রেফারিদের দুঃখের কথা শোনার কেউ নেই

জাহিদ রহমান
০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
রেফারিদের দুঃখের কথা শোনার কেউ নেই

ফুটবল ম্যাচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিটি হলেন রেফারি। মাঠের কেন্দ্রীয় চরিত্রও তিনি। একটি ম্যাচকে নিরপেক্ষভাবে প্রাণবন্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য মাঠের সব প্রান্ত তাকে চষে বেড়াতে হয়। খেলোয়াড়দের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও দৌড়াতে হয়। প্রতিটি সেকেন্ড ও মিনিট ধরে বল আর খেলোয়াড়দের মুভমেন্টের ওপর তাকে তীক্ষè নজর রাখতে হয়। খেলা চলাকালীন সময়ে মাঠের রাষ্ট্রপতি তিনিই। হুইসেল বাজিয়ে যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই হবে। আবার একটুতে একটু নিরপেক্ষতার বরখেলাপ হলে তাকে শত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। ভুলের কারণে অনেক সময় রেফারিকে শাস্তিও পেতে হয়। তবে এটা সত্য, সব রেফারিই একটি ম্যাচকে প্রাণবন্ত এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করতে মাঠে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন।

ষাট-সত্তর-আশির দশকে ফুটবলের সোনালি দিনে আমাদের দেশের অনেক রেফারিই ছিলেন তারকাখচিত। বড় ম্যাচের আগে সে সব রেফারিকে নিয়ে রাজ্যের আলোচনা হতো গ্যালারিতে। ফুটবলমোদীদের মুখে মুখে ফিরত তাদের নাম। বিশেষ করে মোহামেডান আর আবাহনীর মধ্যেকার উত্তেজনাময় ম্যাচের রেফারি মানেই ছিল সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়বস্তু। ফুটবলের আলোকোজ্জ্বল সময়ে ম্যাচের আগেই ম্যাচ রেফারিকে নিয়ে ক্লাব ভক্তদের মাঝে চলত চুলচেরা বিশ্লেষণ। সহকারী রেফারিরাও বাদ যেতেন না। সেসব রেফারির নাম এখনও অমর-অক্ষয় হয়ে আছে। ফুটবলের যারা মহা অনুরাগী তাদের হৃদয় থেকে কিন্তু এখনও মুছে যায়নি কিংবদন্তী রেফারি ননী বসাক, জেড আলম, দলিল উদ্দিন, মহিউদ্দিন চৌধুরী, মুনির হোসেন, আতাউল হক মল্লিক, কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু, আব্দুর রশীদ, আব্দুল আজিজদের নাম। উল্লিখিতদের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। শুধু দেশে নয়, উল্লিখিত রেফারিরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার ক্ষেত্রেও বিস্তর সুনাম কুড়িয়েছিলেন।

দেশে ফিফার প্রথম চারজন রেফারি হলেন প্রয়াত ননী বসাক, মুনীর হোসেন, মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং নুর হোসেন। এই চারজনের কেউই বেঁচে নেই। এরপর আরও অনেকেই ফিফার রেফারি হয়ে নিজেকে অলঙ্কৃত করেছেন। প্রয়াত আব্দুল আজিজ, মনসুর আজাদ, তৈয়ব হাসান বাবুরাও ফিফার রেফারি হয়ে দেশকে গৌরবান্বিত করেছেন। ফিফা রেফারি তৈয়ব হোসেন বাবু যিনি দেশের রেফারি হিসেবে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। জাপান-কোরিয়ার মধ্যেকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ পরিচালনা করে তিনি আলোচিত হয়েছিলেন। এর আগে প্রয়াত রেফারি জেড আলম সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেন। ফুটবলের সোনালি দিনে ঢাকার মাঠে মোহামেডার ও আবাহনীর মধ্যেকার হাইভোল্টেজের ম্যাচ সবচেয়ে বেশি পরিচালনা করেছেন যশোরের রেফারি আনসারুল ইসলাম মিন্টু। সিনিয়রদের মাঝে তিনিই কেবল বেঁচে আছেন। যশোরের ঘোপে থাকেন। কঠিন কঠোর ব্যক্তিত্বের রেফারি আব্দুল আজীজের কথা অনেকেই ভুলে যাননি। আবাহনী-মোহামেডানের মধ্যেকার অনেক তীব্র গোলযোগপূর্ণ ম্যাচ সামাল দিয়েছেন তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে।

আমাদের দেশে রেফারিরা বরাবরই ভীষণ রকম অবহেলিত, বঞ্চিত। কখনই প্রাপ্ত আর্থিক সুবিধা বা সম্মানটা তারা পান না। বেশিরভাগ রেফারির আর্থিক দৈন্যতা চোখে পড়ার মতো। ম্যাচ পরিচালনা করার পর টাকার জন্যও তাদের দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। মাঠে শত ঝুঁকি নিয়ে খেলা পরিচালনা করলেও তাদের স্বাস্থ্যবীমা সুবিধা নেই। ঈদ, পূজা-পার্বণে তারা কোনো বোনাস বা বাড়তি কোনো সুবিধা পান না। পেশাদারিত্ব বলতে যা বোঝায় তার ছিটেফোঁটা নেই রেফারিংয়ে। রেফারিদের সেই দুঃখ আর বঞ্চনা প্রতিধ্বনিত হয়েছে বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথ আউয়াল আসার পর।

সম্প্রতি বাফুফের আওতাধীন রেফারিরা তাদের সম্মানী ও আনুষ্ঠানিক ভাতা বৃদ্ধির জন্য বাফুফের নবনির্বাচিত সভাপতি তাবিথ আউয়ালের দৃষ্টি সমর্থন করেছেন। গত ১৮ নভেম্বর ২৭ জন রেফারি স্বাক্ষরিত একটি বিধি তারা প্রেরণ করেন সভাপতি বরাবর। সেখানে তারা ফুটবলের নতুন মৌসুমের জন্য রেফারির ম্যাচ ফি বাবদ ৬ হাজার টাকা, সহকারী রেফারির ৫ হাজার ৮০০ টাকা এবং চতুর্থ রেফারির জন্য ৫ হাজার ৫০০ টাকা দেবার জন্য প্রস্তাব করেছেন। একই সঙ্গে তারা দৈনিক ভাতা বর্তমানে প্রাপ্ত ১৮০০ টাকার জায়গায় ৩০০০ টাকার দাবি করেছেন। যাতায়াতের ভাতাও দূরত্ব অনুযায়ী বর্তমানের ১০০০ থেকে ২০০০-এর স্থানে ১৫০০ থেকে ২৫০০ করার প্রস্তাবনা দিয়েছেন। প্রস্তাবনায় স্বাক্ষরকারী রেফারিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- আলমগীর সরকার, মো. নাসিরউদ্দিন, বিটুরাজ বড়ুয়া, মিজানুর রহমান, মো. জালালউদ্দিন, ভুবন মোহন তরফদার, আনিসুর রহমান, মনির ঢালিসহ অন্যরা। রেফারিরা বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং দৈনন্দিন ব্যয়ভার বিবেচনায় এখন তারা যে সম্মানী পান তা মোটেও যথেষ্ট নয়। এ কারণেই নতুন মৌসুমে তারা সম্মানীর জন্য নতুন এই প্রস্তাবনা পেশ করেছেন। এই প্রস্তাবনা নিয়ে এখন পর্যন্ত বাফুফেতে আলোচনা হয়নি। তবে রেফারিরা মনে করেন বর্তমান অর্থনৈতিক সময়ে তাদের এই দাবি বা প্রস্তাব শতভাগ যৌক্তিক। এদিকে রেফারিদের পাওনা অনেক টাকা বকেয়া রয়েছে বাফুফের কাছে। সে টাকা কবে পাবেন তাও কেউ জানেন না। বাফুফের কাছে রেফারিদের পাওনার পরিমাণ কোটি টাকা। এখন ম্যাচ শেষে ম্যাচ ফি পাওয়ারও কোনো সিস্টেম নেই। অনলাইন সিস্টেম ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে রেফারিরা জানিয়েছেন তারা ঠিকমতো প্রাপ্য সম্মানী পান না। সংসারের সুখের জন্য তারা অনেক ত্যাগ করলেও সেই ত্যাগের টাকা এখন তাদের কাছে সোনার হরিণ।

এ কথা সত্য আমাদের দেশে রেফারিং পেশাদারিত্ব লাভ করেনি বা সে পথে হাঁটেওনি। রেফারিদের যে মাঠে কত কষ্ট করতে হয় সে খবর অনেকেরই জানা নেই। সারা মাঠ জুড়েই বলের পেছনে পেছনে তাদের দৌড়াতে হয়। কেননা বল থেকে একটা নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে না থাকলে একজন রেফারির পক্ষে সঠিকভাবে বাঁশি বাজানো সম্ভব নয়। ফাউল, অফসাইড সঠিকভাবে ধরতে গেলে তীক্ষè নজরের পাশাপাশি সমান্তরাল অ্যাঙ্গেল থেকে বলের কাছাকাছিও থাকতে হয়। এর জন্য প্রতিটি রেফারির প্রয়োজন হয় শারীরিক ফিটনেসের। ফুটবলারদের মতো তাই রেফারিদেরও শারীরিক সক্ষমতা ঠিক রাখতে হয়। প্রতিদিন নিয়ম মেনে দৌড়াতে হয়, ভালো খাবার খেতে হয়। নির্দিষ্ট ব্যায়াম অনুশীলন করতে হয়। আবার ফিফা, এএফসির কাছে পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু এসব কিছুর কখনই খবর হয় না, সব থেকে যায় আড়ালে-আবডালে। শারীরিক ফিটনেস না থাকলে কোনো রেফারির পক্ষেই ফিফার শর্ত মেনে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। এ কারণেই ফুটবলারদের মতো রেফারিদেরও থাকতে হয় সক্রিয় ও সচেতন।

বাংলাদেশে রেফারিংটা এখনও পেশা হিসেবে স্বীকৃত বা সমাদৃত হয়নি বলে পার্টটাইম হিসেবেই সবাই করে থাকেন। এ কারণে এ দেশের সব রেফারিই জীবন-জীবিকার তাগিদে পাশাপাশি অন্য চাকরি করেন। বেশিরভাগ রেফারিই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজে ফিজিক্যাল ইন্সট্র্যাক্টর বা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ঢাকার মাঠে বহুবার রেফারিদের অপদস্ত হতে হয়েছে। অনেকেই শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকারও হয়েছেন। ডাগ আউট থেকে রেফারিদের অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজের ঘটনা শতবার ঘটেছে। আগে মোহামেডান ও আবাহনীর খেলায় সব সময় মহা আতঙ্কে থাকতেন রেফারিরা। একটু থেকে একটু হলেই তাদের ওপর ঝড় বয়ে যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রেফারি জানান, স্বাধীনতার পর এত বছর কেটে গেলেও দেশের ফুটবল রেফারিংয়ে পেশাদারিত্বের ছোঁয়া লাগেনি। ফলে রেফারিং এখনও পেশা নয়, নেশা। ভালো লাগা থেকেই সবাই করে থাকেন। কিন্তু মর্যাদা, সম্মানের জায়গাটাও এখানে খুব একটা বিস্তৃত হয়নি। বর্তমান সময়ে বাফুফের আওতাধীন একজন রেফারি ম্যাচ পরিচালনা করে পান ৪ হাজার টাকা। সহকারী রেফারি পান ৩ হাজার ৮০০ টাকা এবং চতুর্থ রেফারি পান ৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে গেলে অনেকটাই নামকাওয়াস্তে টিএ ও ডিএ মেলে। টিএ ও ডিএ-এর আর্থিক পরিমাণ খুব একটা বেশি না। অনেকেরই অভিযোগ ঢাকার বাইরে খেলা পরিচালনা করতে গেলে যে টিএ ডিএ দেওয়া হয় তাও অপ্রতুল। ওই টাকা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে যাওয়া, থাকা-খাওয়া হয় না। তবুও এসব মেনেই রেফারিং করতে হয়।

শত বঞ্চনা আর বৈষম্য নিয়েও রেফারিরা তাদের পেশার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু রেফারিদের সার্বিক সক্ষমতা না বাড়িয়ে তাদের প্রতি প্রায়ই আঙুল তোলা হয়। চ্যালেঞ্জ কাপে দেশের রেফারিদের বাইরে রেখে উদ্বোধনী ম্যাচ পরিচালনা করা হলো ভুটানের তিন রেফারি দিয়ে। এ নিয়ে দেশের রেফারিদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। এই বঞ্চনায় তারা অনেকেই ক্ষুব্ধ হন। বাফুফের উচিত দ্রুততম সময়ে রেফারিদের দায়-দেনা মেটানো, একই সঙ্গে রেফারিদের আর্থিক সচ্ছলতা এবং সক্ষমতা পূরণে উদ্যোগ গ্রহণ করা। নতুন সভাপতি রেফারিদের দুঃখ, কষ্ট ও দাবি আমলে নিয়ে বিষয়গুলো সমাধানে উদ্যোগী হলে ফুটবলের জন্য সেটা ভালো হবে।


জাহিদ রহমান : ক্রীড়া লেখক ও গবেষক