দূষণ উৎস চিহ্নিত হলেও নেই কার্যকর পদক্ষেপ
দূষিত নগরীর শীর্ষে ফের ঢাকা
বিশ্বের দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় কয়েক বছর ধরেই প্রথম দিকে থাকছে বাংলাদেশের নাম। আর রাজধানী ঢাকা থাকছে বায়ুদূষণে শীর্ষ নগরীর তালিকায়। গবেষণা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করা গেলেও কার্যকর উদ্যোগের অভাবে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না রাজধানীর বায়ুদূষণ। শুধু তাই নয়, চলতি বছরে মাত্র দুই দিন নির্মল (স্বাস্থ্যকর) বায়ুতে শ্বাস নিতে পেরেছে ঢাকাবাসী। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সমন্বয়ের অভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না বায়ুদূষণ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এখনই যথাযথ উদ্যোগ না নিলে সামনে ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করছে নগরবাসীর জন্য।
গতকাল সোমবার সকাল ৯টায় একিউআই স্কোর ৩০৫ নিয়ে দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে ছিল ঢাকা, যা বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাভাবিক মান মাত্রার প্রায় ৬০ গুণ। সূচক অনুযায়ী, গতকালের বাতাস ছিল ‘দুর্যোগপূর্ণ’। এর আগে, গত বৃহস্পতিবারও ঢাকার বাতাস চলতি বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত ছিল।
সম্প্রতি ঢাকা শহরের বিগত ৯ বছরের বায়ূমান সূচক নিয়ে গবেষণা করেছে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। তাদের গবেষণার ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিগত ৯ বছরে জুলাই থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে গড় বায়ুমান সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মূল কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস শীতের মৌসুম এবং এই সময়ে দূষক নির্গমনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। শীতকাল শুষ্ক ঋতু হওয়ায় এ সময়ে ধুলাবালির পরিমাণও বাড়ে। পাশাপাশি ইটভাটাগুলো শুষ্ক মৌসুমে চলমান থাকে। শীতের সময়টায় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কম থাকায় অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কিছু ক্ষেত্রে মানুষ শীত নিবারণের জন্য জৈব জ্বালানি দিয়ে আগুন জ্বালায়, যা ঢাকার বায়ুদূষণকে আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দেয়।
আরও পড়ুন:
হরতাল-অবরোধে শীতের পোশাক ব্যবসায় মন্দা
গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে ঢাকার গড় বায়ুমান সূচক বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষ করে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এবং ডিসেম্বর মাসের গড় বায়ুমান সূচক ২০০-এর অধিক; যা ঢাকাবাসীর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর শুষ্ক মৌসুমের ৫ মাসে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সারা বছরের প্রায় শতকরা ৫৭ ভাগ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। অন্যদিকে বর্ষা বা
প্রাক-বর্ষাকালীন অবশিষ্ট সাত মাসে মাত্র ৪৩ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়। বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। তাদের তথ্যমতে, গত কয়েক দিনে ঢাকার সবচেয়ে দূষিত পাঁচ এলাকা ছিল পুরান ঢাকার বেচারাম দেউরি, কল্যাণপুর, ইস্টার্ন হাউজিং, সাভারের হেমায়েতপুর এবং ঢাকায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। এই পাঁচ এলাকার দূষণের কারণ বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ভবন নির্মাণের কাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, যানবাহন থেকে নির্গত ধোয়া, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং টেনারি ফ্যাক্টরি ও ইট ভাটার মতো দূষণ উৎস। এর আগেও একাধিক গবেষণা এবং অনুসন্ধানে রাজধানীর বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে এসব উৎসগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে উৎস চিহ্নিত হলেও দূষণ নিয়ন্ত্রণে নেই কার্যকর পদক্ষেপ।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
এ বিষয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘বায়ুদূষণ নিয়ে নানা কাজের কথা বলা হলেও মাঠের কাজটা জরুরি। সেই কাজটাই হচ্ছে না। আমাদের দেশে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যুগোপযোগী আইন রয়েছে। তবে ওইসব আইনের প্রয়োগ নেই। ফলে দূষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।’
দূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকেও দায়ী করে ক্যাপস চেয়ারম্যান বলেন, যেসব কারণে বাতাসে দূষণ হয়, এর জন্য যেসব অধিদপ্তর, সংস্থা বা মন্ত্রণালয় দায়ীÑ তাদের সঙ্গেই পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে বসতে হবে। পাশাপাশি দায়ী সংস্থাগুলোর সঙ্গে বসে এর সমাধান করতে হবে। আজ (সোমবার) টানা পাঁচ ঘণ্টা ধরে ঢাকার বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি আছে। কোনো এলাকায় টানা তিন দিন তিন ঘণ্টা ধরে একটানা বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি থাকলে সেই এলাকায় স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করা উচিত। কিন্তু কারোরই কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
কামরুজ্জামান মজুমদারের অভিযোগ, একমত খোদ পরিবেশ অধিদপ্তরও। তারা বলেছে, বায়ুদূষণের মতো জটিল সমস্যার সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগে ভাটা রয়েছে। জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে আমাদের জনবলের ঘাটতি রয়েছে। আমরা নিয়মিত দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি, তবে জনবল সংকটে তা পর্যাপ্ত হচ্ছে না। তাছাড়া বায়ুদূষণের মতো জটিল সমস্যার সমাধানে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়, যা এখনও করা যায়নি।’