স্মৃতি-বিস্মৃতির স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল

জাহিদ রহমান
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
স্মৃতি-বিস্মৃতির স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল

কোচ ননী বসাক, লুৎফর রহমান, আলী ইমাম, খন্দকার এম নুরুন্নবী, আইনাল হকসহ এক এক করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের আরও সদস্যরা পরলোকগত হয়েছেন অনেক আগেই। তবে সমসাময়িক সময়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের পরপর পাঁচজনের মৃত্যুতে যারা বেঁচে আছেন, তাদের দুঃখের যেনো শেষ নেই। কদিন যেতে না যেতেই তাদের শুনতে হচ্ছে খেলার মাঠের সহযোদ্ধার চলে যাওয়ার সংবাদ। এই সংবাদ বেঁচে থাকাদের জন্য এখন বিরাট এক ধাক্কা। ২৯ জুলাই সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য আমিনুল ইসলাম সুরুজ। ৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে মারা যান স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের উদ্যোক্তা বলে খ্যাত সাইদুর রহমান প্যাটেল। এর পর ১৯ সেপ্টেম্বর মারা যান স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিমের আরেক সদস্য বিমল কর। গত ১৮ নভেম্বর মারা যান স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় দলের প্রথম অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। সবশেষে ৭ ডিসেম্বর পরলোকে পাড়ি জমালেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিমের অন্যতম সদস্য রাজশাহীর ফজলে সাদাইন খোকন। মুম্বাইয়ের ম্যাচে দারুণ খেলেছিলেন, যে ম্যাচে খেলেছিলেন নবাব মনসুর আলী খাঁর পতৌদিও।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ইতিহাস অনেক বিস্তৃত, ঘটনাবহুল। অনেক ঘটনা-প্রবাহের মধ্যেই জন্ম নেয় এই দলটি। কোচ, ম্যানেজার, খেলোয়াড়Ñ সবমিলিয়ে ৩৫ জনের দল। এই ফুটবল দলে ছিলেন ওই সময়কার নামকরা সব ফুটবলার ও সংগঠকরা। বলা হয়ে থাকেÑ পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই যুদ্ধকালীন প্রথম কোনো ফুটবল দল। এরকম ফুটবল দল গঠনের নজির আর কোথাও নেই। ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’-এ যারা ছিলেন তারা হলেনÑ প্রয়াত জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শংকর হাজরা (সহ-অধিনায়ক), কাজী সালাউদ্দিন, প্রয়াত একেএম নওশেরুজ্জামান, প্রয়াত লে. খন্দকার এম নুরুন্নবী, প্রয়াত আলী ইমাম, মোহাম্মদ শেখ তসলিম উদ্দিন, প্রয়াত আইনুল হক, ফজলে সাদাইন খোকন, লুৎফর রহমান, শেখ আশরাফ আলী, প্রয়াত অমলেশ সেন, প্রয়াত আব্দুল হাকিম, আমিনুল ইসলাম, সুরুজ বিমল কর, সাইদুর রহমান প্যাটেল, সুভাস চন্দ্র সাহা, মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, দেওয়ান মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন সিরু, আব্দুস সাত্তার, সঞ্জিত কুমার দে, আব্দুল মোমেন জোয়ার্দ্দার, মনিরুজ্জামান পিয়ারু, এনায়েতুর রহমান খান, শাহজাহান আলম, অনিরুদ্ধ চট্টোপাধ্যয়, নীহার রঞ্জন দাস, প্রাণ গোবিন্দ কুন্ডু, প্রয়াত মাহমুদ রশীদ, প্রয়াত শেখ মনসুর আলী। ব্যবস্থাপক হিসেবে ছিলেন তানভীর মাজহার ইসলাম তান্না। কোচ হিসেবে ছিলেন প্রয়াত ননী বসাক।

সম্প্রতি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের পাঁচ সদস্যের পর পর মৃত্যুতে শত স্মৃতি তাড়া করছে যারা বেঁচে আছেন তাদেরকে। কত ঘটনা আর ইতিহাসের সাক্ষী তারা। ৫৩ বছর পর সেই ইতিহাসে চোখ মেলে মাঠের সতীর্থদের খুঁজে ফেরেন বেঁচে থাকা ক্রীড়াযোদ্ধারা। এক অন্যরকম অতীত-ইতিহাসের সাক্ষী তারা। পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে ফুটবল নিয়ে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করে সবার নজর কাড়েন। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে একাত্তরের ২৫ জুলাই এক বিরল ইতিহাসের রচনা করেন তারা। এদিন নদিয়া জেলা ক্রীড়া সমিতি দলের বিপক্ষে খেলতে নামে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ওই সময়কার নদিয়া জেলা প্রশাসক ডিকে ঘোষ পুরো বিষয়টি সমন্বয় করেন। ২০ থেকে ২৫ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে এই ম্যাচ শেষে ২-২ গোলে ড্র হয়। সেদিন বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা জাতীয় পতাকা নিয়ে মাঠ পরিদর্শন করেন। মাঠে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতও পরিবেশন করা হয়। দেশের পক্ষে প্রথম গোল করেন ফুটবলার শাজাহান। এই দলের প্রথম সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সামসুল হক। এর পর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বেশ কয়েকটি জায়গাতে ভারতের বিভিন্ন দলের বিপক্ষে ১৩টি (কারও কারও মতে ১৬টি) প্রীতিম্যাচ খেলে। ম্যাচ খেলার পর যে অর্থ জমা হয় তা সরকারি তহবিলে জমা দেওয়া হয়।

বিজয়ের মাস এলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা একটু বেশি খুঁজে ফেরেন সেই যুদ্ধদিনের অতীতকে। কেননা মহান মুক্তিযুদ্ধের আলাদা অহঙ্কার ও গৌরব নিয়ে মিশে আছে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের জন্য এক অন্যরকম প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল এই ফুটবল দল। বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আরও জোরাল জনমত তৈরি, একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে পাশে দাঁড়াতে প্রতিবেশী ভারতের মাটিতে গঠন করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য প্রতাপ শংকর হাজরা, শেখ আশরাফ আলীদের জীবনে অবিনশ্বর স্মৃতি সেই ফুটবলের দিনগুলো। দুজনেরই বয়স বেড়েছে। সহযোদ্ধারাও চলে যাচ্ছে একের পর এক। এখনও সে কথা মনে করে তারা ভীষণরকম বিষণ্ন হন। তবে এই স্মৃতি যে তাদের জীবনের অমূল্য সম্পদ, তা কথা বললেই টের পাওয়া যায়। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক বর্ষিয়ান প্রতাপ শংকর হাজরা সেই স্মৃতি মনে করে বলেন, যুদ্ধকালে পুরান ঢাকাতে তাদের পৈতৃক বাড়ি পাকিস্তানি সেনারা পুড়িয়ে দিলে তিনি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের দোগাছীতে গ্রামের বাড়ি যান; কিন্তু ওখানেও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন। তাই একসময় মুক্তিযোদ্ধা আসাদ এবং শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমীর সহযোগিতায় কুমিল্লার বদরগঞ্জ দিয়ে ত্রিপুরার আগরতলাতে যান। এর পর আগরতলা থেকে প্লেনে চড়ে তিনি কলকাতাতে যান। ওখানেই আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় থাকতে শুরু করেন। তবে ত্রিপুরাতে থাকাকালেই তিনি আগরতলাতে একটি টিমের পক্ষে খেলতে থাকেন। কলকাতায় যাওয়ার পর এমএনএ সামসুল হক প্রথম উদ্বুব্ধ করেন একটি টিম গঠনের জন্য। এর পর সাইদুর রহমান প্যাটেলসহ অন্যদের উদ্যোগে দল গঠন করেন। প্রতাপ শংকর হাজরা জানান, কিছু ফুটবলার কুমিল্লা হয়ে আগরতলাতে গিয়েছিল আগেই। আর কিছু ফুটবলার ঢাকা থেকে যশোর দিয়ে কলকাতাতে এসে পৌঁছায়। আস্তে আস্তে দল বেশ বড় হতে থাকে। একটা সম্মিলিত উদ্যোগের মধ্য দিয়েই ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ গঠন করা হয়। প্রতাপ শংকর হাজরা আরও জানান, প্রথমে তারা কলকাতার পাক সার্কস মাঠে অনুশীলন শুরু করেন; কিন্তু সেখানে বাধার মুখে পড়েন। ফলে তাদের অনুশীলনের জায়গা পরিবর্তন করতে হয়। পরে তারা রবীন্দ্র সরোবরের আশপাশের জায়গা বেছে নেন। সবাই মিলে ওখানেই অনুশীলন শুরু করেন। তিনি বলেন, এই দল গঠনে শামসুল হক, লুৎফর রহমান, মোহাম্মদ মহসীন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম ফুটবলার শেখ আশরাফ আলী জানান, যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি যশোরে নানার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। যশোর শহরের আর এন রোডে অবস্থিত ওনার নানার বাড়ি একসময় পাকসেনারা পুড়িয়ে দেয়। এর পর উনি বনগাঁও হয়ে কলকাতাতে চলে যান। ওখানে গিয়ে উনি নাম পরিবর্তন করে কলকাতা লিগের একটি স্থানীয় ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্র্যাকটিস শুরু করেন। একটি ম্যাচেও তিনি অংশ নেন। এর পর ওনার সঙ্গে প্রতাপ শংকর হাজরা, সাইদুর রহমান প্যাটেলের যোগসূত্র তৈরি হয়। এক এক করে সবার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। সবাই মিলে তৈরি করেন ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’।

শেখ আশরাফ আলী বলেন, ‘ফুটবল জীবনের অন্যতম বড় ঘটনা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের হয়ে খেলা। এটি স্মৃতিতে অবিনশ্বর; কিন্তু আমাদের সহযোদ্ধারা এক এক করে চলে যাচ্ছে। এইতো কদিন আগে সুরুজ ও প্যাটেল চলে গেল। ওদের চলে যাওয়াতে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুও চলে গেলেন। প্রতাপদাসহ আমরা কয়েকজন বেঁচে আছি। একদিন আমরাও চলে যাব। এর পর আর কেউ থাকবে না।’ খানিকটা আক্ষেপ নিয়ে বলেন, এর পর হয়ত আপনারা কথা বলার মতো কাউকে খুঁজে পাবেন না। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শংকর হাজরার মুখেও একই কথার প্রতিধ্বনী। তিনি বলেন, ‘আমাদের ছেড়ে ১৭ জন চলে গেছেন। আমরা বাদবাকি ১৮ জন বেঁচে আছি। কায়কোবাদ, তসলিমসহ আরও অনেকেই অসুস্থ। আমরাও চলে যাব। হয়তো একদিন লেখা হবেÑ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের আর কেউ বেঁচে নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি ইতিহাস ইতিহাসের জায়গায় থাকবে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ইতিহাস কেউ কখনও কোনোদিন বিকৃত করতে পারবে না।’


জাহিদ রহমান : ক্রীড়ালেখক ও গবেষক