় করে দেখার চেষ্টা না করে নির্মোহভাবে একবার ভেবে দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি। স্বাস্থ্য খাত দ্রুত বিকাশমান হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি খাতে গুণগত মানের ঘাটতি থেকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এটি এক ধরনের বাস্তবতা। এ দুর্বলতাগুলো সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। বিগত সরকারের সময় স্বাস্থ্য খাতকে প্রতিবেশীদের হাতে তুলে দিতেই এক ধরনের পরিকল্পনামাফিক অবহেলা করা হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবাকে সহজ ও সাশ্রয়ী করা, বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে যোগ্য বিশেষজ্ঞের পদায়ন করা ইত্যাদি বিষয়ে ন্যক্কারজনকভাবে অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে। ফলে দলীয়করণের প্রভাবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এক ধরনের নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিপুল সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে পদোন্নতিবঞ্চিত করে তাদের সার্ভিস থেকে জাতিকে বঞ্চিত করা হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলোকে যথাযথ তদারকি না করে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার পরিধি বাড়লেও চিকিৎসাব্যায় আকাশচুম্বী হতে সাহায্য করেছে। সার্বিকভাবে লাভবান হয়েছে প্রতিবেশী দেশটি।

বর্তমানে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ নতুন করে জেগে উঠেছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক বোঝাপড়ায় লিপ্ত অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের আপামর জনসাধারণের আকাক্সক্ষা স্বাস্থ্য খাতে পরনির্ভরশীলতা পরিহার করা। আমরাও চাই বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে তার দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠুক। আর এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন দক্ষ জনবলকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা, সরকারের বিনিয়োগ বা বাজেট বৃদ্ধি করে চিকিৎসাব্যয় সাশ্রয়ী করা, বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলোকে দায়বদ্ধ করা এবং সর্বোপরি সকল ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যব্য বস্থাপনাকে আধুনিকায়ন ও সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে ঢেলে সাজানো। সম্ভব হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি স্বতন্ত্র স্বাস্থ্য কমিশন প্রবর্তন করা যেতে পারে।


ডা. মো. ছায়েদুল হক : চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন

এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক