শিক্ষাব্যয়ে বোবা কান্না অভিভাবকদের
শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের জয়জয়কারের অনেক খবর আছে। শিক্ষক-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খবর অনেক। এবারের প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তকে জুলাই-আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের ইতিহাস রাখার খবরও আছে; কিন্তু শিক্ষা, শিক্ষার মান, শিক্ষা সংস্কারসংক্রান্ত খবর অনেকটা বেখবরেই। শিক্ষাব্যয় তথা শিক্ষা উপকরণের দাম ক্রমেই চড়তে থাকা যেন গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়, তেম ঘটনাও নয়।
নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি অনেকটা নিয়তির মতো হয়ে গেছে। তা-ও আবার নিত্যপণ্য বলতে মন-মগজে খাদ্যপণ্যের কথাই আসে। শিক্ষা উপকরণকে নিত্য, খাদ্য, ভোগ্য কোনো প্রকরণে ফেলা যায় না। এটি জরুরির চেয়েও জরুরি পণ্য। হাড়ে হাড়ে জানেন এবং ভোগেন কেবল অভিভাবকরা; ভুগতে তারা বাধ্য। কান্না বা বেদনা প্রকাশের ভাষা পান না, শুধু সয়ে যান। নিত্যপণ্যের দৈনন্দিন চাহিদার সঙ্গে সন্তানের লেখাপড়ার ব্যয় মেটাতে দিশাহারা অবস্থার কথা বলার জায়গা নেই। তার ওপর যোগ হয়েছে শিক্ষা উপকরণের বাড়তি দামের যন্ত্রণা। নতুন বছরে বর্ধিত শিক্ষাব্যয় নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ঘরে ঘরে। শিক্ষা উপকরণের উচ্চমূল্য ও লেখাপড়ার ব্যয় না চালাতে পেরে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ঝরে পড়ার ঘটনা ঘটে হীনভাবে। মধ্যবিত্ত পরিবার ব্যয় কাটছাঁট করে কোনো মতে টেনে নেয়। এতে সন্তানের শিক্ষার গুণগত মান উহ্যই থেকে যায়।
বইপত্র, খাতা-কলম, স্কুল ড্রেস, জুতা, ব্যাগসহ আনুষঙ্গিক খরচপাতিতে এক একটি পরিবার কী যাতনা সয়, জানেন কেবল ভুক্তভোগীরাই। বই-খাতা-কলমের পাশাপাশি শিক্ষার অপরিহার্য উপকরণ পেনসিল, শার্পনার, ইরেজার, মার্কার, স্ট্যাপলার, পিন, ক্লিপ, স্কেল, রঙ-পেন্সিল, ক্লিপবোর্ড, ফটোকপি ইত্যাদির খরচ কী মাত্রায় বেড়েছে; প্রতিনিয়ত জানেন সংশ্লিষ্টরা। গেল প্রায় ছয় মাসে কয়েক ধাপে বই ও খাতার কাগজসহ সব ধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে দেড় থেকে দুই গুণ পর্যন্ত। শব্দহীনভাবে তা বাড়ছেই। নানা ঘটনা ও অন্যান্য কিছুর মূল্যবৃদ্ধির মাঝে তা সেভাবে আলোচনায় আসে না।
অনেকে জানেও না ৮ টাকার এক দিস্তা কাগজে দাম বেড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা এবং ১২ টাকা থেকে দাম বেড়ে ২০-২৪ টাকা হওয়ার তথ্য। কলমের ডজনে বেড়েছে ৫-৭ টাকা পর্যন্ত। ৬৮-৭২ টাকা ডজনের পেনসিলের দাম বেড়ে হয়েছে ১০০ টাকা। প্রতিটি ইরেজারের দাম বেড়েছে ৩-৫ টাকা পর্যন্ত। রঙ-পেনসিলের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। প্লাস্টিক বোর্ডের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। জ্যামিতি বক্স ৬০-৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫০-২০০ টাকা। এ ফোর সাইজের কাগজে প্যাকেটপ্রতি বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। দেশে তৈরি স্কুলব্যাগ কিনতে হলেও গুনতে হবে ৭০০ টাকা, যেগুলো গত বছর ছিল সাড়ে ৪০০ টাকা। মাঝারি মানের ব্যাগ ৮০০ থেকে বেড়ে এখন এক হাজার থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা ভালোমানের ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার থেকে বেড়ে তিন হাজার-সাড়ে তিন হাজার টাকায়। দামের কারণে এখন ব্যাগের বেচাকেনাও কম। আগে যে ক্রেতা খুব ভালো কোয়ালিটির নিতেন, এখন তিনি মধ্যমমানের ব্যাগ কেনেন। অনেকেই পুরনোটা দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
মাত্র পাঁচ-ছয় মাসের ব্যবধানে এসব উপকরণের দাম ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত এবং কোনো কোনো উপকরণের দাম (শতভাগ) দ্বিগুণ বেড়েছে। কয়েক ক্ষেত্রে এই মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক নয়। বাজারে কাগজের মূল্যবৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করছেন পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতারা। দেশি কাগজকলগুলোর উৎপাদনে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কাগজের দাম লাগামছাড়া হওয়ায় একদিকে কাগজের পাইকাররা দোষ চাপাচ্ছেন মিলমালিকদের ওপর, অপরদিকে মিলমালিকরা বলছেন বিশ্ববাজারে কাগজ তৈরির মণ্ডের দর অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়াসহ দেশে জ্বালানি সংকট ও কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির কথা। ফলে বাজারে কমেছে কাগজের সরবরাহ এবং বেড়েছে কাগজের মূল্যবৃদ্ধি। এমতাবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধি ও সংকট নিরসনে কাগজের অকেজো কারখানাগুলো চালু করা, কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ করা, কাগজের অপচয় রোধ করা, সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধ করা, স্বল্প শুল্কে কাগজের কাঁচামাল আমদানি করা জরুরি।
কাগজের মূল্যবৃদ্ধির ছাপ পড়েছে ছাপাখানা, প্রকাশনী, বিপণিকেন্দ্র আর ফটোকপির দোকানগুলোতে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পুস্তক প্রকাশনা, মুদ্রণ, পত্রিকাশিল্প, ছাপাখানা, প্যাকেজিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও কর্মীদের কর্মসংস্থান পড়ছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। সেখানে কর্মরতদের কর্মসংস্থানও হুমকিতে। তারাও এক একজন অভিভাবক। সাংসারিক টানাটানির মধ্যে সবাই তাদের সন্তানদের ঠিকভাবে শিক্ষা উপকরণের জোগান দিতে পারেন না। অবধারিতভাবে এর জের পড়ছে সন্তানের মন-মানসিকতা ও পড়াশোনার ওপর। পরিণামে স্কুল পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাও ভর করছে। ১৯৯০ সালে ‘প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক’ শিরোনামে একটি আইন পাস হয়। আর বিরান্নবইর পয়লা জানুয়ারি এই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা মাত্র ৬৮টি উপজেলায় চালু হয়। বাধ্যতামূলক এ শিক্ষা দেশব্যাপী সম্প্রসারণ হয় পরের বছর ১৯৯৩ সালে। এর পাশাপাশি তখন থেকেই শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করার জন্য উপবৃত্তি প্রদান, খাদ্য বিতরণ, বিনামূল্যে বই বিতরণসহ নানান পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ক্রমেই এ শিক্ষা কার্যক্রমের আরও বিস্তার ঘটেছে, ফলও মিলেছে। এখন শিক্ষা উপকরণ ও শিক্ষাব্যয়ের কারণে সেখানে ছেদ পড়া মোটেই কাম্য নয়। এমনিতেই করোনার সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিদ্যালয় ছাড়ার পর আর ফিরে আসেনি। ২০২০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করতÑ এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০২৩ সালে এসে দেখা গেছে তাদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে। সচরাচর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া মেয়েশিশুদের অনেকেই বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে যায়। পারিবারিক ও সামাজিক বাস্তবতায় তা রোখা যায় না।
এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ঝরে পড়া মহামারীর জন্য প্রভাবিত। এ জন্য যে কারণগুলো উঠে এসেছে, সেগুলো হলো- মহামারীর কারণে নিম্ন-আয়ের পরিবারগুলোর আয় আরও কমে যাওয়া, বিদ্যালয়ে পড়ালেখার জন্য অভিভাবকদের খরচ বৃদ্ধি, মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকা এবং বিদ্যালয় থেকে যথাযথ নির্দেশনার অভাব। এখনকার পরিস্থিতি আরেক ধরনের।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
পরিবর্তিত এ প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিতে সরকারের এখানে করণীয় অকে কিছু আছে। ইউনেস্কোর এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, পাকিস্তানে শিক্ষাব্যয়ের ৫৭ শতাংশ বহন করে পরিবার। নেপালে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় পরিবারের ব্যয় ৬৩ শতাংশ এবং কারিগরি-বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে পরিবার ব্যয় করে থাকে ৭৫ শতাংশ। যেখানে সরকারি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে এই ব্যয় ৮ শতাংশ। এ ছাড়াও দুটি প্রধান শহরে শীর্ষ চতুর্থাংশ পরিবারের মাসিক ফি প্রদানের হার নিম্ন চতুর্থাংশ পরিবারের তুলনায় চার থেকে আটগুণ বেশি। প্রতিবেদনে উঠে এসেছেÑ ভারতে শীর্ষ ২০ শতাংশ পরিবার নিচের ২০ শতাংশ পরিবারের তুলনায় সরকারি, বেসরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এবং অনুদানবিহীনÑ সবরকম স্কুলে প্রায় চারগুণ বেশি ব্যয় করে। ভারতের ১ হাজার ৫০টি কম খরচের বেসরকারি স্কুলের মধ্যে ১ হাজারটি স্কুল শুধু ফি-এর ওপর নির্ভর করে চলে।
অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ১২ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় করে এবং ৬ শতাংশ পরিবার স্কুলের ফি মেটাতে ঋণ করে থাকে। বাংলাদেশে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিবার ঋণ করে বেসরকারি পলিটেকনিকে পড়াশোনার খরচ মেটায়। এ ছাড়া শিক্ষাব্যয় সংক্রান্ত যে তথ্যগুলো সামনে আসছে তা আমলে নিয়ে জনসাধারণের সামর্থ্য বিবেচনায় তা কতটা সঙ্গতিপূর্ণ সেটি খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন চাওয়ার মতো চাইলে এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। মনে করিয়ে দেওয়া দরকারÑ সে ধরনের উদ্যোগ নিতে চাইলে তাদেরকে অন্যান্য নিত্য, ভোগ্য, খাদ্যপণ্যের সঙ্গে না মিলিয়ে শিক্ষা উপকরণকে এসবের বাইরে বিশেষ এজেন্ডায় নিতে হবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন