ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেটে সুস্থ জীবনবোধের জয় হোক

ইকরামউজ্জমান
২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেটে সুস্থ জীবনবোধের জয় হোক

রাজনৈতিকভাবে বৈরী সম্পর্ক ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজ করে। ক্রিকেট পারছে না ভারত ও পাকিস্তানের রাজনীতির বাইরে যেতে। এ ক্ষেত্রে ভারত সরকার এবং ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) অনেক বছর ধরে অনড় অবস্থায় আছে। ভারতীয় দল পাকিস্তানের মাটিতে গিয়ে ক্রিকেট খেলবে না। সেই ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে ভারত পাকিস্তানে গিয়ে ক্রিকেট খেলেনি। তবে এই সময়ের মধ্যে ভারত থেকে বিভিন্ন খেলার ক্রীড়া দল পাকিস্তানে গিয়ে খেলায় অংশ নিয়েছে। সব সমস্যা শুধু ক্রিকেট নিয়ে। ক্রিকেটকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার। অথচ এই খেলার দর্শন হলো সুস্থ জীবনবোধ। একে অপরকে কাছে টানা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি।

আইসিসির ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ভারত ও পাকিস্তান পরস্পর মুখোমুখি হওয়া মানেই যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব দুই দেশের মধ্যে। পাকিস্তানে গিয়ে ভারত ক্রিকেট খেলতে চায় না নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে। অথচ গত কয়েক বছর নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা, বাংলাদেশসহ সব টেস্ট খেলুড়ে দেশ এক বা একাধিকবার পাকিস্তানে গিয়ে ক্রিকেট খেলেছে। নিরাপত্তাজনিত কোনো বিষয় নিয়ে তারা কোনো প্রশ্ন তোলেনি। বরং স্বাগতিকদের মেহমানদারিতে সফরকারী দল সব সময় সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

ভারত পাকিস্তানে গিয়ে খেলতে না চাইলেও পাকিস্তান ক্রিকেট দল কিন্তু আইসিসির সব টুর্নামেন্টে ভারতে গিয়ে অংশ নিয়েছে। ক্রিকেটবিশ্বে এই বিষয়টি নিয়ে সব সময় আলোচনা হলেও আইসিসি কিন্তু সব সময় চুপ। আইসিসি কখনও চায় না ভারতের বিরাগভাজন হতে। আইসিসি তো ভারত থেকেই দুধ আর সর সবচেয়ে বেশি পাচ্ছে।

আইসিসিতে ভারতীয় ক্রিকেট স্পন্সরদের প্রাধান্য এবং দাপট তো ক্রিকেটবিশ্বে কারও অজানা নয়। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড তাই হরহামেশাই আইসিসি থেকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেয়- আর এটাই স্বাভাবিক। আসল কথা হলো ভারতকে খুশি রেখে আইসিসির তহবিলকে আরও মোটা করা। যে গরু দুধ দেয় সে লাথি মারলে অসুবিধা কোথায়।

ভারতের বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে ক্রিকেট ধর্মতুল্য। জয়-পরাজয় খেলার ধর্ম। খেলা হলে একদল জিতবে- একদল হারবে। ভারতের গোঁড়া সমর্থকরা হারতে রাজি নন। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে। পরিসংখ্যানে অবশ্য তিন সংস্করণেই সাফল্যের দৌড়ে ভারত এগিয়ে আছে। তবুও পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠের লড়াইয়ের আলাদা আবেদন এবং গুরুত্ব আছে। একবার মুম্বাইয়ে দেখেছি ভারত ও পাকিস্তান খেলছে ইংল্যান্ডে। সকাল গড়াতেই পুলিশের টহল গাড়ি উপস্থিত ক্রিকেটারের বাড়ির সামনে। জানতে চাইলাম ব্যাপারটি কী? ক্রিকেট বিশ্লেষক ও লেখক দীপক দেশ পাণ্ডে হেসে বললেন, যদি হেরে যায় তা হলে তো আর উপায় নেই। আর তাই আগে থেকেই পুলিশের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।

শুধু এশিয়ার দেশগুলো নয়, পুরো ক্রিকেটবিশ্ব অবাক হয়ে লক্ষ করছে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে হতে যাওয়া আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিকে ঘিরে কী হতে যাচ্ছে! পাকিস্তানে আটটি দেশকে নিয়ে (এর মধ্যে বাংলাদেশ আছে) আইসিসি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আগামী বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের তিনটি ভেন্যুতে (করাচি, লাহোর ও রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আছে। টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার একশ দিনেরও কম সময় বাকি আছেÑ তা সত্ত্বেও খেলার ফিক্সচার আইসিসি জানাতে পারেনি। এর কারণ হলো ভারত জানিয়ে দিয়েছে তারা পাকিস্তানের মাটিতে গিয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলবে না। তারা খেলবে নিরপেক্ষ ভেন্যু মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই নতুবা শ্রীলংকায়। ২০২৩ সালের এশিয়া কাপে ভারত পাকিস্তানে না খেলে খেলেছে তাদের খেলাগুলো শ্রীলংকায় হাইব্রিড মডেলে। এবারও তারা সেই দাবি করেছে। কয়েক মাস আগে যখন আইসিসি নিরাপত্তা দল পাকিস্তান সফরে এসে সবকিছু লক্ষ করে পাকিস্তানকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির স্বাগতিক দেশ হিসেবে সবুজ সংকেত দিয়ে গেছে। তখন কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এ বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি।

ইতোমধ্যেই পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) চেয়ারম্যান মহসিন নাকভি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ভারতের অযৌক্তিক আবদার মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। পিসিবি অনেক সৌজন্যতা দেখিয়েছে আর নয়। দুনিয়ার সবাই এসে পাকিস্তানে খেলছেÑ ভারত শুধু নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কথা বলছে। এটি পুরোপুরি হাস্যকর।

আইসিসি পড়েছে ভীষণ মুশকিলে। ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ তো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই দেশের মধ্যে খেলা না হলে তো আম-ছালা দুটোই যাবে। পাকিস্তান জানিয়ে দিয়েছে, ভারতের জন্য হাইব্রিড মডেল তারা মেনে নেবে না। এ ছাড়া তারা ইঙ্গিত দিয়েছে ভারতে আগামীতে যে নারী বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপের খেলা হবে এগুলোতে অংশ নাও নিতে পারে। পাকিস্তানের পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা চিন্তা করা মানেই আইসিসির জন্য আবার নতুন আরেকটি সমস্যার সৃষ্টি হওয়া।

ক্রিকেট বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড এবং সরকার বিষয়টাকে এবার শক্তভাবে দেখছে। বিষয়টির মীমাংস না হলে এটি ভবিষ্যতের ক্রিকেটের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তা ছাড়া পাকিস্তান আন্তর্জাতিক কোর্টে যাওয়া ছাড়াও ভারত যে ২০৩৬ সালে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেÑ এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান ক্রীড়াঙ্গনে ভারতের রাজনীতি এবং বৈষম্যকে বড় করে তুলে ধরে ভারতের বিপক্ষে যে প্রচারণা চালাবে না এটা কেউ বলতে পারবে না।

সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। ভারতীয় দল কি শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে পাকিস্তানে যাবে? যদি না যায় তা হলে কী হবে? আইসিসি কীভাবে বিষয়টা সামাল দেবে? এএফপি জানিয়েছে, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মহসিন নাকভি বারবার বলছেন, পাকিস্তানে ভারতের দলের জন্য নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা নেই। তিনি আরও বলেছেন, ভারতের দর্শকরা যারা খেলা দেখতে ইচ্ছুক তাদের জন্য দ্রুত ভিসার ব্যবস্থা পাকিস্তান করবে। ভারতীয় দর্শকদের টিকিটের জন্য বিশেষ কোটা রাখা হবে। প্রতিবেশী দুটি দেশ ক্রিকেটের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে খেলবে এটি সব সময় বিরাট বিষয়।

সমস্যা সব সময় সৃষ্টি করে রাজনীতি। আইসিসির পক্ষে তো সম্ভব নয়- ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশকে স্বাগতিক তালিকার বাইরে রাখা। তা হলে তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তার গ্ল্যামার এবং আকর্ষণ হারাবে।


ইকরামউজ্জমান : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ও আইপিএস এশিয়া