ঘোর কাটার সময়

ড. মোহীত উল আলম
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ঘোর কাটার সময়

কলকাতার নীহারঞ্জন গুপ্ত ষাটের দশকে খুব জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। তার সামাজিক উপন্যাসগুলো যেমন আমরা গোগ্রাসে গিলতাম, তেমনি তার রহস্যোপন্যাসগুলোও ছিল সে রকম। জনপ্রিয় হলেই যে উঁচুমানের লেখক হবেন তা নয়। সেই উচ্চ কাতারে নীহারঞ্জন পড়তেন না, কিন্তু তার সৃষ্ট চরিত্র টিকটিকি অর্থাৎ ডিটেকটিভ কিরিটি রায় ছিল শার্লক হোমসের পরবর্তী এবং ফেলুদার আগের ভার্সন। এই কিরিটি রায় এতটা আমাদের স্কুলবালকদের মাথা খেয়েছিল যে, আমরা শিখে গিয়েছিলাম যে, চোখের সামনে যা দেখছি, তা সত্য নয়, বরং চোখের আড়ালে যা ঘটছে, যেটা আমরা দেখছি না, সেখানেই সত্য লুকিয়ে আছে।

পরে অধ্যয়নিকভাবে সাহিত্যের পাতা উল্টাতে গেলে দেখলাম, ছত্রে ছত্রে এই কথাটাই বারবার ঘোষিত হয়েছে যে, যেটা মুখ্য অর্থ সেটা কিছু নয়, গৌণ যেটা সেটাই আসল। এই প্রবণতার একটি ক্লাসিক ভার্সন হচ্ছে হ্যামলেটের সেই বিখ্যাত উক্তি যে, স্বর্গ-মর্ত্যে এমন অনেক জিনিস আছে যা আমাদের জানার বাইরে।

বাংলাদেশের ৫ আগস্টের বৈপ্লবিক পটপরিবর্তনের পর এ রকমেরই একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা হচ্ছে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। যেমন দৃশ্যমানভাবে আমরা দেখলাম বুক চেতানো আবু সাঈদ পুলিশের গুলি খেয়ে মারা গেছে, মুগ্ধ সংগ্রামীদের তৃষ্ণা নিবারণের সময় পুলিশের গুলিতে ঘায়েল হয়েছে। এ ছাড়া গুলিতে হাজার-বারোশ মানুষ প্রাণ খুইয়েছিল বন্দুকের মুখে, হাজার দশেক লোকের হয়েছে অঙ্গহানি।

কিন্তু যারা ইচ্ছা করে কিরিটি রায়ের মতো ঘটনার আড়ালের ঘটনাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি বক্তব্য দাঁড় করাতে চায় যে, চোখের সামনে যা ঘটেছে তার কিছুই সত্য নয়, বরং সত্য হলো একটি পরাশক্তির দেশ যে চক্রান্ত করে যেনতেন প্রকারে পূর্বতন সরকারকে হঠিয়ে দিয়েছে, সেটিই সত্য। সে সময় ঢাবির একজন প্রাজ্ঞ অধ্যাপক একটি প্রাইভেট টিভির টক শোতে হলফ করে বলেছিলেন যে, আবু সাঈদের গায়ে কোনো গুলিই লাগেনি। তবে কিরিটি রায়ের সঙ্গে এই মতলববাজ অধ্যাপকের তফাত হলো এখানে যে, কিরিটি রায়ের কাছে দৃশ্যমান ঘটনাটি তার জন্য প্রয়োজন দৃশ্যমান ঘটনার আড়ালে আসলে কী ঘটেছিল তার সঙ্গে সংযোগ খুঁজে নিতে। অর্থাৎ দৃশ্যমান ঘটনাটি যদি ‘ক’ ধরি, আর দৃশ্যমানতার আড়ালের ঘটনাকে ‘খ’ ধরি, তা হলে কিরিটি রায়ের পদ্ধতি হলো ‘ক’-এর সঙ্গে ‘খ’-এর সংযোগ খুঁজে পাওয়া। কিন্তু ওই অধ্যাপকের বা এই ধরনের চিন্তা যারা করেন, তারা বলতে চান যে ‘ক’-এর সঙ্গে ‘খ’-এর সম্পর্ক হলো বৈপরীত্যমূলক বা শত্রুতামূলক। অর্থাৎ ‘ক’-এর সঙ্গে ‘খ’-এর কোনো ঘটনাপরম্পরার সংযোগ নেই।

এটি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক অসুস্থ ও অবাস্তব চিন্তা এবং এক ধরনের মাটিতে মুখ গুঁজে রেখে বাস্তবতাকে পরিহার করার প্রচেষ্টাও বটে। একটা উন্মাদকর ঘোরের সৃষ্টি করা। এরা দৃশ্যমান ঘটনার সঙ্গে দৃশ্যের আড়ালে যা ঘটছে তার সঙ্গে সংযোগ না খুঁজে বৈপরীত্য খোঁজে। তারা পূর্বাপর ঘটনার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী সূত্রগুলোকে অস্বীকার করছেন। অথচ দৃশ্যমানভাবে আমরা দেখলাম যে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বিন্দু থেকে ক্রমেই সিন্ধু হয়ে সব স্তরের জনগণের অংশগ্রহণে একটি সংক্ষুব্ধ গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, যার ফলে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সরকারের পতন হয়। এই দৃশ্যমানতাকে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করার কোনো কারণ নেই। যদি ধরিও যে, একটি পরাশক্তি এটির পেছনে ছিল, সেটি পেছনের কথা, কিন্তু লাখ লাখ লোকের সমাগম তো আমরা চোখের সামনে দেখেছি। এই সমাগমটি পরাশক্তির ইন্ধনের কারণে হয়নি, হয়েছিল আমাদের দেশেরই সংক্ষুব্ধ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে।

এই সংক্ষুব্ধতার উৎস হলো প্রকৃত অর্থে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে দেশের শাসন কার্যক্রম পরিচালিত না করা। কিরিটি রায়ের মতো দৃশ্যমানতার সঙ্গে অদৃশ্যমানতার সংযোগ আমরা খুঁজে পাব এই অর্থে যে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধেছিল পূর্বের যথেচ্ছাচার শাসনের প্রতিকারস্বরূপ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কারণ নয়, ফলাফল।

গত বুধবার পত্রিকায় দেখলাম এস আলম গ্রুপের মালিকের বাসভবনের সামনে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একটা ব্যারিকেডের মতো তৈরি করেছেন। তাদের ব্যাংক থেকে নানান কারসাজিতে যথেচ্ছ টাকা বাইরে নিয়ে গেছে ব্যাংকটির মালিকপক্ষ। কয়েক লাখ কোটি টাকা দেশের বাইরে চালান হয়ে গেছে এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে। পূর্বতন সরকারের পনেরো বছরের শাসনামল (২০০৯-২০২৪) নিয়ে একটি খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার পদ্ধতিতে ফ্যাক্ট-ফাইনডিং জরিপের মাধ্যমে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে পূর্বতন সরকারের দুর্নীতির চিত্রে প্রধানত একটি অপবিত্র ত্রয়ী আঁতাতকে দায়ী করা হয়েছে। এই আঁতাত হয়েছে প্রধানত শাসক দল, ব্যবসায়ী দল ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে। রাজনীতিতে ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির মনোভাব ঢোকার ফলে দেশকল্যাণমূলক কার্যক্রম প্রাধান্য পায়নি। ব্যবসায়িক শ্রেণি তাদের বুদ্ধিতে রাজনীতিকে প্রভাবিত করে উচ্চাকাক্সক্ষী বড় বড় প্রকল্প নিতে তৎকালীন সরকারকে প্ররোচিত করেছিল, বা সরকার প্ররোচিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল এবং ফলে দৃশ্যমানভাবে প্রচুর দেশ গঠনমূলক উন্নতি হলেও মূল প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৪০% চলে গেছে অশুভ রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক ক্রনিদের হাতে। শ্বেতপত্রটি আরও বলছে, পূর্বতন সরকার ৭% প্রবৃদ্ধির যে হিসাব দিয়েছে সেখানেও প্রচুর শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। কাজীর গরু খাতায় আছে গোয়ালে নেইÑ এই তরিকা ব্যবহার করে মিথ্যা পরিসংখ্যান দিয়ে পূর্বতন সরকার সাধারণ জনগণের চোখে ধুলা দেওয়ার ব্যবস্থা করে। শৃক্সক্ষলা নিয়ন্ত্রণের সংস্থাগুলো, যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগ এবং শিক্ষা বিভাগ এতটাই দূষিত হয়েছিল যে, বিরোধী কণ্ঠকে চেপে রাখাই সরকারের একমাত্র কাজ হয়ে পড়ে। আইসিটির কালাকানুন এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। আর নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুর্নীতিটি আরও মারাত্মক। যে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা সে বিচার বিভাগের মাধ্যমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনটি বাতিল হয়, যার কারণে জাতির আজকে এই দুর্দশা। শ্বেতপত্রটি আরও বলেছে, সব রকমের হুজুগি উদ্যোগ ও লুণ্ঠন ও অপব্যবস্থার সরাসরি শিকার হয়ে গেছে সাধারণ জনগণ, যাদের প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হয়। গত বুধবার বিকালে আমি জিইসির মোড় থেকে মোমিন রোডে যাওয়ার জন্য একটি রিকশা নিলাম। ভাগ্যে পড়ল আমারই কাছাকাছি বয়সের এক বুড়ো রিকশাওয়ালা। রিকশা টানতে পারছেন বা পারছেন না। চট্টগ্রামের রাস্তাঘাট উঁচু-নিচু। বুঝতে পারছিলাম তার খুব কষ্ট হচ্ছিল রিকশা টানতে। এক পর্যায়ে বললাম, আমি না হয় রিকশা ছেড়ে দিই, আপনার টানতে কষ্ট হচ্ছে। শ্মশ্রুমণ্ডিত, ঘর্মাকীর্ণ, ঘন ঘন হাঁপাতে থাকা করুণ মুখটি আমার দিকে ফিরে বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা বললেন, টানতে না পারলে ভাত খাব কেমনে?

কথাটা আমার বুকে নিদারণ বাজল। মনে পড়ল সকালে পত্রিকায় দেখা এস আলম গ্রুপের বাড়ির মালিকের বাসভবনের সামনে ব্যাংকের লোকদের বঞ্চনার প্রতিবাদে ভিড়।

রাজন্যবর্গের ইতিহাসে দুধরনের রাজাকে ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছে। এক. কল্যাণমুখী রাজা, আর দুই. নিপীড়নমুখী রাজা। পরবর্তী দলের রাজাকে স্বেচ্ছাচারী, নিষ্ঠুর, কর্তৃত্ববাদী ও অমানবিক ইত্যাদি বচনে সংজ্ঞায়িত করা হয়।

আমি এটা কখনও বুঝতে পারি না, জনমানুষের কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়ে নিজেদের জন্য কী ফায়দা অর্জন করেন এসব বিপথগামী লোক! মানুষের জন্য কান্নার কি কোনো স্থান নেই এদের বিবেকে!

অথচ প্রবল বঞ্চনার এই দৃশ্যমানতাকে অস্বীকার করার পেছনে রাজনৈতিক অভিলাষসিক্ত যে ‘লোর’টি সহজেই বাজারে গুজব, ক্ষোভ, বঞ্চনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননাসহ বাংলা সংস্কৃতি ও ভাষার অবমাননা করার বয়ান চলছে পরাজিত শক্তির মহল থেকে তাকে ছেঁকে নিলে সেই কথাটাই প্রমাণিত হয় যে, সে পুরনো কায়দায় আদর্শের বুলি কপচিয়ে লোকজনের মন ভজানোর কায়দা চলছে।

আগের একটি লেখায় বলেছিলাম, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সতত চলমান পরিবর্তনশীল ও প্রগতিমূলক একটি প্রবাহ। দুদিন পরেই আমাদের মহান বিজয় দিবস। সেখানে ৩৬ জুলাইয়ের বৈপ্লবিক নতুন প্রবাহ সংযুক্ত হয়ে এটিকে আরও গৌরাবান্বিত করবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাই, পুরনো ঘোর কেটে যাওয়াই ভালো।

ড. মোহীত উল আলম : শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক