শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা-ভাবনা তরুণ প্রজন্মের ভেতরে প্রসারিত হোক

আসিফ মুনীর
১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা-ভাবনা তরুণ প্রজন্মের ভেতরে প্রসারিত হোক

ডিসেম্বর ১৯৭১-এর বুদ্বিজীবী হত্যার ৫৩ বছর পার হয়ে গেল। আবার ফিরে এলো ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’। প্রতিবছরই নতুন করে অনুপ্রেরণার সন্ধান এবং তাৎপর্য উপলব্ধি করার একটা সময় এটি। বিশেষ করে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে তালিকাভুক্ত করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিপর্যয় ছাড়াও এই হত্যাকাণ্ডের তাৎপর্য আরও ব্যাপক। দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী নিধনের মধ্য দিয়ে দেশটি মেধাশূন্য করে পঙ্গু করার পরিকল্পনা মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই, যা বাস্তবায়ন শুরু হয় ২৫ মার্চ রাতের হত্যাযজ্ঞের প্রথম আঘাত থেকে। ২৫ মার্চ রাত থেকে যে নিধনযজ্ঞ শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল থেকে, সেখানে ছাত্রদের পাশাপাশি বাছাই করা প্রতিভাধর শিক্ষকদেরও হত্যা করা হয়েছিল এবং পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়ই কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেছে বেছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।

অবশ্য ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে, কারণ সেটা বলা চলে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বপরিকল্পনার শেষ ধাক্কা বা মরণ কামড়; যখন তারা নিশ্চিত যে, তাদের পরাজয় দ্বারপ্রান্তে এবং বাংলাদেশ মুক্ত হতে চলেছে। ঠিক এরকম সময় গোপনে উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়ে, নির্যাতন করে, নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয় তারা।

এই নৃশংস হত্যা কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তা এখনও বোঝা যায় কারণ সেই মেধাশূন্যতা এখনও পূরণ করা যায়নি, হয়তো সেটা সম্ভবও নয়। কারণ প্রতিটি মানুষেরই আলাদা আলাদা অবদান রয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সতীর্থ, অনুসারী এবং পরবর্তী প্রজন্মের বুদ্ধিজীবীরা দেশ গড়ার কাজে তাদের অবদান রেখে চলেছেন কম-বেশি; কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত মেধা ও অবদানের আংশিকমাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে দেশ ও নবতর প্রজন্মকে দিকনির্দেশনা দিলেও সেখানে ঘাটতি রয়েই গেছে, হয়তো অল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ব্যতিরেকে। তার পরও পরিপূর্ণ স্বাদ তারাও পরবর্তী প্রজন্মকে দিতে পারেননি বা তা সম্ভবও নয়। কাজেই একটা শূন্যতা সব সময় রয়ে গেছে।

আরেকটা বিশেষ তাৎপর্য হচ্ছে- ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত মুক্তি সংগ্রামে পরাধীন বৈরী পরিবেশে বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কখনও প্রত্যক্ষভাবে তারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কখনও লেখনীর মাধ্যমে, কখনও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আন্দোলন সংগঠিত করে। এসবই মুক্তি সংগ্রামে সব সময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, একই সঙ্গে দিকনির্দেশনা দিয়েছে স্বাধীন-মুক্ত বাংলাদেশের স্বরূপটা কেমন হতে পারে, সেটির। সেখানে তারা যুক্ত করেছেন এই অঞ্চলের কয়েক শতাব্দীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সংগ্রামের অভিজ্ঞতা এবং তার বিশ্লেষণ। তাই শেষ পর্যন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিকর্ম আর একটি কাল বা সময়ের মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না, এগুলো হয়ে উঠেছে কালোত্তীর্ণ।

এই কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠার কারণেই এ বছর ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য একটু ভিন্ন আলোকে দেখার সুযোগ আছে। একটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে, একটি ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থাকে নতুন উদ্যমে আবার শক্ত করে দাঁড় করাতে গিয়ে আশা, হতাশা, শঙ্কা, সম্ভাবনার মিশেল কিছুটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টার মাঝে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর অভিজ্ঞতা ও দিকনির্দেশনা এই সময় ভাঙা-গড়ার কর্মযজ্ঞে একটি শক্ত ভিত দিতে পারে বলে বিশ্বাস করি। সেই বুদ্ধিজীবীরা এমনকি তাদের অনেক সতীর্থও আর আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু তাদের লেখাগুলো, সৃষ্টিগুলো আছে। এগুলোকে পুনরায় মূল্যায়ন বা পুনরায় বিশ্লেষণ করার মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের আকাক্সক্ষা এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের প্রয়াসে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্টকর্ম এখনও প্রাসঙ্গিক এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুনভাবে অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে বা কিছু নতুন দিকনির্দেশনাও দিতে পারে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের এই তাৎপর্য, তাদের চিন্তা-ভাবনা, তাদের ঠিক পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে প্রসার হয়নি। সবার মধ্যে ধারণ করা হয়নি বা হতে পারেনি। কাজেই নতুনভাবে সেগুলোকে আবার গ্রহণ করা, বোঝা এবং বিশেষ করে কেন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করা হয়েছিল, মেধাশূন্য হওয়ায় দেশের ক্ষতি হয়েছে না লাভ হয়েছেÑ এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রশ্ন করা দরকার ও সম্ভব। এতে জাতির উপকারই হবে।

আমাদের সঠিক নৈর্ব্যক্তিক সত্য ইতিহাস কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। সেগুলো কখনও খণ্ডিত, কখনো দলীয় রাজনীতি-প্রভাবিত। যদিও ইতিহাসের মধ্যে রাজনীতি অবশ্যই আসবে; কিন্তু অনেক সময় মতাদর্শের দিক থেকে রাজনীতি দলের মতাদর্শ দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলের চিন্তামুক্ত; কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শ পরিবেষ্টিত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করতে পারলে আসলে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেশের ইতিহাস একটি স্থায়ী সত্যাবস্থায় আসতে পারে। জাতির সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সেটি খুব প্রয়োজন। অর্থাৎ আমরা যদি চিন্তা করি যে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের একটা বড় পর্যায় ১৯৪৭-এর পর থেকে ১৯৭১ এবং তার পর থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে দেশ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে ও যাচ্ছে। তা হলে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সময়ের যে আন্দোলন, সেই সময়ের যে বিপ্লব এবং সেই সময়ের যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা সেটি যদি স্থায়ীভাবে আমরা ধারণ করতে পারি, তা হলে আমাদের শিকড়টা আরও একটু শক্ত হবে। এই দেশ প্রতিষ্ঠার যে ভিত্তিমূল সেটি আরেকটু শক্ত হবে। এখন একেবারে দুর্বল তা নয়। তবে আরও শক্ত করা সম্ভব। ভবিষ্যতের জন্য সেটা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে আরও বিভ্রান্ত সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে, হয়তো একটি কারণ প্রবীণ প্রজন্ম সেই ভিত রচনা করে যেতে পারেননি পুরোপুরি। অনেকে এখন বেঁচেও নেই। সে ক্ষেত্রে গবেষক, চিন্তাবিদ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা পরবর্তী সময় যারা করেছেন বিভিন্ন দশকে এবং বর্তমানেও করছেন, তাদের একটা প্রয়াস থাকতে পারে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা-ভাবনাগুলো নিয়ে আবার বিশ্লেষণ করার এবং ছড়িয়ে দেওয়ার।


আসিফ মুনীর : শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সন্তান, মানবাধিকার ও সংস্কৃতিকর্মী