আনন্দ-বেদনার ১৬ ডিসেম্বর
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমি ছিলাম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। ১৯৭০-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র কর্মসূচি উত্থাপন করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) পক্ষ থেকে। এর পক্ষে জোরালো বক্তব্য প্রদান করার ‘অপরাধে’ তৎকালীন সামরিক আদালতে আমার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অখণ্ডতা নস্যাতের পক্ষে বক্তব্য রাখা এবং সামরিক আইনের বিরোধিতাসহ অন্যান্য অভিযোগে আমার বিচার হয়। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বিচারের প্রহসনটি অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ আমাকে সশ্রম কারাদণ্ড ও ১৫ বেত্রদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়।
ডিসেম্বরের ৩ তারিখ শেষ রাতে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে ভারতীয় বিমানবাহিনী বোমাবর্ষণ করে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ সেলের জানালা দিয়ে বোমা বর্ষণজনিত আগুনের লেলিহান শিখা আমি দেখতে পেয়েছিলাম। তারপর থেকে একে একে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের ঘটনা জেলখানার ‘মিয়া সাহেব’দের (জেলের ওয়ার্ডেন) কাছ থেকে জানতে পারছিলাম। ডিসেম্বরের ১১ তারিখের পর বুঝতে পারছিলাম পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় আসন্ন। মিয়া সাহেবদের কাছ থেকে দেশি-বিদেশি রেডিওর খবরও জানতে পারছিলাম। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ নিয়ে এ সময় কিছু পরস্পরবিরোধী সংবাদও পেয়েছিলাম। ১৩-১৪ তারিখের দিকে দেখলাম, আকাশে পাকিস্তানি সেবর জেটের সঙ্গে ভারতীয় বিমানবাহিনীর জেট বিমান ডগ ফাইটে লিপ্ত। পাকিস্তানি জেট ফাইটারগুলো ভারতীয় বিমানের গুলিবিদ্ধ হয়ে ভূপাতিত হচ্ছে। ১৪ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় সেনাপ্রধান সেন মানেকশ’র নামে বিমান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি আত্মসমর্পণের জন্য রাশি রাশি খুদে লিফলেট আকাশ থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। আরও দেখা গেল, ভারতীয় বিমানবাহিনী তখনকার গভর্নর হাউসের (বর্তমানের বঙ্গভবন) ওপর স্ট্রেপিং করছে। বুঝতে পারলাম, পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য চরম মুহূর্ত উপস্থিত।
পাকিস্তানি বাহিনী তৎকালীন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে আত্মসমর্পণ করল। আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করলেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লে. জে. আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। আত্মসমর্পণস্থলে একটি টেবিল রাখা হয়েছিল, সঙ্গে দুটি চেয়ার। এর একটি লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার জন্য, অন্যটি নিয়াজীর জন্য।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কমান্ডের পক্ষ থেকে এয়ারভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার উপস্থিত ছিলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের যে ছবি সার্কুলেট করা হয়েছিল, তাতে দেখা যায়, খন্দকার সাহেব পেছনের কাতারে দাঁড়িয়ে। দুর্ভাগ্যের বিষয় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এক লেখা থেকে জানা যায়, ওসমানী সাহেব সেদিন ছিলেন সিলেটের আকাশে একটি হেলিকপ্টারে। ওসমানী সাহেবের সঙ্গে সহযাত্রী ছিলেন মেজর জেনারেল আবদুর রব, ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও শেখ কামাল। এঁদের হেলিকপ্টারটির ওপর রহস্যজনকভাবে অন্য একটি যুদ্ধবিমান থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। হেলিকপ্টারটি জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়। কারণ হেলিকপ্টারটির ফুয়েল ট্যাঙ্ক বুলেটবিদ্ধ হয়েছিল এবং জ¦ালানি তেল দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। কারা ওসমানী সাহেবের হেলিকপ্টারে গুলি করে এবং কী উদ্দেশ্যে করেছে আজও সে রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে সন্দেহের তীর ভারতীয়দের প্রতি।
মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়ে জেনারেল ওসমানী ভারতীয় সেনাধ্যক্ষদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় একাধিকবার দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা। এসব কারণেই হয়তো পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত হতে পারেননি; অথবা উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কারা ফটকে এসে রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু জেলার নির্মল রায় কিছুতেই চাপের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। তার বক্তব্য ছিল, যুদ্ধে যাই হোক না কেন আত্মসমর্পণ পরবর্তী সময়ে যথাযথ বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ না পেলে তিনি রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে পারেন না।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে জেলারসহ জেলের অন্য কর্মকর্তারা মিষ্টি নিয়ে ২৬ সেলে এসে উপস্থিত হন। আমরা মিষ্টি খেলাম এবং আনন্দ বিনিময় করলাম। জেলার নির্মল রায়কে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, রাষ্ট্রের নাম কী রাখা হয়েছে। তিনি বললেন, পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। আমি সন্তুষ্টি প্রকাশ করলাম।
এক ফাঁকে ডেপুটি জেলার শামসুর রহমান সাহেব আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কীভাবে তিন মাস আগে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন যে, ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে যুদ্ধের চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যাবে? তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, আপনি কোনো আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী? আমি জানিয়েছিলাম, না, তেমন কিছু নয়। আসলে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো পাঠ করে এবং সংবাদ বিশ্লেষণ করে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম।
এদিকে জেল হাসপাতালের কম্পাউন্ডার আবদুর রহমান সাহেব আত্মসমর্পণের পরপরই ঢাকা শহরময় খুঁজে বেড়ালেন বাংলাদেশের মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুস সাহেবকে। কিন্তু তখন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারসহ কোনো কোনো কর্মকর্তাই ঢাকায় আসেননি। রহমান সাহেব চলে গেলেন ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার দপ্তরে। তিনি জেনারেল অরোরাকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললেন। জেনারেল অরোরা তার স্লিপ প্যাড ছিঁড়ে এক টুকরো কাগজে লিখে দিলেন, Rt. all prisoners imprisoned by the Martial Law authority of Pakistan. জেনারেল অরোরার ওই এক লাইনের নির্দেশে জেলার নির্মল রায় রাজবন্দিদের ছেড়ে দিতে রাজি হলেন। পরদিন সকাল ১০টায় শুধু রাজবন্দিরা নয়, সব বন্দিই জেলের খোলা ফটক দিয়ে বের হয়ে গেল। আমাকে নেওয়ার জন্য এসেছিলেন আমার খালু মরহুম জিল্লুল হুদা। আমার অন্য আপনজনরা কেউ তখন ঢাকায় ছিলেন না। তারা ঢাকার বাইরে মুন্সীগঞ্জের গ্রামে জীবনরক্ষার জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
দীর্ঘ ২২ মাস কারাভোগ ও জীবন নিয়ে অনশ্চিয়তার পর মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারলাম। দুদিন পর আমার স্ত্রী-সন্তান ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা মাহফুজ উল্লাহ তাদের ঢাকার আশ্রয়স্থলে ফিরে আসে। পরিবারের আমরা সবাই মিলিত হলাম।
১৭ ডিসেম্বর বিকালবেলায় শহীদ মিনারে সুধীজনদের এক সমাবেশ হলো। এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। এক শোকাবহ পরিবেশে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। একদিকে লক্ষ-লক্ষ দেশবাসীকে হারানোর বেদনা, অন্যদিকে জানা গেল, কয়েক ডজন বুদ্ধিজীবীকে বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর আলবদররা তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। খুবই শোকাবহ ঘটনা। এঁদের অনেকের লাশ পাওয়া গিয়েছিল রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা। শহীদ মিনারের সমাবেশে অনেক মুক্তিযোদ্ধা এসেছিলেন। তাঁরা আকাশের দিকে গুলি নিক্ষেপ করে বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করছিলেন। এঁদের অন্যতম ছিলেন কবি প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদ। এ সমাবেশে আমিও হাজির ছিলাম।
আমার শুভানুধ্যায়ীরা অনেকে আমাকে সাবধান করলেন, আমার জীবন নিরাপদ নয়। মুজিববাহিনীর লোকেরা আমাকে হত্যা করতে পারে, কারণ মতাদর্শিক দিক থেকে আমি ছিলাম ভিন্নপন্থি। অথচ এ দেশে স্বাধীনতার দাবি জনসম্মুখে সর্বপ্রথম মুষ্টিমেয় যে দু-চারজন উচ্চারণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। তবে স্বাধীনতার দাবি জানানোর কারণে সর্বপ্রথম আমাকেই সামরিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হয়ে দণ্ডিত হতে হয়। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে এমন ধরনের যেসব বিচ্যুতি প্রবেশ করেছিল তা অপনোদনের জন্য গত জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানসহ অনেক গণসংগ্রামে অথবা গুম হয়ে যাওয়ার পর শত-সহস্রজনকে রক্ত দিতে হয়েছে।
লেখক : ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!