২০২৪-এর ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের আয়নায় ফিরে দেখা ১৯৯০-এর স্বৈরাচারের পতন
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মুখে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করে এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর আগে ৪ ডিসেম্বর রাতে এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা প্রদান করে। ৪ ডিসেম্বর সকাল থেকে সচিবালয় ও মতিঝিলে ছাত্র ছাড়াও চিকিৎসক, সাংস্কৃতিককর্মী, আইনজীবী, অন্যান্য পেশাজীবী রাজপথে নেমে আসে। এক পর্যায়ে সচিবালয় থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিছিল করে রাজপথে এসে আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। সেদিন দুপুর থেকে একটি ট্রাকে করে আমিসহ তৎকালীন ছাত্রনেতারা প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিই এবং মাইকে জনতাকে আহ্বান জানাতে থাকি মিছিল করে রাষ্ট্রপতি ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করার। সেদিন প্রেসক্লাবে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও অন্য নেতারা এসে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা এরশাদের উৎখাতের ঘোষণা করতে রাজি হননি। তারা এরশাদের পদত্যাগের ঘোষণার অপেক্ষায় ছিলেন। রাতে সেই ঘোষণা এলো। ৫ ডিসেম্বর পল্টনের মোড়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য জনতার জয় সম্প্রচার কেন্দ্র নামে একটি মঞ্চ স্থাপন করলেন। আমি চিকিৎসকদের একটি মিছিল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলে শফী আহমেদসহ অন্যান্য ছাত্র নেতা আমাকে টেনে মঞ্চে তোলেন। অপরদিকে রাজনৈতিক নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন সে দেনদরবারে ব্যস্ত ছিলেন। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের পক্ষ থেকে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নাম প্রস্তাব করা হয়। ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দলের নেতারা তা মেনে নেন। সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরের ফর্মুলা অনুযায়ী প্রথমে এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে উপরাষ্ট্রপতি ব্যািরস্টার মওদুদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ব্যারিস্টার মওদুদ রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োজিত করেন। এর পর ব্যারিস্টার মওদুদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের কাছে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব অর্পণ করেন। এ সবকিছুই চলছিল সেনাসদরে। জনগণের প্রবেশাধিকার সেখানে ছিল না। জনগণ এরশাদ ও মওদুদকে দেখতেও চাইছিল না।
পদত্যাগ করার পরও এরশাদকে সেনানিবাসের ভেতরে সেনাপতির বাসভবনে থাকতে দেওয়া হয়। সেটাকে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবন বানিয়েছিলেন। সেখানে বসে তিনি স্যাটেলাইট টেলিফোনে বিদেশে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে, প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন বলে ছাত্রদের কাছে খবর আসে। তখন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য এরশাদকে গ্রেপ্তারের দাবিতে সেনানিবাস অভিমুখে মিছিল নিয়ে এগোতে থাকে। ফার্মগেটে মিছিল থামিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি কর্মকর্তারা এসে জানান যে, এরশাদকে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যায়।
এরশাদের পতনের পর সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য সংশোধিত ১০ দফা প্রণয়ন করে। কারণ এরশাদের পতনের পর সে দাবি ও প্রাসঙ্গিক দাবিসমূহ সেখানে রাখার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো আলাদাভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ছাত্রদের পক্ষ থেকে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনের প্রস্তাব করা হলে বড় দুটো রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে শীতল মনোভাব দেখায়, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এ ধরনের প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিতে রাজি ছিল না। এতে বিপাকে পড়ে ৫ দলীয় ঐক্যজোট। কারণ ছাত্র নেতৃত্বের অধিকাংশ ৫ দলীয় জোটের সহযোগী ছিলেন। তখন অনানুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় ঐক্যজোট ৫ দলকে নির্বাচনি সমঝোতার প্রস্তাব দেয় এবং ৫০টির মতো আসনে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু ৫ দলীয় নেতাদের অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোটের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতায় আগ্রহী ছিলেন। ৮ দলীয় জোট ৫ দলীয় জোটকে ৫টি আসনে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করে। শেষ পর্যন্ত ৫ দল তার নিজস্ব জোট নিয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এক পর্যায়ে ৮ দল থেকে কয়েকটি প্রগতিশীল বামদল ৫ দলের সঙ্গে একসঙ্গে নির্বাচনী জোট করতে সম্মত হলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের আসন ভাগাভাগি সম্পন্ন হলে তারা আবার সেখানে ফিরে যায়। নির্বাচনে শুধু বিএনপি সমর্থক ছাত্রনেতারা জয়লাভ করেন। আমি নিজেসহ অন্যান্য দলভুক্ত ছাত্রনেতারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি। ৫ দলীয় ঐক্যজোট মাত্র ১টি আসনে জয়লাভ করে। বিএনপি সে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন না পেলেও একক বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে তারা সরকার গঠন করে।
২০২৪ সালের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানকে বোঝার জন্য আমি ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও তার পরবর্তী ঘটনাবলির প্রসঙ্গ টেনেছি। এ দুটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে মিল হলো ছাত্র আন্দোলনের ধাক্কাতেই স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে। কিন্তু প্রেক্ষাপট ও অন্যান্য বিষয়ে ২০২৪-এর ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে অনেকগুলো।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান গড়ে উঠেছিল ১৯৮২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও তার বর্ধিত রূপ সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে লাগাতার সংগ্রাম পরিচালনা করে। রাজনৈতিক দলগুলো তিনটি জোটে সংঘবদ্ধ হয়ে ৫ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে লিয়াজোঁ করে সমন্বিত সংগ্রাম পরিচালনা করে। শ্রমিক-কর্মচারী, আইনজীবী, চিকিৎসক, বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ কাঠামো গঠন করে নিজস্ব দাবি ও গণতন্ত্রের দাবিতে সংগ্রাম পরিচালনা করে। জনগণ জানত ছাত্র নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক নেতারা কী চাচ্ছেন। তবে আন্দোলনে অনেক উত্থান-পতনও হয়েছে।
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা ছয় বছরের, খুব বেশি দিনের নয়। ২০১৮ সালে ভিপি নূরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ছাত্র অধিকার পরিষদ বিভক্ত হয়ে ছাত্র শক্তি গঠিত হয়। সংগঠনগতভাবে তারা ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করে। তবে ছাত্র শক্তি এটা প্রকাশ্য করেনি। কারণ তারা প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠনগুলোকে আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে সযত্নে দূরে রাখে। তারা নির্দলীয় পরিচয়ে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংগঠিত করে। ৫ আগস্ট পর্যন্ত তারা তাদের আদর্শিক অবস্থান প্রকাশ্য করেনি। ফলে বাম-ডান-মধ্য নির্বিশেষে সব বিরোধী রাজনৈতিক দল ছাত্রদের পেছনে দাঁড়ায়।
তবে আন্দোলনের মূল সুর হিসেবে ছাত্র নেতৃত্ব দুটো বিষয়কে সামনে আনে। এক. ফ্যাসিবাদের পতনের পর যেন নতুন ফ্যাসিবাদ না আসে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা। দুই. বৈষম্যের বিরোধিতা।
ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তি রোধে ছাত্র নেতৃত্ব স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বদলের কথা বলেছেন। কিন্তু তার সুস্পষ্ট রূপরখা প্রদান ছাড়া এটা সফল হওয়া সম্ভব নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নকারী সংস্থাগুলোর কাঠামো ও ক্ষমতাকে আগের মতো বহাল রেখে শুধু লোক বদলিয়ে কি ফ্যাসিবাদী ক্ঠাামোর বিলোপ ঘটবে? ‘আয়নাঘর’র উদাহরণ দেওয়া যাক। সামরিক গোয়েন্দাদের গোপন বন্দিশালা কি আগে ছিল না? পাকিস্তান আমলে আগরতলা মামলা চলার সময় বঙ্গবন্ধুসহ অন্য অভিযুক্তদের তো সেনানিবাসের বন্দিশালাতেই রাখা হতো। স্বাধীনতার পর, বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে সামরিক শাসন শুরু হলে সেখানে বহুসংখ্যক বন্দিকে গোপনে আটকে রাখা হতো। যারা সম্প্রতি সেখান থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তাদের বর্ণনা অনুযায়ী সামরিক গোয়েন্দাদের গোপন বন্দিশালাই হলো সেই ‘আয়নাঘর’। আমি নিজেও ওই ‘আয়নাঘরে’ ১৯৭৬ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ও ১৯৮৩ সালে জেনারেল এরশাদের শাসনামলে গুম হয়ে বন্দি ছিলাম। র্যাবের বন্দিশালাসহ এ রকম গোপন বন্দিশালা আরও ছিল। ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে এসব অসংখ্য গোপন বন্দিশালা কি থাকবে? সরকারি বাহিনীর কর্মকর্তারা কি যে কোনো সময় যে কোনো নাগরিককে ‘অপহরণ’ করার অধিকার ভোগ করবেন? দিনের পর দিন গোপন বন্দিশালায় রাখতে পারবেন? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অধিকার ভোগ করবেন? এ রকম আরও অনেক প্রশ্নের জবাব নিয়েই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কার করতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বৈষম্য বিলোপের জন্য কী ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিয়ম-কানুন করতে হবে? এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কর্মসূচি না থাকলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মতো দৈনন্দিন কর্তব্যেও সফলতা আনা দুষ্কর হবে। সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিত অংশের প্রতি কী আশার বাণী আছে? শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনার আন্দোলনেকে চক্রান্ত বললে তো বৈষম্য দূর করা যাবে না!
১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান খুবই সীমিত লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছিল। কালক্রমে সেটুকুও আর অবশিষ্ট ছিল না। তাই ২০২৪ সালে বিপুল জনসমর্থনপুষ্ট একটা রাজনৈতিক দলের সরকারকে সামরিক সরকারের চেয়েও নিকৃষ্টভাবে বিদায় নিতে হলো। অপরদিকে বিপুল জনসমর্থনপুষ্ট আর একটা রাজনৈতিক দলের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব হলো না। এ থেকে কি আমরা শিক্ষা নেব না?
ড. মুশতাক হোসেন : স্থায়ী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ জাসদ; সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!