বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের গতি-প্রকৃতি

মাহফুজুর রহমান
২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের গতি-প্রকৃতি

প্রাচীনকালের বিনিময় প্রথা পেরিয়ে মানুষ যখন বিনিময়ের জন্য কোনো কিছুকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা শিখল, তখন পাক-ভারত উপমহাদেশে সামুদ্রিক কড়িকে টাকা হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হলো। প্রশান্ত মহাসাগরের ইয়াপ দ্বীপে পাথরের চাকা হয়ে গেল টাকা। লবণ, পাখির পালক, মানুষের মাথার খুলি থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুই হলো বিনিময়ের মাধ্যম। এর পর তুরস্কের লিডিয়া নামক দ্বীপ থেকে মুদ্রা এবং চীন থেকে শুরু হলো কাগুজে টাকার প্রচলন। এভাবে চলছিল ভালোই; কিন্তু ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ঘটল এক বিপত্তি। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ফ্রাঙ্ক ম্যাকনামারা একটি রেস্টুরেন্টে নৈশভোজ সেরে বিল পরিশোধ করতে গিয়ে বুঝতে পারেন যে, ভুলবশত তিনি মানিব্যাগটি আনেননি। অগত্যা স্ত্রীকে ফোন করে টাকা আনিয়ে রেস্টুরেন্টের বিল পরিশোধ করতে হয়েছিল তাকে। সে থেকেই তার মাথায় ঢুকে গেল একটি প্রশ্নÑ পকেটে করে নগদ টাকা বহন না করেও কেনাকাটা করা যাবে কীভাবে? এই প্রশ্নেরই জবাব হচ্ছে ক্রেডিট কার্ড। অবশ্য কার্ড দিয়ে অর্থ পরিশোধের ধারণাটি পৃথিবীতে সর্বপ্রথম জনসমক্ষে আনেন মার্কিন লেখক অ্যাডওয়ার্ড বেল্যামি; তিনি তার কল্পকাহিনিভিত্তিক উপন্যাস ‘লুকিং ব্যাকওয়ার্ড’-এ ক্রেডিট কার্ড কথাটি ১১বার ব্যবহার করেছেন।

ফ্রাঙ্ক ম্যাকনামারার নেতৃত্বে বিশে^ প্রথম কার্ডের প্রচলন করা হয় ১৯৫০ সালে। সহযোগী রালফ স্নেইডারকে নিয়ে ম্যাকনামারা গড়ে তোলেন ‘দ্য ডাইনার্স ক্লাব’। প্রথমেই ২০০ জনকে ক্লাবের সদস্য করা হয়। চুক্তিবদ্ধ ২৭টি রেস্টুরেন্টে এর সদস্যগণ নগদ টাকা ছাড়াই খাওয়া-দাওয়া করতে পারতেন। বিলের বিপরীতে তাদের কেবল একটি স্বাক্ষর দিতে হতো। এভাবে শুরু হয়ে ক্রেডিট কার্ড এখন বিশে^র সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিপুল জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলাদেশসহ অনেক দেশই এখন ক্যাশলেস ইকনোমি তৈরি করার কথা ভাবছে।

বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্রেডিট কার্ডের প্রচলন হয় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের উদ্যোগে। প্রথমাবস্থায় ব্যবসায়ীগণ ক্রেডিট কার্ডের ওপর বিশ^াস স্থাপন করে পণ্য বিক্রি করতে চাইতেন না। দিনে দিনে এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তবে এখনও বাংলাদেশের বহু শহরে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার শুরু হয়েছে বলে মনে হয় না। অর্থাৎÑ এদেশে ক্রেডিট কার্ডের বিপুল সম্ভাবনা এখনও বিদ্যমান।

বাংলাদেশের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কার্ড ব্যবহার করেন দেশের বাইরে। বর্তমানে এক বাংলাদেশি বিদেশ ভ্রমণকালে এক পঞ্জিকাবর্ষে ১২ হাজার মার্কিন ডলার বা এর সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে পারেন। এই অর্থ তিনি এক বা একাধিক ভ্রমণে এবং এক বা একাধিক দেশে খরচ করতে পারেন। দেশে নগদ বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কম থাকায় ব্যাংকগুলো চাহিদা পূরণ করতে পারে না। ফলে বিদেশগামী যাত্রীদের চাহিদা পূরণের জন্য খোলাবাজারের দিকে হাত বাড়াতে হয়। সেখানেও ডলার-সংকটের কারণে দর থাকে আকাশচুম্বী। তখন বিদেশযাত্রীগণ কিছু পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নগদে কিনে চাহিদার বাকি অংশ পূরণের জন্য ক্রেডিট কার্ডের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার দাম খোলাবাজারের চেয়ে কম পড়ে।

বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত। ভ্রমণ, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ, ব্যবসাসহ নানাবিধ প্রয়োজনেই বাংলাদেশের মানুষ ভারত যেতেন। এক্ষেত্রে মানুষ নগদ বৈদেশিক মুদ্রা, ক্রেডিট কার্ড, বাংলাদেশি মুদ্রা বহন করে বা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে ভারত ভ্রমণকালে তাদের আর্থিক চাহিদা পূরণ করতেন। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় এবং কলকাতার নির্ধারিত কতগুলো স্থানে মানিচেঞ্জারগণ বাংলাদেশি টাকার বদলে ভারতীয় মুদ্রা প্রদান করতেন। আবার হুন্ডি ব্যবসায়ীগণ তাদের দেওয়া চিরকুট বা একটি দশ টাকার নোটের নম্বর ভারতে পাঠিয়ে সেই নম্বরের নোটের উপস্থাপককে নির্দিষ্ট অংকের ভারতীয় মুদ্রা প্রদানের কৌশলে হুন্ডি ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এই সুবিধাগুলো বিদ্যমান না থাকলে নিঃসন্দেহে এতদিন বাংলাদেশিরা ভারতেই সর্বাধিক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে খরচ করতেন।

আগস্টে বাংলাদেশে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ভারত ভিসানীতি বদল করে অত্যন্ত কঠিন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশিরা বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে, এমনকি মুমূর্ষু রোগীদের ফলো-আপ চিকিৎসার জন্যও ভারতের ভিসা পান না বা আবেদন করতে পারেন না। ফলে বাংলাদেশিদের জন্য ভারত ভ্রমণ কঠিন হয়ে গেছে। তাই যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি, তারা এখন সাধ্যের বাইরে হলেও জীবন রক্ষার তাগিদে থাইল্যান্ড ও সিংগাপুরমুখী হয়েছেন। এই দুটি দেশের হাসপাতালগুলোর ব্যবসা বৃদ্ধির এটি একটি সুযোগ। তাই প্রতিনিয়ত থাইল্যান্ডের হাসপাতালের পক্ষ থেকে বাংলাদেশিদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে সহজ-সুলভ চিকিৎসা ও থাইল্যান্ড ভ্রমণের জন্য। ফলে এদেশ থেকে থাইল্যান্ড ও সিংগাপুরমুখী যাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। ফলে এদেশ থেকে আলোচ্য দুটি দেশে রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেড়েছে। এই সূত্রেই সেসব দেশে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছেÑ গত সেপ্টেম্বরে কেবল থাইল্যান্ডে বাংলাদেশি পর্যটকগণ ক্রেডিট কার্ডে খরচ করেছেন ৪২ কোটি টাকা। বিদেশে ভ্রমণকালে যারা বাংলাদেশি বিভিন্ন ব্যাংকের ইস্যু করা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন তারা এখন সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেন যুক্তরাষ্ট্রে। এই ব্যয়াধিক্যের দিক থেকে দ্বিতীয় দেশ হচ্ছে থাইল্যান্ড। অক্টোবরে এই দেশে আমাদের ব্যয়ের পরিমাণ ১৬ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ কোটি টাকায়। ভারতীয় ভিসানীতির বিদ্যমান অবস্থা বহাল থাকলে থাইল্যান্ডে বাংলাদেশিদের ভ্রমণ এবং ব্যয়ের পরিমাণ ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলেই অনুমিত। কারণ বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে প্রদত্ত চিকিৎসার ওপর অনেকেরই বিশ^াস নেই।

বিদেশে যারা চিকিৎসা করাতে যান তাদের অধিকাংশই ট্যুরিস্ট ভিসা ব্যবহার করে থাকেন। এর প্রধান কারণ হলো- বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি নিয়মের জটিলতা। বিদেশে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যে কোনো দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা করাতে চাইলে প্রথমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি আবেদন করতে হয়। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষের আনুকূল্য থাকলে তারা একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেন এবং রোগীকে পরীক্ষা করেন। এই বোর্ড যদি আবেদনকারী রোগীর চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব নয় এবং বিদেশে চিকিৎসা প্রয়োজন মর্মে সার্টিফিকেট প্রদান করে (যা সাধারণত চিকিৎসকগণ করেন না) তা হলে বিদেশি হাসপাতালের দেওয়া এস্টিমেট অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ করা ও রেমিট্যান্সের জন্য অনুমোদন লাভ করলে রোগী টাকা নিয়ে বিদেশে যেতে পারেন। এই অনুমোদনগুলো সংগ্রহ করতে যদি কেউ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যায়, তা হলেও রোগী পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। ফলে পর্যটন কোটায় (এবং হুন্ডিতে) টাকা নিয়ে বাংলাদেশিগণ বিদেশে চিকিৎসার কাজ সম্পাদন করে থাকেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদনে জানিয়েছে- অক্টোবরে দেশ-বিদেশে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। দেশের অভ্যন্তরে এক মাসের ব্যবধানে (সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর) ক্রেডিট কার্ডের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৯৭ কোটি টাকা (শতকরা প্রায় ৭.৫০ ভাগ)। গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশের অভ্যন্তরে ক্রেডিট কার্ডে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা এবং অক্টোবরে তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে বিদেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে খরচ বেড়েছে ৭৮ কোটি টাকা (শতকরা ১৮.৫০ ভাগের অধিক)। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৪২১ কোটি টাকা এবং অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯৯ কোটি টাকা। বিদেশে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ডে সর্বাধিক পরিমাণ ব্যয় হয় যুক্তরাষ্ট্রে; এর পর যথাক্রমে থাইল্যান্ড ও সিংগাপুর।

বাংলাদেশ ক্যাশলেস অর্থনীতি চালু করতে আগ্রহী। ক্যাশলেস লেনদেন হলে টাকা ছাপার খরচ কমে যাবে, নগদ টাকার স্থানান্তর ও ব্যবস্থাপনার খরচ কমে যাবে, উপরন্তু টাকা চলাচলের ট্র্যাকরেকর্ড থেকে যাবে। কেউ অবৈধ উপায়ে হাজার কোটি টাকার মালিক হতে গেলে বা লেনদেন করতে গেলে সহজেই ধরা সম্ভব হবে (অবশ্য সরকারের ইচ্ছে থাকা সাপেক্ষে)। এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশে ক্রেডিট কার্ডকে জনপ্রিয় করে তুলতে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠভাবে এগিয়ে আসতে হবে। একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড বিভাগের এক কর্মকর্তাকে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) তাদের সমস্যা ও পরামর্শ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করেই নানা ধরনের নির্দেশনা প্রদান করছে, যা বাস্তবায়ন করাও অনেক সময় সম্ভব হয় না। তা ছাড়া বিভিন্ন কারণেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবসায়ে মুনাফার পরিমাণ কমে আসছে। আগে বাংলাদেশ ব্যাংক যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে বাণিজ্যিক ব্যাংকের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে বিষয়টি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করে এবং প্রস্তাবিত সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করতে যাওয়ার সুবিধা-অসুবিধাগুলো জেনে নিত। আজকাল তারা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতি পরিহার করেছেন বলেই মনে হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, ক্রেডিট কার্ডের পুরো বিল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা না হলে শতকরা ২৫ হারে সুদ প্রদান করতে হয়। এ প্রসঙ্গে আরও একটি তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলোÑ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যগণ বা মালিকগণ এবং রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা ইতিপূর্বে বিদেশে গিয়ে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ইচ্ছে অনুসারে অধিক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করেছেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের এই সুযোগ প্রদান করেছে বা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাধা দিতে পারেনি। আগস্টের পট পরিবর্তনের পর এখনও এ ধরনের ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে না। ব্যাংকিং খাত সংস্কারের মাধ্যমে ব্যাংকিং-সেবায় সকল পর্যায়ের নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে এবং কারও জন্য কোনো অন্যায় সুযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হবে নাÑ বর্তমান সময়ে এটাই সবার প্রত্যাশা।


মাহফুজুর রহমান : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক