বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অবজ্ঞা করলে বন্ধুতা টেকসই হবে না

রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী
১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অবজ্ঞা করলে বন্ধুতা টেকসই হবে না

আজ ১৬ ডিসেম্বর, আমাদের মহান বিজয় দিবস। তেপান্ন বছর আগে ১৯৭১ সালের নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রবল শক্তিধর, বর্বর পাকিস্তানি দখলদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে সশস্ত্র লড়াই করে আমাদের মাতৃভূমির মুক্তিযোদ্ধারা বুকের রক্তে রক্ত-নদী বইয়ে দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলÑ সেই বীরত্বের গাথায় রচিত বাংলাদেশিদের গৌরবের এই দিনটি।

আমরা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করব লাখ লাখ শহীদকে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের, হানাদার-সেনাদের নিপীড়নে আড়াই লাখ (কমপক্ষে) মা-বোনের সম্ভ্রমহানির শিকার সেই মহীয়ষী নারীদের এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি ও একাত্তরে স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াইয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার ঘোষক কমান্ডার জিয়াউর রহমান এবং অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ সব মুক্তিযোদ্ধা ও লড়াকু দেশবাসীকে।

আধিপত্যবাদী, প্রচণ্ড নিষ্ঠুর ও ফ্যাসিস্ট পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং সভ্যতার-সংস্কৃতিহীন পাক সামরিক বাহিনীর বাঙালিবিদ্বেষী চরম নিষ্ঠুরতা এবং বাংলাদেশ ধ্বংসের (হালাকু খাঁ-চেঙ্গিস খাঁ স্টাইলে) লক্ষ্যে যুদ্ধ-উন্মাদে পরিণত দানবদের বিরুদ্ধে লড়াকু বাঙালিদের যারা তখন সমর্থন দিয়েছিলেন, তৎকালীন ভারত সরকার ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ^ব্যাপী বাংলাদেশ সমর্থক নাগরিকদের, তাদের সবার অবদান আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।

আমাদের আঠারো কোটি বাংলাদেশির সৌভাগ্য- আমরা মার্কিন এক নেতা (বিশ^ব্যাপী খলনায়করূপে পরিচিত) কর্তৃক নোংরা দৃষ্টিভঙ্গিতে উচ্চারিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে দ্রুতগতিতে আজকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হওয়ার পথে আগুয়ান; আমাদের প্রত্যাশাÑ ইনশাআল্লাহ, আমরা আগামী এক-দেড় দশকের মধ্যে বিশে^র উন্নত দেশগুলোর একটিতে রূপান্তরিত হতে সক্ষম হবো; আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থান হবে বিশে^র বৃহত্তম অর্থনীতির রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শীর্ষ বারো নম্বরের ভেতরে।

আমাদের দুর্ভাগ্য- আশির দশকজুড়ে (নব্বইয়ের শুরুর বছরটিসহ) নয় বছরে স্বৈরাচার এরশাদের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন, রাষ্ট্র লুণ্ঠন আর লাম্পট্যে গণমানুষ পীড়নে দেশবাসী দিশাহারা হয়ে পড়েছিল। স্বৈরাচারবিরোধী রক্তক্ষয়ী দীর্ঘ সংগ্রামের পরিণতিতে নব্বইয়ের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান সেই দানব এরশাদকে বিতাড়ন করতে সক্ষম হয়েছিল। মাঝখানে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিত্ব কায়েম হলে গণতন্ত্র ও আংশিক সুশাসন ফিরে এসেছিল। কিন্তু আরও পরে ২০০৯ সাল থেকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের বর্বর শাসন, নির্বাচনবিহীন, জনপ্রতিনিধিত্বহীন ‘গায়ের জোরের’ সরকার পরিচালনা, ব্যাপকভাবে সংগ্রামী মানুষের ওপর গণহত্যাযজ্ঞ চালানো, সাড়ে পনেরো বছরের অধিককাল ‘বিশ^বেহায়ার’ মতো গণতন্ত্র হত্যা করে ক্ষমতায় আসীন থাকা, গুম-খুন, বিরোধীমতের রাজনৈতিক কর্মী ও অন্য সবাইকে পাইকারি নিপীড়ন, জেলজুলুম, হামলা-মামলার নরকযজ্ঞ সৃষ্টি, অন্তত চল্লিশ লাখ কোটি টাকার রাষ্ট্র সম্পদ লুণ্ঠন, তার মধ্যে তিরিশ লাখ কোটি টাকার বেশি সম্পদ বিদেশে পাচার, কোটি কোটি দেশবাসীকে নিত্যপণ্যের ভয়ানক কালোবাজারির শিকারে পরিণত করা এবং নীরব-দুর্ভিক্ষে অপুষ্টিতে ভুগিয়ে মানুষ হত্যা ইত্যাদি সবকিছু মিলে বাংলাদেশকে একটি দোজখে পরিণত করেছিল।

আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের প্রায় অর্ধকোটি শ্রমজীবী মানুষ যাদের নব্বই শতাংশ নারী তাদের রক্ত-পানি করা শ্রমে আসে বিদেশি মুদ্রা, আর সোয়া কোটির বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি রেমিট্যান্স যোদ্ধার কঠিন শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা, আর মৎস্যচাষি, ধান-পাট-সবজি-ফলমূল চাষিদের কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত মূল্যবান খাদ্য-অর্থ-সম্পদ বাংলাদেশকে অসীম সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, ভারত তার আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী নয়া-উপনিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে চক্রান্ত করে শেখ হাসিনার মতো একজন জুলুমবাজ স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী নেতাকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় রাখার জন্য দেড় দশকের বেশি সময়কাল একটানা সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সেই ‘ফ্যাসিবাদী সাইক্রিয়াটিক পেশেন্ট’ শেখ হাসিনা এখনো ভারতের সমর্থনে ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য নোংরামি আর ষড়যন্ত্র করে চলেছেন।

আমরা স্মরণ করব- বাংলাদেশের সবচেয়ে ত্যাগী, অসম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জিয়াউর রহমান দেশের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা দিয়ে যেমন সবচেয়ে বড়মাপের কমান্ডার হয়েছিলেন পাক দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াইয়ে, তেমনি পরবর্তীকালের রাষ্ট্রনায়ক জিয়া ভারতীয় ও অন্যসব আধিপত্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ-নয়া-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিরাপদ করতে মহাবীরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সাফল্য অর্জন করেছিলেন। ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার পতন-পরবর্তী বাংলাদেশে এখন নতুনভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্য অর্জনে রাষ্ট্রপতি জিয়ার মতো দক্ষ-সৎ-সাহসী-দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব চাই। আমাদের ভুললে চলবে না, সে রকম রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে অনেক ত্যাগী, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের নিদারুণ অভাব রয়েছে এ দেশে। তবে সম্ভাবনা অবশ্যই আছে নতুন নেতৃত্ব তৈরির।

ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ৯ ডিসেম্বর একদিনের সফরে এসে বলে গেছেন উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে একটা মেঘ সৃষ্টি হয়েছে নানা কারণে, সেটির অপসারণে তারা বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে একযোগে তৎপরতা চালাতে আগ্রহী। একেবারেই ‘ডিপ্লোম্যাটিক কৌশলের’ কথা। বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করেছেন যথার্থ ব্যাখ্যা দিয়ে জানাতেÑ সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা, ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশবিরোধী মতলববাজির অপপ্রচার বন্ধ করা, তিস্তার পানির ন্যায়সঙ্গত বণ্টন, বর্ডার এলাকায় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা ও উভয়পক্ষীয় অন্য সব সমস্যার সমাধানে দ্রুততার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ আয়োজন বিষয়ে।

ভারতের পার্লামেন্টে তাদের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ-বৈঠকের আলোচনা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের সর্বশেষ অবস্থান নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন কয়েকদিন আগে। তিনি তার সঙ্গে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সচিবের বৈঠকে উভয়পক্ষের উদ্বেগের বিষয় উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ সরকার সাম্প্রতিক কিছু সাম্প্রদায়িক সহিংসতামূলক ঘটনায় ৮৮ জনকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করার কথা তাকে জানিয়েছে। মি. মিশ্রি অনেক কথাই বলেছেন, কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে পাইকারি মিথ্যাচার চালিয়ে সারা বিশ^কে ভুল বার্তা দেওয়ার অপচেষ্টা এবং সরকারি দল বিজেপি নেতাদের ও অন্য কিছু রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার চালানো ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যকার বন্ধুতাপূর্ণ সম্পর্কে মারাত্মক ক্ষতিসাধনের বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা কিছুই বলেননি। বাংলাদেশ সরকারেরর প্রতিনিধিরা অবশ্যই উল্লেখ করেছেনÑ আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা, কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে মারমুখী মিছিল, বাংলাদেশের পতাকার অবমাননা, নয়াদিল্লিতে ্একটি রাজনৈতিক দলের বাংলাদেশবিরোধী আগ্রাসী মিছিল, উভয় দেশের সীমান্তে শুধু ফেলানী ও স্বর্ণা দাস নয়, অবিরাম বাংলাদেশি নাগরিকদের ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে মারা যাওয়ার নির্মম ঘটনাবলি ইত্যাদি কতটা ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেসব।

ভারত কানেকটিভিটিসহ বাণিজ্য সুবিধা এবং আরও অনেক কিছু বাংলাদেশ থেকে পেয়েছে কিন্তু তাদের কৃতজ্ঞতাবোধ আমরা দেখতে পাই না। আমরা ভারতের সঙ্গে প্রকৃত বন্ধুত্ব চাই তবে আমাদের স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মেনে পর্যাপ্ত স্বীকৃতি ভারত সরকারকে অবশ্যই দিতে হবে, কথায়-কাজে এক হতে হবে। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র যেখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ সব ধর্মের নাগরিকরা সমপর্যায়ের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, কারও প্রতি বৈষম্য কায়েমের কোনো ব্যবস্থাই নেই, এটা ভারতীয় রাজনীতিক ও নাগরিকদের উপলব্ধির জন্য আমরা অনুরোধ জানাব।


রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক