রাষ্ট্রীয় সংস্কার : একটি অপরিহার্য আলোচনা
সংস্কার! সংস্কার!! সংস্কার!!! এই শব্দটি আমাদের প্রিয় সোনার বাংলার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা আসলে সংস্কার বলতে কী বুঝি? এটি কি কেবল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন, রাজনৈতিক দলের পরিবর্তন, পদের রদবদল অথবা প্রশাসনিক অবকাঠামোর পরিবর্তন? এ বিষয়ে এখনও সুস্পষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে।
যেভাবেই সংস্কার করা হোক না কেন, আমার বিশ্বাস, আমাদের ব্যক্তিগত ও নৈতিক সংস্কারই সবচেয়ে জরুরি। কারণ আমরা লক্ষ করি, পূর্ববর্তী সরকারের সময় গৃহীত নীতিমালা, এমনকি বিচারিক রায়ও নতুন সরকারের অধীনে পাল্টে যায়। প্রশ্ন হলোÑ পূর্ববর্তী সময়ে যে বিচারক রায় দিয়েছিলেন, তিনি কোন যুক্তি-প্রমাণ বা নির্দেশনায় সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? যদি ধরে নিই তিনি পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন এবং সেই সময়ের সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন, তা হলে এর অর্থ দাঁড়ায় যে, বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়।
ঠিক একইভাবে, যখন নতুন সরকার আসে, তখন বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, আর্থিক সংস্থা, সেক্টর করপোরেশন- সবকিছুই নতুন শাসকদের ইচ্ছার অধীন হয়ে যায়। যদিও সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানগণ দাবি করেনÑ ‘আমরা তো শুধু নির্দেশ পালন করেছি; আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই, সরকার যা বলেছে তা-ই করেছি।’ তা হলে এটি একধরনের দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক। এটি বোঝায় যে, তারা তাদের বিবেক, বিচার-বুদ্ধি এবং নৈতিকতাকে চাকরির শর্ত অনুযায়ী সরকারের কাছে বন্ধক দিয়েছেন।
আমাদের দেশের ইতিহাসে একাধিকবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু প্রশাসনিক কাঠামো এবং কাজের পদ্ধতি অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। রাষ্ট্র যেন একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে ক্ষমতাসীন দল বা পরিবারের হাতে রাষ্ট্রের সমস্ত শেয়ারের মালিকানা চলে যায়। এর ফলে নির্বাহী বিভাগ থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ পর্যন্তÑ সব কিছুই একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকে।
তা হলে প্রশ্ন থেকে যায়- সংস্কার আসলে কীভাবে সম্ভব?
আমার মতে, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের, সচিবালয় থেকে উপজেলা, সুপ্রিম কোর্ট থেকে নিম্ন আদালত, সর্বক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জনগণের কাছে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যদি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল করেন বা রাজনৈতিক দল বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপে অন্যায় কাজে লিপ্ত হন, তা হলে তাদের অবশ্যই আইনত দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। কোনো সরকারের সময় গৃহীত সিদ্ধান্ত নতুন সরকার এসে রদ করবেÑ এ ধরনের চর্চা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন, যতক্ষণ না দেশের জন্য কোনো ক্ষতিকর কিছু না হয়ে থাকে। তাই এখনই সময় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে, নির্বাহী বিভাগ, দুদক, নির্বাচন কমিশন, প্রধান হিসাব নিয়ন্ত্রক, একাউন্টস অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, অন্যান্য সকল পেশাজীবী, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, সেক্টর করপোরেশন, অধিদফতর, সচিবালয় থেকে উপজেলা, উচ্চ আদালত থেকে নিম্ন আদালত, ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সকল প্রতিষ্ঠানÍসমস্ত সকল প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কর্মকাণ্ড সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জানার দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করতে হবে। আর এই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে বিলম্ব না করেই। বিগত সরকারের আমলে সরকারের নির্দেশে যারা অন্যায় করেছে বা অন্যায়কে সমর্থন দিয়ে দুর্নীতির পথকে সুগম করেছে; সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রত্যেক কর্মকর্তা, প্রত্যেক বিচারককে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং এমন দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো কর্মকর্তা বা বিচারক সরকারের দোহাই দিয়ে দুর্নীতি করতে সাহস না পায়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার গুরুত্ব : প্রকৃত সংস্কার তখনই কার্যকর হয়, যখন রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগসহ অন্যান্য সকল প্রশাসনিক স্তরে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি সুষ্ঠু কাঠামো প্রতিষ্ঠা হয়। রাষ্ট্রের কোনো স্তরে যদি রাজনৈতিক চাপ বা প্রভাবের কারণে অন্যায় বা দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়, তা হলে প্রকৃত সংস্কার সম্ভব নয়।
প্রতিটি স্তরে জবাবদিহিতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কিছু মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি। এই নীতিমালাগুলো নিম্নরূপ হতে পারে-
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রভাব, ব্যক্তিগত স্বার্থ বা প্রশাসনিক চাপের কারণে বিচার বিভাগ যেন প্রভাবিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিচারকদের রায় বা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখা অপরিহার্য এবং কোনো চাপের মুখে কোনো মহলের চাপে অন্যায়ভাবে বিচারিক কার্য সম্পাদন করলে সেই বিচারককে আইনের আওতায় আনা উচিত।
নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বশীলতা : নির্বাহী বিভাগের প্রধানগণ এবং কর্মকর্তাদের ওপর জনগণের সরাসরি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের সিদ্ধান্ত বা কার্যক্রম যেন রাষ্ট্রের সংবিধান এবং জনগণের কল্যাণের বাইরে না যায়, সে জন্য কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা থাকতে হবে।
প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের দায়িত্ব : রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণকে তাদের পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্তের জন্য আইনের আওতায় আনা উচিত। ইচ্ছাকৃত অন্যায়, ভুল সিদ্ধান্ত বা রাজনৈতিক চাপের কারণে প্রভাবিত হয়ে কাজ করলে তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন : রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে, যেন এগুলো কোনো নির্দিষ্ট দলের বা ব্যক্তির স্বার্থে পরিচালিত না হয়।
সুশাসন ও স্বচ্ছতা : রাষ্ট্রের সকল স্তরে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি নীতিমালা ও সিদ্ধান্ত যেন জনগণের কাছে সহজে ব্যাখ্যাযোগ্য হয় এবং কোনো ধরনের গোপনীয়তা বা দুর্নীতির আশ্রয় না নেওয়া হয়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা : কোনো স্তরে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তৎক্ষণাৎ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষত যারা উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত, তাদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
উপসংহারে বলা যায়- রাষ্ট্রীয় সংস্কার তখনই সফল হবে, যখন নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং অন্যান্য প্রশাসনিক স্তরে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সুশাসন, জবাবদিহিতা এবং ন্যায়বিচারের পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে। এটি কেবল জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে না, বরং একটি সুশৃঙ্খল, উন্নয়নশীল ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক হবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
শেখ আশাফুজ্জামান : স্বতন্ত্র পরিচালক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড