‘কিশোর গ্যাং’ সমাজের একটি দুষ্ট ক্ষত
মানুষের পুরো জীবনকে মোটা দাগে কয়েকটি পর্বে ভাগ করা যায়। যেমন- শিশু, কিশোর, যুবক, প্রবীণ, প্রৌঢ় ইত্যাদি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং জাতিসংঘ শিশু তহবিল (UNICEF)-এর মতে, ১০ বছর থেকে ১৯ বছর বয়সের মাঝামাঝি সময় অর্থাৎ শৈশব এবং যৌবনের মধ্যবর্তী অবস্থাই কৈশোর। এটিকে বয়ঃসন্ধিকালও বলা চলে। জীবনের প্রতিটি পর্বে শারীরিক এবং মানসিকভাবে আলাদা আলাদা পরিবর্তিত রূপ রয়েছে। শারীরবিদ্যা এবং মনোবিদ্যা উভয়ের মতে কৈশোর পর্বে মানুষের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন সব থেকে বেশি হয়। দৈহিকভাবে দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে যেমন নানা ধরনের বদল আসে তেমনি মানসিকভাবে এই বয়সে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। বলা যায় মানসিকতার এই পরিবর্তন তাদের জীবন চলার পথকে অনেকটা নির্ধারণ করে দেয়। তাই এই সময়টা মানুষের জীবনে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
কৈশোরে এসে মানুষের একটি আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে। অর্থাৎ শৈশবে যেসব বিষয়ে সে বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল সেসব বিষয়ে তার নিজের পছন্দ তৈরি হয়। সে কী খাবে, কী পরবে, কার সঙ্গে মিশবে এসব বিষয়ে যেমন সিদ্ধান্ত নিতে থাকে তেমনি সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র, জীবনদর্শনের ক্ষেত্রেও সে স্বাধীনভাবে ভাবতে শুরু করে। এই বয়সে ছেলেমেয়েদের ঘন ঘন মুড সুইং হতে থাকে। অল্পতে খুশি হয়, অল্পতে রেগে যায়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তখন তার ব্রেইনের জায়গায় আবেগকে প্রাধান্য দেয়। কিশোরদের অত্যধিক কৌতূহল বা আবেগ সব সময় ভালো কিছু ঘটায় এমন নয়, অনেক সময় আবেগের বশে তারা আলোর পরিবর্তে অন্ধকার জগৎকে বেছে নেয়। তাদের ভয়াবহ অন্ধকার জগতের একটি নাম ‘কিশোর গ্যাং’। কিশোরদের নিয়ে গঠিত এই অপরাধ গোষ্ঠী সমাজের দুষ্ট ক্ষত, যে ক্ষত ক্রমেই প্রসারিত হয়ে বাংলাদেশ নামক দেশটির পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে এটি একটি আতঙ্কের নাম।
এক সময় কিশোর বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠত শৈশবের খোলস ছেড়ে সদ্য বেরিয়ে আসা রাজ্যের বিস্ময়ভরা চঞ্চল চোখের রৌদ্রোজ্জ্বল নিষ্পাপ মুখ। স্বভাবে নম্র-ভদ্র। বাবা-মা শিক্ষক মুরুব্বীদের সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলে না। মাদক-গাঁজা দূরে থাকুক সিগারেট পানের অভ্যাস পর্যন্ত নেই। কিন্তু দিন বদলেছে। এখন কিশোর মানেই দৃষ্টির সামনে সেই কোমল কাচের মতো স্বচ্ছ রূপটি আর ফুটে ওঠে না। এক্ষেত্রে দৃষ্টি আজ বিভ্রান্ত। কারণ কৌতূহলী সেসব নিষ্পাপ মুখের এখন অনেক রূপ!
গ্যাং বলতে নির্দিষ্ট কিছু লোকের একটা দলকে বুঝায়। তবে এই শব্দটি সাধারণত অপরাধ বা নেতিবাচক কাজে জড়িত কোনো দল বা গ্রুপ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘কিশোর গ্যাং’ বলতে বুঝায় কিশোরদের নিয়ে সংগঠিত একটি সংঘ যারা হত্যা, অপহরণ, চুরি ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল, ধর্ষণ নানাবিধ অপরাধে জড়িত।
‘গ্যাং কালচার’ একটি পুরনো পশ্চিমা সংস্কৃতি। আঠারো শতকের শেষভাগে ইংল্যান্ডে এর সূচনা হয়েছিল যা পরবর্তী সময়ে ইউরোপ ও পশ্চিমা দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। গ্যাং কালচারের মূল কারণ ছিল দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থা। ত্রিশ দশকের মহামন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী গ্যাং কালচার দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ১৯৮০ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিশোর দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা থেকে পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বে গ্যাং কালচার ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের অপরাধ জগতের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ৮০-৯০-এর দশকে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে গ্যাং কালচার অনুপ্রবেশ করে। ২০০১ সালে রাজধানীর উত্তরায় ক্র্যাব গ্রুপ বা কাঁকড়া গ্রুপের আবির্ভাবের মাধ্যমে ঢাকা শহরের মানুষ প্রথম ‘কিশোর গ্যাং’-এর সঙ্গে পরিচিত হয়। ২০১২ সাল পর্যন্ত তাদের অপরাধের পরিধি ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগ, শহর, উপশহরে এই ভয়ানক ক্ষত বিস্তার লাভ করেছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
২০১৭ সালে ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজ’ নামের কিশোর গ্যাংয়ের সংঘাতের বলি হয়, উত্তরা ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। এর পরেই পুরো দেশ জুড়ে ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। এছাড়া ২০১৯ সালে সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ডের গড়ে তোলা ফেসবুকভিত্তিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ ‘০৭’ কর্তৃক বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যার পর কিশোর গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ড দেশের মানুষকে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। ২০২৩ সালের মে মাসে রাজধানীর লালকুঠি এলাকায় কিশোর গ্যাং ‘অতুল গ্রুপ’ ও ‘পটেটো রুবেল গ্রুপ’-এর দ্বন্দ্বে স্কুলছাত্র সিয়াম হত্যার ঘটনাতেও দেশবাসী চরম উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে।
সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন সারাদেশে ২৩৭টির মতো ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে, ১২৭টি। এসব গ্যাংয়ের সদস্য ১ হাজার ৩৮২ জন। ডিএমপি সূত্র মতে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে, তার অন্তত ২৫টি কিশোর গ্যাং-সংশ্লিষ্ট।
কিশোর গ্যাংয়ের একেকটি গ্রুপে ৭ থেকে শুরু করে ২০/২১ জন্য সদস্য থাকতে পারে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন চটকদার নামও রয়েছে। যেমন- পাওয়ার বয়েজ, নাইন এম এম বয়েজ, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, বিচ্ছু বাহিনী, বাবু রাজন, রিপন গ্যাং, একে ৪৭, নাইন এম এম ও ফাইভ স্টার, চান জাদু, ডেভিড কিং ফল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি ইত্যাদি। এদের কোনো কোনো গ্রুপের ড্রেস কোড আছে। অনেক গ্রুপের চুলের কাটিং একই স্টাইলের। যেসব কাটিং বা পোশাক অথবা লোগো বা শরীরের ট্যাটু দেখে বোঝা যায় কে কোন গ্রুপের সদস্য। এদের আচার-আচরণ উগ্র এবং ভয়ঙ্কর প্রকৃতির হয়ে থাকে। তারা ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবেও কাজ করে এমনটি পুলিশ জানিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, যে বয়সে কিশোরদের পড়ালেখা, খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা সেই বয়সে তারা কেন এভাবে অপরাধ জগতে প্রবেশ করছে। মনোবিদদের মতে, এর অনেক কারণ রয়েছে যেমন- দারিদ্র্য, পারিবারিক সচেতনতার অভাব, অশিক্ষা, এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক প্রভাব, সঙ্গদোষ, হিরোইজম, খেলাধুলা বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক সুকুমারবৃত্তির অপ্রতুলতা, ইন্টারনেটের প্রভাব, সামাজিক বৈষম্য, নৈতিক অবক্ষয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলা ইত্যাদি। আমার মতে দারিদ্র্য, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা তো রয়েছেই কিশোরদের খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অনুপস্থিতি এই অপরাধ প্রবণতার বড় একটি কারণ।
এক সময় পাড়া-মহল্লায় কিশোরদের মধ্যে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো, খেলার আয়োজন করা হতো বা লাইব্রেরিতে পড়ার ব্যবস্থা ছিল এখন সেটি তেমন দেখা যায় না। খেলাধুলার জন্য শহরে মাঠ নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি বা দুটি বিল্ডিংয়ে সীমাবদ্ধ। সাংস্কৃতিক চর্চা উঠে গেছে প্রায়। অথচ খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক চর্চা মানুষকে বহু অপরাধ থেকে দূরে রাখতে সক্ষম। অন্যদিকে ইন্টারনেট এডিকশন এবং পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এসব কিশোরের অপরাধ প্রবণতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
কারণ যাই থাকুক, কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ প্রবণতা যে ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছেছে, এখনই যদি এটি সমূলে উৎপাটন না করা যায় তাহলে এর পরিণতি আরও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে। এই সর্বনাশা কার্যকলাপ বন্ধের জন্য প্রথম যে কাজটি করতে হবে সেটি হলো, তাদের আইনের আওতায় এনে কিশোর শোধনাগারে পাঠানো। এই শাস্তির বিষয়টি মিডিয়ায় দৃশ্যমান হলে অন্য কিশোররা ভয় পাবে। দ্বিতীয়ত, যারা এই অপরাধ গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে এই বিষয়ে বাবা-মাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। বেশি বেশি খেলাধুলা বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে কিশোরদের সম্পৃক্ত করতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। পরিবারকে খেয়াল রাখতে হবে সন্তান কোন কোন সাইট ভিজিট করছে। ইন্টারনেটের যেসব সাইট কিশোরদের জন্য ক্ষতিকর সরকারিভাবে সেগুলো বন্ধ করা জরুরি। পরিবারের পাশাপাশি এলাকার মুরুব্বী যারা রয়েছেন তাদেরও এলাকার কিশোরদের কার্যকলাপ সম্পর্কে খেয়াল রাখা দরকার। মসজিদের খুতবায়, মন্দিরে, গির্জায়, বিভিন্ন ধর্মীয় বা নৈতিক বিষয়ের সুফল এবং অনৈতিকতার কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে।
মোট কথা, সমাজে ‘কিশোর গ্যাং’ নামে যে দুষ্ট ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা নির্মূল করতে শুধু পরিবার নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র সবার দায়িত্ব রয়েছে। এটি প্রতিরোধ এবং প্রতিকার করতে যেমন মলমের প্রয়োজন তেমনি দরকার হলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে কঠোর হওয়া দরকার। আশার কথা হলো, গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যৌথবাহিনীর অভিযানে কিশোর গ্যাংয়ের বেশকিছু সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। অভিযান অব্যাহত থাকুক।
আজকের কিশোর সমাজ আগামীর ভবিষ্যৎ। এক সময় তারাই এই দেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে। সুতরাং শারীরিক এবং মানসিকভাবে তাদের সুস্থ রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাই তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করতে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে তবেই আমরা সুস্থ মস্তিষ্কের একটি মেধাবী নেতৃত্ব পাব।
ম্যারিনা নাসরীন : কথাসাহিত্যিক ও সহকারী অধ্যাপক
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
ময়মনসিংহ কলেজ।