অর্থ ও উদ্যোক্তা পাচার প্রসঙ্গ
মানি লন্ডারিং প্রত্যেক দেশের জন্যই একটি আর্থিক ক্ষরণজাতীয় জটিল সমস্যা। বিশেষ করে যেসব দেশ বৈদেশিক মুদ্রা ও বিনিয়োগের সংকটে ভোগে তাদের জন্য মানি লন্ডারিং উভয় সংকট ও বহুমুখী মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে। যে দেশে বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির অভাব, যেসব দেশ বেকারত্বের ভারে ন্যুব্জ সেসব অর্থনীতি মানি লন্ডারিংয়ের কারণে বেশি সমস্যায় পতিত হয়। কারণ পুঁজি সংকটগ্রস্ত দেশ থেকে টাকা যদি বিদেশে চলে যায় তা হলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। এসব দেশে পুঁজি ধরে রাখতে না পারার কারণে সব সময়ই প্রয়োজনীয় পুঁজির জন্য পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। পুঁজি স্বল্পতার দেশ থেকে মানি লন্ডারিং বা পুঁজি পাচার অর্থই হচ্ছে অর্থনীতির জন্য ইন্টারনাল হ্যামারেজ বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। জাপান বা আমেরিকার মতো বড় অর্থনীতির একটি দেশ থেকে মুদ্রা পাচার বা মানি লন্ডারিং হলে তাদের হয়তো খুব একটা ক্ষতি হয় না। কারণ এই ক্ষতি তারা পুষিয়ে নিতে পারে। তাদের উদ্বৃত্ত পুঁজি আছে। তথাপি সেসব দেশে মানি লন্ডারিংকে কঠোর পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা হয়। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ থেকে পুঁজি পাচার বা শিল্প উদ্যোক্তা পাচার হলে সেই ক্ষতি পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কষ্টার্জিত কিংবা দুর্নীতিজাত যে অর্থ নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহৃত হতে পারত, নিজদেশে কর্মসৃজন, উৎপাদন না করে সেই অর্থ বিদেশে বিনিয়োগে ব্যবহৃত হতে দেওয়াটাই আত্মঘাতী। উন্নয়নশীল দেশগুলো সব সময়ই পুঁজি স্বল্পতায় ভোগে। তাই তাদের দেশ থেকে পুঁজি যদি কোনোভাবে বাইরে চলে যায়, বোঝা যায় যে তাদের কষ্টার্জিত টাকা ধরে রাখার সক্ষমতা কম। সেজন্য টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। একটি দেশে মানি লন্ডারিং এবং অর্থপাচারের মতো ঘটনা কখন ঘটে? যখন কোনো দেশে অবৈধ বা অস্বচ্ছভাবে অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকে কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে সেই টাকা ব্যবহারের অবাধ সুযোগ নেই, তখনই ব্যাপকভাবে মানি লন্ডারিং হয়। অর্থপাচার হয়। কোনো দেশের অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারীরা যদি তাদের অর্থ অভ্যন্তরীণভাবে বিনিয়োগ বা ব্যবহারের সুযোগ পায় তা হলে পাচার বা মানি লন্ডারিং হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। কোনো দেশ যদি অবৈধ অর্থ অর্জনের সুযোগ কম এবং বিদেশে পাচারের ও বিনিয়োগের সুযোগ কম সেই দেশ থেকে সাধারণত অর্থপাচার হয় না। দেশ অভ্যন্তরে বিনিয়োগের পরিবেশ যদি ভালো থাকে তা হলে মানি লন্ডারিং বা অর্থপাচার কম হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকা এবং বিনিয়োগের অনুকূল ও কার্যকর পরিবেশ না থাকার কারণেই সাধারণত অর্থপাচার হয়। অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অবৈধভাবে অর্জিত টাকা আছে কিন্তু সংগত কারণে সেই টাকা বিনিয়োগ করা হয় না বা যায় না। ফলে মানি লন্ডারিং বাড়ছেই। দুর্নীর্তির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের উপায় উৎসমুখে বন্ধ না হলে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অর্থবহ হবে না।
কাজেই যে দেশ থেকে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে মুদ্রা পাচার হয় এবং পাচারকৃত মুদ্রা যে দেশে যায় উভয় দেশকেই এটা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে। এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা (গ্লোবাল প্রোগ্রাম অ্যাগেইন্্স্ট মানি লন্ডারিং) আছে, বাংলাদেশও ইউএন-এর সে ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংযুক্ত সদস্য দেশ।
করোনা এবং করোনা-পরবর্তী দেশে-বিদেশে উদ্ভূত নানান ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে দেশের অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। করোনাকালে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে নয়, বিদ্যমান কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলোও সংকুচিত হয়ে পড়ে। ব্যক্তিমালিকানাধীন অনেক প্রতিষ্ঠানই ব্যাপকভাবে কর্মী ছাঁটাই করেছে। ব্যয় সংকোচনের লক্ষ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম সীমিত করেছে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু করোনার কারণে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে অথবা তাদের কার্যক্রম সীমিত করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সীমিত হয়েছে, যদিও প্রতিনিয়তই দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আগামীতে দেশে বেকারত্বের হার অনেকটাই বেড়ে যাবে। বিদেশ থেকে অনেকেই কর্মচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। তারাও বেকার সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছেন। বেকার সমস্যা বেড়ে গেলে দারিদ্র্যের হারও বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে যে উন্নয়নের ধারা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছিল তার পেছনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত অর্থ একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করত। আগামীতে এটা অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়বে।
দেশে করোনা এবং ইউরোপের যুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব আলোচনায় প্রধানত অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকটিই আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু এসব কারণে দেশের প্রচলিত সামাজিক সম্প্রীতি কীভাবে বা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা তেমন একটা আলোচনা হচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রচলিত সমাজব্যবস্থা অত্যন্ত মানবিক এবং সহানুভূতিসম্পন্ন। একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসবেন এটাই চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। একজনের আনন্দে অন্যজন আনন্দিত হয়। কিন্তু মন্দার কারণে আমাদের সেই হাজার বছরের প্রচলিত সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধন অনেকটাই শিথিল হয়ে যাচ্ছে। একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসতে পারছে না। ইউরোপীয় উন্নত দেশগুলোর সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং বন্ধন একরকম। আর আমাদের দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্যরকম। এ দেশের সামাজিক সংস্কৃতি মানবতাবাদী এবং পরস্পর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ^াসী। ইউরোপীয় সংস্কৃতি হচ্ছে একক পরিবার প্রথায় বিশ^াসী। আর এ দেশের সামাজিক প্রথা হচ্ছে যৌথ পরিবারে বিশ^াসী। পরিবারের একজনের কষ্টে অন্যজন এগিয়ে আসে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ এতটাই প্রবল যে, সেখানে কেউ কারও খবর রাখার প্রয়োজনবোধ করে না। বাংলাদেশের পারিবারিকব্যবস্থা হচ্ছে একান্নবর্তী পরিবারব্যবস্থা। ফলে পরিবারের মধ্যে মমত্ববোধ বেশি থাকে, যা উন্নত দেশগুলোতে কল্পনাও করা যায় না। মূলত করোনার কারণে দেশের সামাজিকব্যবস্থার এই দিকটি সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধই হচ্ছে যে সমাজব্যবস্থার মূল কাঠামো সেখানে মহামারী ও অর্থনৈতিক মন্দা একেবারেই ব্যক্তিনিষ্ঠ করে দিয়েছে। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, কেউ যদি বিপদে পড়ে তা হলে অন্যজন তা দেখেও না দেখার ভান করে। কারও বিপদে কেউ এগিয়ে যেতে চায় না। মৃত বাবার লাশ সন্তান রাস্তায় ফেলে গেছেÑ এমন নজিরও বিরল নয়। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সমাজ থেকে মানবতাবোধ যেন উধাও হয়ে যাচ্ছে। মানুষের পারস্পরিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। সামাজিক সম্প্রীতি-সহযোগিতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পথে। সমাজে দীর্ঘদিন ধরে যে মূল্যবোধগুলো গড়ে উঠেছিল তা ইতোমধ্যেই বিনষ্ট হওয়ার পথে। মানুষের জীবনীশক্তি কমে গেছে। মানুষ আর আগের মতো উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করতে পারছে না। দীর্ঘদিন ঘরে বন্দি থাকার ফলে তারা এখন অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতা বা শক্তি আগের চেয়ে অনেকটাই কমে গেছে। অনেকের মাঝেই এমন একটি অনুভূতি কাজ করছে যে, বেঁচে থেকে কী লাভ? অনেকেই আছেন যারা করোনা কিংবা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কোনোভাবে বেঁচেছেন তারা দেখেছেন জীবন কতটা ঠুনকো। যে মানুষটি এক সময় সম্পদ অর্জনের জন্য লালায়িত ছিল তিনি এখন সম্পদ অর্জনের মাঝে কোনো উদ্দীপনা খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকেই জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন। মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতা এবং ভবিষ্যৎমুখী চিন্তাভাবনা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের মূল্যবোধ এবং সৃজনশীল চিন্তায় আঘাত পড়েছে। মানুষের আত্মসম্মান, মর্যাদাবোধে প্রচণ্ড রকম আঘাত লেগেছে। কারণ তারা দেখেছে অনেক কিছুই মূল্যহীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি বা এ ধরনের উন্নত দেশগুলোও প্রত্যক্ষ করেছে যে, প্রকৃতির শক্তির কাছে তারা কতটা অসহায়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আস্থাই হোক অবলম্বন : মানুষ তার নিজের বোধ-বিশ্বাসের বিশ্বে বাস করতে চায়। সে তার সব পদক্ষেপকে নিজের নিরিখেই যৌক্তিক ভাবতে ভালোবাসে। জগৎ ও সংসারসংক্রান্ত উপলব্ধি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো যার যেমন চিন্তা-চেতনা তদনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। মনসচক্রবালের চৌহদ্দিভেদে দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য হয়ে থাকে।
সবার ওপর মানুষ সত্য এ উপলব্ধিরও কোনো বিকল্প নেই। মানুষই নিজকে ও সবাইকে, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের অবয়বে সময়কে, পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণকে নিয়ন্ত্রণ করে। অবকাঠামো গড়ে যে সভ্যতা সংস্কৃতির বিকাশ সে ঘটায়, তার ধ্বংসের কারণও আবার সে-ই সৃষ্টি করে। মুক্তবুদ্ধির মানুষ যেমন দৃষ্টির প্রসারে আলোকিত হয়, অবরুদ্ধ চিন্তা-চেতনায় বন্দিত্ববরণের ফলে অন্ধকারে ডুবে যাওয়াও তার ভাগ্যে ঘটতে পারে। ভালো পথ যাচাই ও গ্রহণ-বর্জনের প্রশ্নটিও আদিকাল থেকেই অব্যাহতভাবে অমীমাংসিত আছে বলেই জীবন ও সমাজ গতিশীল। বৈধ অবৈধর প্রতি আসক্তি ও আকর্ষণের তারতম্যের মধ্যে সমাজের পরিবেশ-পরিচয় প্রকাশ পায়।
মানবকল্যাণকামিতার আদর্শ সময় ও সমাজভেদে নানান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে থাকে। মানবকল্যাণধর্মী মূল্যবোধের বিকাশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত জরুরি যে, শত বাধা-বিপত্তি, সংশয়, সংকট-সন্ধিক্ষণেও সত্য-সুন্দরের সনাতন উপলব্ধি থাকবে জাগ্রত। বিভ্রান্তির বেড়াজালে শাশ্বত মূল্যবোধ হারিয়ে যাবে কিনা কিংবা নিরুদ্দিষ্ট হবে কিনা তা নির্ভর করে ব্যষ্টি ও সমষ্টির আকাক্সক্ষার আকৃতি আর সজাগ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃতির ওপর। জনকল্যাণের নামে, সংস্কারের নামে কুশাসন-শোষণ মুক্তির নামে নানান মতবাদ-উপায়-উপলব্ধির অবয়বে শাশ্বত মূল্যবোধের ভাঙাগড়া চলে। শুভ উদ্যোগে বিশ্বাস ও প্রত্যয় হয় সুদৃঢ়। আত্মমর্যাদাবোধের বিকাশ আর কল্যাণকামিতায় আসে প্রাণপ্রাচুর্য। পক্ষান্তরে ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তা-চেতনা দ্বারা তাড়িত পদক্ষেপে সৃষ্ট হতবাক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেয় সব ক্ষেত্রে। বিশ্বাস আর আস্থায় ধরে ভাঙন। মানুষ বিশ্বাসের বিশ্বে নিরাপত্তা নির্ভরতায় বাস করতে চায়। আস্থা নিজের প্রতি, সমাজের প্রতি অতীব প্রয়োজন। আস্থার অবর্তমানে কিংবর্তব্যবিমূঢ় ব্যক্তি সমাজে জগদ্দল পাথর হয়ে দাঁড়ায় এবং কিয়ৎকাল পরে তার চলৎশক্তির গতিধারায় ঘটতে পারে অশুভ দিকপরিবর্তন। নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাফিক যেমন পদে পদে কারণে-অকারণে অহেতুক যানজটের হেতুতে পরিণত হয়। অসহিষ্ণুতা আর পারষ্পরিক দোষারোপের বেড়াজালে সহযোগিতা-সহমর্মিতার মেলবন্ধন হয়ে পড়ে সুদূরপরাহত।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান