অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা : ভবিষ্যৎ মহামারীর লক্ষণ

ডা. কাকলী হালদার
২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা : ভবিষ্যৎ মহামারীর লক্ষণ

রফিক সাহেবের ১০ দিনের ছোট্ট শিশু ভর্তি পিআইসিইউতে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ত্রিশ বছরের নিয়াজ একমাস ধরে ভর্তি হাসপাতালে, আবার ৫০ বছরের রমিজ ক্যানসার জটিলতায় আইসিইউতে ভর্তি আছেন পনের দিন ধরে।

তাদের প্রত্যেকের শরীরে যে ধরনের জীবাণু দিয়ে ইনফেকশন বা রোগ-সংক্রমণ হয়েছে সেসব জীবাণুর বিরুদ্ধে সব রকম অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর। আমাদের হাতে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক থাকা সত্ত্বেও কোনো ওষুধই এসব জীবাণুকে ধ্বংস করতে পারছে না! এসব ক্ষেত্রে আমরা নিরুপায়!!

প্রতিবছর ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস রেজিস্ট্যান্স সচেতনতা সপ্তাহ’ পালন করা হয়। দিবসটির এবারের স্লোগান ছিলÑ ‘নিজে জানুন, অন্যকে জানান, প্রতিরোধের এখনই সময়।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে,  প্রতিবছর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সে সারাবিশ্বে প্রায় পৌনে ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। ধারণা করা হয় এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১ কোটিতে দাঁড়াবে।

যে কোনো মহামারি একদিন শেষ হয় কিন্তু সর্বক্ষেত্রে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস (অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক) ওষুধের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যৎ পৃথিবী আরও এক কঠিন এবং মর্মান্তিক সময়ের মুখোমুখি হবে।

হয়তো এমন দিন খুব কাছেই যেদিন হাতে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক থাকা সত্ত্বেও অনেক মুমূর্ষু রোগীকে আমরা চিকিৎসাই দিতে পারব না! কারণ, যে জীবাণু দিয়ে সে আক্রান্ত তা সব ধরনের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী বা কাজ করছে না।

যদিও জীবনরক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালসের কোনো বিকল্প নেই। ভিন্ন ভিন্ন জীবাণু দিয়ে যে ইনফেকশনই হোক না কেন, তার প্রতিকারে এসব ওষুধ কার্যকর। তবে বিনা প্রয়োজনে, ওষুধের ডোজ বা কোর্স সম্পন্ন না করে এসব ওষুধ ব্যবহার করলে তখন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস রেসিস্ট্যান্ট বা প্রতিরোধী জীবাণু তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে এসব অ্যান্টিমাইকোবিয়ালস ওষুধ জীবাণুর বিরুদ্ধে আর কাজ করতে পারে না। সুতরাং জীবন বাঁচাতে হলে এসব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস ব্যবহারে সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীকে সচেতন হতে হবে এবং নিয়ম মেনে জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এসব ওষুধের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

যেসব জীবাণু একাধিক অণুজীব-বিরোধী ওষুধের বিপক্ষে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে তাদের এমডিআর (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স বা একাধিক ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী) প্রয়োগ করা হয়। আবার যেসব জীবাণু ব্যাপকভাবে ওষুধের বিপক্ষে প্রতিরোধী তাদের এক্সডিআর (এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স বা ব্যাপকভাবে ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী) ব্যবহার করা হয়। আবার জীবাণু যখন সম্পূর্ণভাবে ওষুধের বিপক্ষে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে তখন এসব জীবাণুকে পিডিআর (প্যান

ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স বা পুরোপুরিভাবে ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী) বলা হয়। সব ধরনের অণুজীবই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালসের বা অণুজীব বিরোধী ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।

যেসব কারণে অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা বৃদ্ধি পেতে পারে :

মূলত অপ্রয়োজনে বা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া স্বেচ্ছায় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ।

সঠিক নিয়মে ওষুধের পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন না করলে, নিম্নমান এবং ভুল ওষুধ সেবন।

বিশুদ্ধ খাবার পানি ও ভেজালমুক্ত খাবারের অপ্রতুলতার কারণে অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা বৃদ্ধি পেতে পারে।

এছাড়াও গবাদিপশু, মৎস্য ও পোল্ট্রিতে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার, নতুন নতুন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস আবিষ্কার এবং বাজারজাত করার সম্ভাবনা কমে যাওয়া।

ঘরে-বাইরে এবং হাসপাতালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলাও বড় কারণ।

প্রতিরোধে সবারই ভূমিকা দরকার

অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা ধরে রাখতে চাইলে শুধু রেজিস্টার্ড চিকিৎসকগণের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক ক্রয় ও সেবন করতে হবে। ব্যবস্থাপত্রের মাধ্যমে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকগণ যেমন ভূমিকা রাখতে পারেন, তেমনি ব্যবহারকারীরাও সঠিক নিয়মে এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমিকা রাখতে পারেন। মনে রাখতে হবে অযথা, ভুল অথবা নিয়ম না মেনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার শারীরিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে বিরাট ক্ষতির কারণ। তাই নিজেদের স্বার্থেই ওষুধের এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে সরাসরি ওষুধের দোকান, হাতুড়ে ডাক্তার ও অন্য কোনো রোগীর ব্যবস্থাপত্র মোতাবেক কোনোভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক ক্রয় বা সেবন করা যাবে না।

পাশাপাশি মাছ, হাঁস, মুরগি ও গবাদিপশুর খামারে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ করা অতীব জরুরি। কারণ, এসব খাবার খাওয়ার মাধ্যমে আমরাও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুতে আক্রান্ত হতে পারি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ বলে, বিশ্বে যে পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হয় তার অর্ধেকই ব্যবহার করা হয় গবাদিপশু উৎপাদনে।

এমতাবস্থায় অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার প্রতিরোধে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাক্ষাৎকার, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ছাড়াও চিকিৎসক, ওষুধ ক্রেতা-বিক্রেতা, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ ও যুব প্রতিনিধির অংশগ্রহণে মূল ধারার গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক সংলাপ বা আলাপচারিতা অনুষ্ঠান প্রচার করা দরকার। এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।


ডা. কাকলী হালদার : সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।