জলপাই শাখার সঙ্গে চাবুকও চাই
বাংলাদেশে এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। তিনি একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সরকারপ্রধান। বাংলাদেশি হিসেবে এটা আমাদের জন্য গৌরবের। কিন্তু মিষ্টি কথায় যেমন চিঁড়া ভিজে না, তেমনই কেবল গৌরব দিয়ে পেট ভরে না। নোবেলজয়ীর হাতে দেশ কেমন চলছে সেটাই বড় কথা।
প্রবল এক ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়ের রথে চড়ে দায়িত্ব নিয়েছে ড. ইউনূসের সরকার। এ অভ্যুত্থান খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে অকল্পনীয় এক দুর্বার শক্তি অর্জন করে। তাতে নিমিষেই উড়ে যায় হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের জগদ্দল পাথর। এর আগে টানা সাড়ে পনেরো বছর ধরে শেখ হাসিনা বজ্রমুঠিতে চালিয়ে গেছেন তার নিষ্ঠুর রেজিম। গণতন্ত্রহীনতা, নির্বাচনের নামে প্রহসন, হত্যাযজ্ঞ, গুম-অপহরণ, নির্যাতন, অজস্র মিথ্যা মামলায় অসংখ্য ভিন্নমতাবলম্বীকে কারাগারে নিক্ষেপ, দখলদারি, দলীয়করণ, সীমাহীন লুণ্ঠন ও দুর্নীতি এবং ন্যায়বিচারের কবর রচনার মধ্য দিয়ে এই শাসন নজিরবিহীনভাবে কলঙ্কিত হয়েছিল। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা অন্য কোনো ধরনের প্রতিবাদ জানানোর জো ছিল না। আন্দোলন ডানা বাঁধতে দেখলেই তা অস্ত্রের ভাষায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হতো।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত কোটা কমিয়ে এনে মেধাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার দাবিতে ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক একটা আন্দোলন গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য কোটা কমানোর দাবি করায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ আখ্যা দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা রেজিম তাদের সমর্থক ছাত্র সংগঠনকে আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রদের ওপর লেলিয়ে দেয়। বলা হয়, ওদের দমনের জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। এই ছাত্রলীগ গত ১৫ বছর ছাত্রদের ওপর জুলুম-নিপীড়ন চালিয়ে তাদের দমিয়ে রেখেছে। অনেক প্রতিবাদীকে মেরেও ফেলেছে। ওরা ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ত্রাস ও যমদূততুল্য। তাদের হাতুড়ি-চাপাতি-হেলমেট বাহিনী বলা হতো।
ওদিকে নির্যাতিত হতে হতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধৈর্যের সব বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। তারা সম্মিলিত হয়ে ছাত্রলীগের হামলা মোকাবিলা করে। তাদের প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগকেই ক্যাম্পাস ছেড়ে পালাতে হয়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পাততাড়ি গুটাতে বাধ্য হলে ক্যাম্পাসে হামলা চালায় পুলিশ। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস থেকে তাড়িয়ে দেয়। এতে আন্দোলন থেমে যাওয়ার বদলে সবখানে ছড়িয়ে যায়। তারা রাস্তায় গড়ে তোলে প্রতিরোধ। কিন্তু তাদের পাখির মতো গুলি করে মারতে থাকে শেখ হাসিনার বাহিনী। ছাত্র-তরুণদের ওপর এমন বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালাতে দেখে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ তাদের সন্তানদের প্রাণরক্ষায় নেমে আসে রাজপথে। সেই গণপ্রতিরোধে পুলিশ, আনসার, র্যাব, সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে পিছু হটতে হয়। তখন কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট বন্ধ করে সেনাদের নামানো হয় দেখামাত্র গুলির হুকুম দিয়ে। কিন্তু অচিরেই সেনারা সাধারণ নাগরিকদের বুকের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে। আর এতেই শেখ হাসিনার ক্ষমতার খেল খতম হয়ে যায়। ধেয়ে আসা ক্রোধোন্মত্ত জনস্রোতের হাত থেকে বাঁচতে তাকে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
শেখ হাসিনার শাসন এমন এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক অঘোষিত রাজতন্ত্র গড়ে তুলেছিল যে, তিনি পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সবকিছু ভেঙে পড়ে। পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব অঙ্গ সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে। এই নজিরবিহীন অবস্থায় ইউনূস সরকারকে রাষ্ট্রপরিচালনার কঠিন দায়িত্ব নিতে হয়। ধীরগতিতে হলেও মাত্র একশ দিনের মধ্যে সরকার সব বিপর্যয় ও ধকল সামলে উঠে নৈরাজ্যিক অবস্থা অনেকটাই আয়ত্তে এনেছে। অচল হয়ে পড়া রাষ্ট্র অনেকটাই সচল হয়ে উঠেছে। সবার আশঙ্কা ছিল, শেখ হাসিনা রেজিমের পরিবর্তন হলে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে, লাখ লাখ মানুষ খুন হবে। অথচ তেমন কিছুই ঘটেনি। পতিত ফ্যাসিবাদের দোসররা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির অপচেষ্টা চালালেও সরকার জনগণের সহায়তায় তা ব্যর্থ করে দেয়। পুলিশ ও আনসারের মতো বাহিনীতে বিদ্রোহ সৃষ্টির উসকানিও ব্যর্থ করে দেওয়া হয়। গার্মেন্টশিল্পে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার অফিস দখলের কয়েক দফার উদ্যোগ অসফল হয়। তবে এখনো নৈরাজ্য ও অরাজকতা সৃষ্টির বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত চেষ্টা থামেনি।
প্রায় ষোলো বছরের স্বেচ্ছাচারী অরাজকতার পর বাংলাদেশে পটপরিবর্তন ঘটলে অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু দ্রুততম সময়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতি প্রায় স্থিতিশীল করে এনেছে। দেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ধীরে ধীরে গতি ফিরছে এবং অর্থনীতির কয়েকটি সূচক ইতিবাচক ধারায় চলে এসেছে। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বেড়েছে। স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রয়েছে রপ্তানি আয়। অস্থির ডলারের বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনও কমার দিকে। যানজটের দুঃসহ পরিস্থিতির তেমন উন্নতি না হলেও বিদ্যুৎ খাতে বিরাট রকমের বিপর্যয়ের আশঙ্কা কিছুটা সমঝে চলতে পারছে সরকার।
তবে সব কৃতিত্ব খেয়ে ফেলছে নিত্যপণ্যের বাজারদরের ফটকাবাজি। বন্যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শস্য ও সবজির যে ক্ষতি হয় তাকে পুঁজি করে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বেসামাল কাঁচাবাজার। দামের চাপে নিম্নআয়ের মানুষের ত্রাহি দশা। ডিমের দামের কারসাজি নিয়ন্ত্রণে আনতেই পেঁয়াজ, চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আলুর দাম দফায় দফায় বাড়তে থাকে। সরকার অতিপ্রয়োজনীয় ছয়টি পণ্যের শুল্ক কর কমানোসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও তেমন সুফল মেলেনি। কারণ আমদানি এবং পুরো বিপণন ব্যবস্থা ও বাজার এখনো পতিত ফ্যাসিবাদের দোসর ও অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
শেখ হাসিনার আমলে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বিভিন্ন সময়ে হুটহাট বাড়িয়ে তার প্রিয় অলিগার্ক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বিপুল ফায়দা লুটত। যেমন ডিমের ডজন ২০০ ছুঁয়েছিল। সব রকম গোশতের দাম অনেক বেড়েছিল। কাঁচামরিচ ১৪শ টাকা কেজি হয়েছিল। আলুর কেজি ৮০ টাকা ও নতুন আলু কেজিতে ৪শ টাকা দরে বিকিয়েছে। পেঁয়াজের কেজি উঠেছে আড়াইশ টাকায়। বেগুনও রোজায় দেড়শ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়েছে। তখন শেখ হাসিনা বিকল্প রেসিপি দিয়েছেন অথবা বলেছেন, ‘ওসব না খেলে কী হয়?’ এখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ওই রেকর্ড না ভাঙলেও পতিত লীগের দোসরদের প্রোপাগান্ডা ও গুজব অতীতের সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে দেশ চালাতে গিয়ে ড. ইউনূসের মতো একজন দক্ষ ম্যানেজারকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে এত বহুমুখী চক্রান্তের মুখেও তিনি তার স্বভাবসুলভ মহত্ত্ব, উদারতা ও ধৈর্য অটুট রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। ফ্যাসিবাদের শিখণ্ডীদের বিচারের আয়োজন শুরু হলেও তিনি অলিগার্কদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেননি। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অবস্থানে শেখ হাসিনার যেসব বর্ণচোরা দোসর বসে এখনো ঘোঁট পাকাচ্ছে এবং যারা নানারকম প্রোপাগান্ডা ও গুজব রটিয়ে পরিবেশ কলুষিত করে চলেছে তাদের ব্যাপারেও সরকারের কোনো সক্রিয় ভূমিকা নেই। এই অতিসহনশীলতা কেবল সরকারের নয়, দেশের স্থিতিশীলতার জন্যও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সুশাসনের মূলমন্ত্র হচ্ছে, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। যারা সুনাগরিক তাদের প্রতি উদারতা, ধৈর্য ও মহত্ত্ব অবশ্যই প্রদর্শন করতে হবে। একই সঙ্গে তীক্ষè নজর রাখতে হবে এগুলো যেন কোনোক্রমেই অপাত্রের প্রতি প্রদর্শিত না হয়। দুষ্টের দমনে কঠোর হতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। ড. ইউনূস সুনাগরিকদের জন্য তার হাতে জলপাই শাখা ধারণ করেছেন। তা নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু দুর্বৃত্ত দমনে আমরা তাকে আরেক হাতে শক্ত করে চাবুক ধরতে বলছি।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
মারুফ কামাল খান : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেস সচিব