হরতাল-অবরোধে শীতের পোশাক ব্যবসায় মন্দা
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় মন্দা সময় পার করছেন শীতের পোশাকের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। মৌসুমের মোক্ষম সময়ে একের পর এক হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে বাণিজ্য হারিয়ে মাথায় হাত পড়েছে তাদের। পরিবহন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় চরম ক্রেতা সংকট যাচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীদের কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ। লাগাতার রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে শীতকালীন ব্যবসায় বড় লোকসানের আশঙ্কা করছেন তারাও।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শীতের মৌসুমকে সামনে রেখে সেপ্টেম্বর ও নভেম্বর মাসে গরম পোশাক ও কম্বলের পাইকারি বাজার জমজমাট হয়ে ওঠে। এ সময়ের বড় বাণিজ্যের জন্য সারা বছর মুখিয়ে থাকেন পাইকারি ব্যবসায়ীরাও। এ জন্য বিপুল বিনিয়োগ ও আগাম প্রস্তুতিও থাকে তাদের। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে শীত মৌসুমের ব্যবসা পুরোপুরি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। প্রথম দিকে সন্তোষজনক হলেও হরতাল-অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে।
রাজধানীতে শীতের গরম কাপড়ের বড় পাইকারি বাজারগুলো গুলিস্তান এলাকাজুড়ে অবস্থিত। এখানকার পাইকারি বাজার ঢাকা ট্রেড সেন্টারের কমফোর্ট জোনের ব্যবসায়ী মো. দুলাল হোসেন বলেন, অন্য বছর এমন সময় দৈনিক দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছি। বর্তমানে ৫০ হাজার টাকার বিক্রিও নেই। হরতাল-অবরোধের কারণে মফস্বলের মার্কেট ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে আসতে পারছে না। কুরিয়ারের মাধ্যমেও সেভাবে পণ্য পাঠানো যাচ্ছে না। এখন সপ্তাহে শুধু একদিন (শনিবার) যা একটু বেচা-বিক্রি হয়। তাও লাখ টাকাও হয় না। এভাবে চললে মহাবিপদে পড়তে হবে।
এ মার্কেটের বুসরা ফ্যাশনের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, পাইকারিতে শীতের কাপড়ের বাণিজ্যের আসল সময়ই হচ্ছে নভেম্বর মাস। অথচ, কিছুদিন পরপর অবরোধ-হরতাল দেওয়ায় বেচা-বিক্রি করতে পারছি না। ঋণ করে বাড়তি বিনিয়োগ করেছি আমরা। কয়েক মাসের মধ্যেই তা পরিশোধ করতে হবে। এভাবে অবরোধ চললে কীভাবে তা পরিশোধ করব জানি না।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকা ট্রেড সেন্টারসহ গুলিস্তানের বেশ কয়েকটি পাইকারি মার্কেট ও বঙ্গবাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অবরোধের মধ্যেও হাতে গোনা ক্রেতাদের আনাগোনা রয়েছে। গরম কাপড় ও কম্বলের বিক্রিও চলছে। তবে ব্যবসায়ীরা জানান, ক্রেতাদের বেশিরভাগই রাজধানীর ভেতরের। ঢাকার বাইরেই বড় বাণিজ্য। অথচ অবরোধে মফস্বলের ক্রেতারা আসতে পারছেন না।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
গুলিস্তানের কম্বলের পাইকারি প্রতিষ্ঠান আমেনা-হাসান গার্মেন্টের কর্ণধার মো. সিরাজুল জানান, ডিসেম্বরের আগেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছ থেকে কম্বল সংগ্রহ করেন। গত মাসে বেচা-বিক্রির শুরুটা ভালো গেলেও হরতাল-অবরোধে করুণ সময় পার করছি আমরা। তিনি আরও বলেন, কাঁচামালের আমদানি কম ও খরচ বেশি হওয়ায় এবার দামও বাড়তি। দেশি কম্বলে ৫০ টাকা এবং বিদেশি কম্বলে ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়তি রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্রেতারা কম করে কিনছেন। দামে ছাড় দিয়েও বিক্রি বাড়ছে না।
বঙ্গমার্কেটের আজিজ গার্মেন্টের ব্যবসায়ী মো. আবদুল আজিজ বলেন, আগুনে সব শেষ আমাদের। ব্যবসায় টানা মন্দায় শেষ পুঁজিও ফুরিয়ে গেছে। তারপরও শীতকালীন বাজার ধরতে ধার-দেনা করে বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু হরতাল-অবরোধে বেচা-বিক্রি নেই। ক্রেতাই আসছেন না।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর দেশে তিনটি মৌসুমে বেশি পোশাক বিক্রি হয়। দুই ঈদ ও শীতের সময়। শীতের মৌসুমে সারাদেশে ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার গরম কাপড়ের বাণিজ্য রয়েছে। মালিক সমিতি বলছে, করোনা মহামারীর পর থেকে এ বাণিজ্যে ভাটা পড়ে। আবার বঙ্গবাজার এলাকার অগ্নিকাণ্ডে সে এলাকার বাণিজ্যে বড় ধাক্কা লেগেছে। এখন হরতাল-অবরোধে কঠিন সময় পার করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। খুচরা বিক্রেতারাও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। কারণ অবরোধের দিন তারাও দোকান খুলতে পারছে না। এমনকি ফুটপাত ব্যবসায়ীরা, যারা অল্প আয়ে চলে, ঝুঁকি এড়াতে তাদেরও ব্যবসা বন্ধ রাখতে হয়।
নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থিত নিউ সুপার মার্কেটের টিএস ফ্যাশনের ব্যবসায়ী এ আর সোহেল বলেন, এবার ব্যবসার মুখই দেখিনি। মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন লাগাতার অবরোধে আমাদের মহাসর্বনাশ। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। ব্যবসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
ঢাকা নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলামও বলেন, হরতাল-অবরোধ হলে সেদিন বেচা-বিক্রি হয় না বললেই চলে। যেদিন অবরোধ থাকে, সেদিন পুরো ব্যবসাটা মার পড়ে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
চলমান পরিস্থিতিতে কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের পোশাক এবং কম্বল কারখানাগুলোও খারাপ সময় পার করছে। নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকার পোশাক ও কম্বলের কারখানা হামজা গার্মেন্টের কর্ণধার মো. বিলাল হাজী জানান, শীতের মৌসুমকে সামনে রেখে উৎপাদন বাড়ায় কারখানাগুলো। এবার বাড়তি উৎপাদন খরচ সত্বেও বিনিয়োগ বাড়াতে হয়েছে। অথচ, বিক্রি তলানিতে।
বিলাল বলেন, গত বছর এমন সময় দৈনিক ৫০০ পিসের বেশি কম্বল ডেলিভারি দিয়েছি। এখন সেখানে ১০০-১৫০ পিসও চলছে না। এতটাই খারাপ সময় যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ঢাকার বাইরের ক্রেতারা এবার পণ্য কম করে কিনছেন। তাদের ধারণা এবার বাণিজ্য কম হবে।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম