কেবল আত্মত্যাগ নয় সঠিক আন্দোলন চাই

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
কেবল আত্মত্যাগ নয় সঠিক আন্দোলন চাই

একাত্তরে দাঙ্গা হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে। বাঙালি বিভক্ত হয়নি, ঐক্যবদ্ধ ছিল। এ যেন সাতচল্লিশের সেই ভুলের সংশোধন। এবার দেশভাগের প্রশ্ন নেই, এবারের প্রশ্নটা রাষ্ট্রকে ভাঙার। রাষ্ট্র ভাঙল। এলো স্বাধীনতা। কিন্তু তার পর? তার পর দেশপ্রেমের পতন ঘটেছে। কিন্তু কেন? এবারও দায়িত্ব নেতৃত্বেরই। না, যত দোষ নন্দ ঘোষের নয়, পতনের জন্য নেতারাই দায়ী। দোষ তাদেরই। তারা লড়াইতে যেতে চায়নি। যুদ্ধ নয়, তারা চেয়েছিল স্বায়ত্তশাসন, যার অর্থ তাদের জন্য অবাধ স্বাধীনতা; অন্যকিছুর নয়, লুণ্ঠনের। তাদের আন্তরিক দীক্ষা ছিল পুঁজিবাদে। সেই দীক্ষাটাকে যুদ্ধের সময়ে প্রকাশ না করলেও বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত করেছে। উন্মোচনেরও দরকার হয়নি, আপনাআপনি বের হয়ে পড়েছে। দেশপ্রেম ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে পুঁজিবাদের দাপটে। যুদ্ধ-পরবর্তী পুঁজিবাদীরা লড়াই করেছে নিজেদের মধ্যে, ক্ষমতার (অর্থাৎ লুণ্ঠনের অধিকারের) ভাগাভাগি নিয়ে। পাকিস্তানিদের সঙ্গেও তাদের লড়াইটা ছিল ওই ভাগাভাগি নিয়েই। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই সাঙ্গ করা যাবে বলে ভরসা করেছিল।

জনগণের লক্ষ্যটা ছিল ভিন্ন। তারা ক্ষমতার ভাগ পাবে এটা আশা করেনি; ওই লোভে যে উত্তেজিত হয়েছে তাও নয়। তাদের আশাটা ছিল মুক্তির। স্বায়ত্তশাসনের নয়, ক্ষমতার হস্তান্তরেরও নয়, তাদের জন্য স্বপ্নটা ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির। তারা আশা করেছে এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র পাবে যেখানে মানুষে মানুষে সম্পদ, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে বৈষম্য থাকবে না; কেউ কারও শত্রু হবে না, সবাই হবে সবার মিত্র। বলা বাহুল্য জনগণ মুক্তি পায়নি।

পুঁজিপন্থীরা কিন্তু স্বাধীনতা পেয়ে গেল। তারা আরও ধনী হলো। তাদের ধনসম্পদ বৃদ্ধি পেল অবিশ্বাস্য গতিতে। তাদের সংখ্যাও যে খুব সীমিত রইল তা নয়, বেশ বেড়ে গেল। কিন্তু জনগণের সংখ্যার তুলনায় তারা অবশ্যই অল্প। তবে তাদের দাপট অসম্ভব প্রবল। বাংলাদেশ এখন সেই দাপটে থর থর করে কাঁপে।

জনগণ দেখল নতুন রাষ্ট্রের চেহারা আগের রাষ্ট্রের চেয়ে ভয়ঙ্কর। এ রাষ্ট্র শাসকশ্রেণির অধীনস্থ তো বটেই, কিন্তু রীতিমতো সন্ত্রাসীও বৈকি। সাতচল্লিশের পর বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল, এবারও হলো; নিজের দেশের মধ্যেই তারা গৃহহীন, আশ্রয়হীন। তাদের দেশ নেই, দেশ চলে গেছে অন্যদের হাতে, যাদের হৃদয় ও মস্তিষ্কে দেশের জন্য কোনো স্থান অবশিষ্ট নেই। বাংলাদেশে এখন দেশপ্রেমিক বলতে শ্রমজীবী মানুষকেই বোঝায়। এই মানুষরাই উৎপাদন করে। দেশকে এরাই টিকিয়ে রেখেছে এবং দেশের বাইরে এদের জন্য কোথাও কোনো স্থান নেই। যতই গৃহহারা হোক এই মানুষরাই গৃহী এবং দেশপ্রেমিক। আর উদ্বাস্তু হচ্ছে তারা যাদের ধন-সম্পত্তি অনেক। বস্তুত যার বিত্তবেসাত যত অধিক সে-ই তত বড় উদ্বাস্তু, আমাদের এই বাংলাদেশে। এদের আদর্শ এদেশ নয়, আদর্শ হচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্ব। মানুষের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান বিনিয়োগ হচ্ছে সন্তান-সন্ততি; সেই বিনিয়োগ এরা দেশে করে না, করে বিদেশে। সন্তানরা বিদেশে যায় পড়ালেখার অজুহাতে, গিয়ে আর আসে না, এলেও আগমনটা বিদেশির মতোই, অবস্থানও সেই প্রকারেরই। ধনীদের জন্য বাংলাদেশ এখন এক প্রকারের জমিদারি। জমিদারদের তবু সরকারি তহবিলে খাজনা দিতে হতো, এরা সেটাও দেয় না।

পুঁজিবাদের দাসানুদাস এই শাসক শ্রেণিই দেশপ্রেমের অবনতির জন্য দায়ী। তারাই হচ্ছে দৃষ্টান্ত। তারা তাদের আদর্শকে জনগণের ভেতর ছড়িয়ে দিয়েছে। মানুষকে যতভাবে পারা যায় উদ্বুদ্ধ করছে আত্মস্বার্থসর্বস্ব ও ভোগবাদী হতে। উসকানি দিচ্ছে সবকিছু ভুলে কেবল নিজের কথা ভাবতে। মানুষকে নিয়ে এসেছে বাজারে। সর্বোপরি সর্বক্ষণ ব্যস্ত রাখছে জীবিকার সন্ধানে। যাতে অন্য কিছু ভাবার সময় না হয়, বিশেষ করে শাসকশ্রেণির অত্যাচার যেন চোখের বাইরে থাকে।

বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি দুটি কাজ খুব দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে, একটি বেকার সৃষ্টি অপরটি মাদ্রাসার শিক্ষার বিস্তার। দুটোই দেশপ্রেমের বিকাশের পথে মস্ত বড় অন্তরায়। এ দেশের ধনীরাই হচ্ছে শাসক এবং তারা বিনিয়োগ করে না, লুণ্ঠন করে। তাদের লুণ্ঠন তৎপরতায় বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। জনগণের আয় এরা ব্যাংকের মাধ্যমে কিছুটা, কিছুটা নানাবিধ প্রতারণার ভেতর দিয়ে আত্মসাৎ করে ফেলে। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে না। লোক বাড়ছে, কাজ বাড়ছে না; অথচ করার মতো কাজের কোনো অবধি থাকার কথা নয়, আমাদের মতো অনগ্রসর দেশের। সরকার আসে যায়, কিন্তু কোনো সরকারকেই দেখা যায় না কাজ সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হতে। পুঁজিবাদ এমনিতেই শ্রমিকবিরোধী, শ্রমঘন উৎপাদনকে যে ঘৃণা করে, তার পক্ষপাত প্রযুক্তি ঘন উৎপাদনের প্রতি। বাংলাদেশি পুঁজিবাদ উৎপাদনে বিশ্বাসই করে না, তার নির্ভরতা লুণ্ঠন ও ব্যবসায়। বলা বাহুল্য ব্যবসা জিনিসটাও লুণ্ঠন ভিন্ন অন্য কিছু নয়।

যে মানুষটি বেকার তার তো কোনো দেশপ্রেম থাকার কথা নয়। দেশ তো তাকে কিছুই দিচ্ছে না, বিড়ম্বনা ভিন্ন। তার সার্বক্ষণিক চিন্তা নিজেকে নিয়ে। বেকার মানুষের মতো আত্মপ্রেমিক সংসারে সত্যি বিরল। বেকারে যখন দেশ ছেয়ে যাচ্ছে, দেশে তখন দেশপ্রেমের বন্যা বইবে এমনটা আশা করা মোটেই যুক্তিসম্মত নয়।

আর আছে মাদ্রাসা শিক্ষা। এই শিক্ষা বেকারত্ব বৃদ্ধির কারখানা বৈকি। এ দেশের ধনীরা নিজেদের সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠাবে এটা চিন্তা করলেও ভয়ে শিউরে উঠবে, কিন্তু তারা অবিরাম ও বর্ধমান গতিতে মাদ্রাসা শিক্ষাকে কেবল যে উৎসাহিতই করছে তা নয়, নিজেরাও বিপুল উৎসাহে মাদ্রাসা খুলছে। একটি হিসাবে দেখলাম ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বিশ বছরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে বেড়েছে তিনগুণ, সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বেড়েছে আটগুণ; ওদিকে বিজ্ঞানের ছাত্রের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। এ শিক্ষা গরিবের সঙ্গে মস্ত একটা মশকারা বটে। মূর্তিমান ষড়যন্ত্রও।

ওদিকে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা লক লক করে বেড়ে চলেছে। মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার আকাশ-পাতাল ব্যবধান; একটি ‘সর্বাধুনিক’ অন্যটি অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। কিন্তু মিলও রয়েছে। মিলটা অন্তঃসারশূন্যতা ও কৃত্রিমতায়; এবং সব দেশের প্রতি বিমুখতায়। ইংরেজি মাধ্যম তাকিয়ে থাকে দূর পশ্চিমের দিকে, মাদ্রাসার মুখ অত পশ্চিমে না গেলেও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা করে না। দুটির কোনোটিতেই নিজের দেশ প্রধান হয়ে ওঠে না।

শিক্ষা হওয়া উচিত মাতৃভাষার মাধ্যমে; হওয়া দরকার অভিন্ন ধারার এবং ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ওই তিন বিবেচনার কোনোটিতেই উত্তীর্ণ নয়। মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাটা যে ত্রুটিমুক্ত তা নয়।

সেটাও অত্যন্ত দুর্বল, বলা যায় নড়বড়ে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ নেই, কেননা এই শিক্ষা তাদের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। শিক্ষকরাও অমনোযোগী, বলেন তাদের বেতন কম। সবচেয়ে বড় ব্যাপার এই শিক্ষাও পুঁজিবাদী মানুষ তৈরিতে নিয়োজিত। এখানেও লক্ষ্য থাকে শিক্ষার্থীকে জনবিচ্ছিন্ন স্বার্থপরতার আদর্শে দীক্ষিত এবং অনুপ্রাণিত করার।

আমরা নামছি। নামছি যে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে দেশপ্রেমের হ্রাস প্রাপ্তি। কিন্তু আমরা তো নামতে চাই না, উঠতে চাই।

সে ক্ষেত্রে করণীয়টা কী? প্রধান করণীয় হচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজকে গণতান্ত্রিক করে তোলার সংগ্রামটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দেশের মূল সমস্যাটা রাজনৈতিক, মূল আন্দোলনকেও তাই অতি অবশ্য রাজনৈতিক হতে হবে। সামাজিক আন্দোলন এবং সংস্কার তৎপরতার অবশ্যই মূল্য রয়েছে; কিন্তু কেবল তাদের ওপর নির্ভর করলে আগামী একশ বছরেও আমরা মুক্তি অর্জন করতে পারব না। নদীর সঙ্গে অনেক খাল যুক্ত থাকে, কিন্তু খাল নদী সৃষ্টি করে না; নদীতে যদি প্রবাহ না থাকে তাহলে খালই বরং শুকিয়ে যায়, স্মারক চিহ্ন হিসেবে ডোবাতেও পরিণত হতে পারে।

কিন্তু কোন রাজনীতির কথা ভাবছি আমরা? অবশ্যই শাসক শ্রেণির রাজনীতি নয়। শাসকশ্রেণির রাজনীতি হচ্ছে লুণ্ঠনের এই শ্রেণির সদস্যদের ভেতরকার মারামারি কাটাকাটিটা খুবই স্বাভাবিক, লুণ্ঠনকারীরা কবে একত্র থাকে? কিন্তু ওই রাজনীতি জনগণের অপকার ছাড়া উপকার করবে না। সরকার বৈধ হোক কি অবৈধ হোক তাতে বঞ্চিত মানুষের তেমন কিছু যায় আসে না এবং বৈধ-অবৈধ নির্বাচনে যেই জিতুক জনগণের যুক্তির বিবেচনায় তা একেবারেই অর্থহীন ও অপচয়মূলক। পাঁচ বছর ধরে এই দলের হাতে পীড়িত হবে নাকি অপর দলের এটা ঠিক করে দেওয়ার বাইরে নির্বাচনের অন্য কোনো ভূমিকা যে নেই তা প্রতিটি নির্বাচনই বর্ধিত হারে প্রমাণ করে দিয়ে যাচ্ছে।

যে আন্দোলনের এক পর্যায়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সেই আন্দোলনকে বেগবান ও গভীর করা চাই। এ আন্দোলন চরিত্রগতভাবে পুঁজিবাদবিরোধী। এর জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেমের। কেবল দেশপ্রেমে কুলাবে না; দরকার হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের। তার জন্য সংগঠন চাই, যেখানে বিবেকবান মানুষরা থাকবেন, থাকবেন বুদ্ধিমান মানুষরাওÑ অর্থাৎ তারা যারা জানেন যে ব্যক্তির মুক্তি সমষ্টির মুক্তির ভেতরই প্রোথিত রয়েছে। অভ্যুদয়ের পথ ওইটাই। তার বাইরে অন্য সব তৎপরতা মূল্যহীন নয়। কিন্তু তারা ওইখানের মতোই তারা অত্যন্ত উপকারী হবে, যদি নদী থাকে প্রবহমান। নদীর কোনো বিকল্প নেই। কেবল আত্মত্যাগে হবে না, সঠিক আন্দোলন চাই।


সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়