বিজয়ের মাস : ’৭১ ও ’২৪

ড. মোহীত উল আলম
০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বিজয়ের মাস : ’৭১ ও ’২৪

মাঝখানে ৫৩টি বছর। ’৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জিতে বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার দিন, ১৬ ডিসেম্বর আমরা যে পতাকা উড়িয়েছিলাম সেখানে পুরো বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত ছিল। কালক্রমে ওই ডিজাইনটার বদলে লাল সূর্যটা সবুজের বুকে স্থাপিত হওয়ার পর পতাকাটা ’২৪-এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় যখন বিপ্লবীদের কপালে ফেট্টির মতো জড়ানো থাকল তখন যেন সেটি নতুন প্রাণ পেল।

এটাই কথা। মুক্তিযুদ্ধের চরিত্রের কোনো স্থায়ী রূপ নেই। এটি যুগে যুগে পরিবর্তনশীল একটি গতিধারা, একটি প্রগতিমূলক বিপ্লবী শক্তি। যেখানে অন্যায়, সেটা ঠেকানোই মুক্তিযুদ্ধের প্রবহমান চরিত্র। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কায়মনোবাক্যে চাইতাম দেশটা কখন স্বাধীন হবে। একটা মহা আবেগের ফসল হলো দেশের জন্ম। কিন্তু আমরা সহসা বুঝলাম আবেগ দিয়ে দেশ স্বাধীন করা যায় ঠিক, কিন্তু আবেগ দিয়ে দেশ শাসন করা যায় না। ঠিক যেমন ক্রিকেট খেলায় দর্শকরা পতাকা নাড়িয়ে গ্যালারি দেশপ্রেমের আবেগে ভরিয়ে তুলতে পারে, কিন্তু খেলার মাঠে জিততে গেলে লাগে স্কিল এবং পারফরম্যান্স। সে জায়গায় ঘাটতি থাকলে শত আবেগেও মাঠে জেতা সম্ভব নয়।

৫ আগস্ট ২০২৪ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা যখন দীর্ঘ পনেরো বছরের সরকারকে হটিয়ে দিল, তখন ওই আবেগের ক্ষেত্রে নতুনভাবে প্রশ্নটা উঠল। কারণ সে জুলাই ৩৬-এর আবেগটা ছিল বিন্দু থেকে সিন্ধুতে রূপান্তরিত হওয়া একটি মহা আবেগ, যার সামনে মহাশক্তিধর একটি স্বৈরশাসনপ্রবণ সরকার খড়কুটোর মতো ভেসে গেল।

তবে এই মহাশক্তিধর সরকার পতনের প্রথম কারণটি ছিল বাক-স্বাধীনতা হরণ, বিশেষ করে ভোটাধিকার হরণ। আমার মনে আছে ’১৮ সালের জাতীয় সংসদের নির্বাচনের দিন সকালে এক বন্ধুসহ নির্বাচন কেমন হচ্ছে দেখতে বের হয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে প্রথমে মুসলিম হল প্রাঙ্গণে একজন সরকারদলীয় প্রার্থীর নির্বাচনী সদর দপ্তরে গেলাম। সবাই পরিচিত। তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। একজন সরকারদলীয় প্রার্থীর রাজনৈতিক নেতা যিনি সংযোগ রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি ফোনে আলাপরত ছিলেন। ফোনটি খুশি মনে রেখে তিনি আমাদের উল্লাসভরে জানালেন, অমুক উপজেলা কমপ্লিট। অর্থাৎ ভোটের কর্ম সারা। এই কথা শুনে আমার খুব কষ্ট হলো। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আন্দরকিল্লাহ্র মোড়ে গেলাম। দেখা আমার এক কবি বন্ধুর সঙ্গে। ও একটা ঘটনা বলল। ওর কাকারা পরিবারের ভোট মোট সাতাশ জনের। তারা দল বেঁধে ভোটকেন্দ্রে গেলেন। সেখানে তাদের বলা হলোÑ কাকা, কষ্ট করে কেন এসেছেন, আপনাদের ভোট রাতেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি তখনই বুঝে ফেললাম, এই সরকারের পতনের দিন শুরু হয়েছে। এই কথাটা আমার কাছের সহকর্মীদের সঙ্গে শেয়ারও করলাম। তখন বুঝলাম, ঐশ্বরিক বিধান কী! যে সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় সেটিই হলো বস্তুত আইরনিক্যালি পূর্বতন সরকারের পতনের কারণ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করে পূর্বতন সরকার ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু আইরনিক্যালি বরং যেটা প্রমাণিত হলো সেটি হলো যে, গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সংবিধান পর্যন্ত টেকে না। পূর্বতন সরকার ওই সংশোধনীর সুবাদে বস্তুত কুশাসনের পথ বেছে নেয়। স্বেচ্ছাচারিতা তখন শাসকমহলের কাছে উপাদেয় মনে হয়। কিন্তু ঐশ্বরিকভাবে যেন তারা ঠিক এসব কুকর্মের জন্যই পতিত হয়। এটা প্রায় ইতিহাসের নিশ্চিত শিক্ষা যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় অনৈতিক কাজ করলেই তার জন্য নির্মম ফল ভোগ করতে হয়। পূর্বতন সরকার শুধু যে নির্বাচনব্যবস্থা তছনছ করে দিয়েছিল তা নয়, ব্যাংকিং এবং বিচারব্যবস্থাও তছনছ করে দিয়েছিল। নিষ্পেষণ, নিপীড়ন, অনাচার, বাক-স্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি তো ছিলই, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার ধারাবাহিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। এর কাফফারা বাংলাদেশকে অনেকদিন দিতে হবে।

তা হলে ’৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫৩ বছরের মধ্যে গত পনেরো বছরের স্বৈরশাসনের অনাচারের ফলে দেশ ভুগেছিল বলে ’২৪-এর জুলাই ৩৬-এর ছাত্র-জনতার বিজয় এই কথা ঘোষণা করল যে, ’৭১-এর বিজয়কে ’২৪-এর বিজয় দিয়ে নতুন রূপে রাঙিয়ে দেওয়া হলো।

দুই বিজয়ের প্রেক্ষাপট দুই রকম, কিন্তু চরিত্র অভিন্ন। ’৭১-এর আন্দোলন ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি আধা-ঔপনিবেশিক প্রপীড়িত বুভুক্ষু জাতিকে স্বাধীনতার সনদ এনে দেওয়া, আর ’২৪-এর বিজয় হলো ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে একটি মিথ্যা আশ্বাসে প্রবঞ্চিত জাতিকে মুক্তি দেওয়া। দুটো আন্দোলনেরই মুল স্পিরিট হলো মুক্তিÑ দেশ মুক্তি এবং অপশাসন থেকে মুক্তি।

শুরুতে বলেছিলাম যে, একটি মহা আবেগের ফসল হলো মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, তেমনি একটি মহা আবেগের ফসল হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিক্ষুব্ধতার মুখে স্বৈরাচারী জগদ্দল পাথর থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্তি দেওয়া।

কিন্তু আগেই বলেছি, আবেগ দিয়ে দেশ মুক্ত করা গেলেও দেশ শাসন করা যায় না। দেশ চালাতে গেলে প্রয়োজন সর্বোচ্চ মেধা ও কৌশলের প্রয়োগ এবং অ্যাকোমডেটিভ অ্যাপ্রোচ। ‘স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি’ বলে মাইকে বলে বেড়ালাম, কিন্তু এদিকে দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগামিতা রোধ করা যাচ্ছে না, এটি হলে মানুষকে রাস্তায় নামা থেকে বিরত রাখা যাবে না। গত (২৯-১১-২৪) রাতে একটি বেসরকারি টিভির খবরে দেখলাম আলুর দাম প্রতি কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়েছে। সেখানে ভোক্তা সমিতির একজন প্রশাসক জানালেন, যেসব কারণে আলুর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মজুদদারদের সিন্ডিকেট। তিনি বললেন, বাজারের ওপর খবরদারি করে লাভ নেই, রেগুলেট করতে হবে উৎসে, যারা আলু সংরক্ষণ করছে বা হিমায়িত করছে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তিনি বললেন, সাপ্লাই চেইন অব্যাহত রাখা হচ্ছে সরকারের দায়িত্ব। তিনি আরও বললেন, মধ্যস্বত্বভোগীরা আবার চাঁদাবাজি শুরু করেছে। অর্থাৎ আগে যারা একদলীয় পরিচয়ে চাঁদাবাজি করত, এখন নতুন আরেক দল এসে চাঁদাবাজি করছে কিংবা পুরনো ফেরেববাজরাই হয়তো নতুন নাম নিয়ে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। নতুন বোতলে পুরনো মদ হলে তো হবে না।

সরকারের নিয়ন্ত্রণে বাজারের সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখা এখন সর্বাগ্রে করণীয় দায়িত্ব। ৩৬ জুলাইয়ের সফল ধারাবাহিকতা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে জনমানুষের পেট শান্ত থাকার ওপর।

নানান কারণে ভারতীয় প্রচারমাধ্যম ও সরকার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটানা অপপ্রচার করে যাচ্ছে। এটির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম অর্থনৈতিক কারণ আছে। ঠিক জানি না, কিন্তু ধারণা হয় যে পূর্বতন সরকারের সময় ভারত রাষ্ট্র কিছু অযৌক্তিক অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা (যেমন আদানির সঙ্গে বৈষম্যমূলক চুক্তি) পেত, যেটি এখন বন্ধ হয়েছে। স্বভাবতই ভারত রাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হতে পারে। তারা যে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা চাউর করে বেড়াচ্ছে, যেটার তলায় সত্যতার চেয়ে অসত্যতা বেশি, এটি হলো মুখোশ, আসলে বাড়ি পড়েছে সে অর্থনৈতিক অন্যায্য সুবিধা গ্রহণের কলজেতে। একটা কথা রাজনৈতিকভাবে বিশ্বাস করতে হবে, সেটি হলো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্কটা হয় শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক। যে কোনো দ্বিরাষ্ট্রিক সম্পর্ককে ব্যবচ্ছেদ করলে দেখা যাবে গ্লাসের তলায় আব পড়ার মতো কারণটি হচ্ছে অর্থনৈতিক।

এই বিজয়ী সরকারের জন্য গুরুতর আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যদি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী বীজ এখনও ছাত্র-জনতার মধ্যে বিরাজিত থাকে, যদি মনোবল অটুট থাকে যে প্রশাসনিকভাবে সব রকম বিশৃক্সক্ষলা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তা হলে তারা বছর তিনেক সময় নিয়ে যাবতীয় ঈপ্সিত সংস্কার করে দেশকে একটি স্বচ্ছ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। এবং আমার একটি অযাচাইকৃত ধারণা হলো দেশের বেশির ভাগ মানুষ সংস্কার চায়। কেননা একই নির্বাচনের ধরনে দেশ আবার রাজনৈতিকভাবে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হোক তারা সেটা চায় না।

আর যদি তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) মনে করে যে দেশ চালানোর কঠিন চ্যালেঞ্জটা তারা শেষ পর্যন্ত নিতে পারছে না, তা হলে বছরখানেকের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দেওয়াই ভালো।

আর পরিশেষে বলি, নির্বাচন যখনই হোক, কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা আমি একদম সমর্থন করি না। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করাই হবে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কাজ। অপরাধের জন্য অপরাধী শাস্তি পাক, কিন্তু দল নয়।

বিজয়ের মাস দেশ ও মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনুক, এই কামনায় শেষ করছি।

বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।


ড. মোহীত উল আলম : শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক