আয়করের ই-বিবরণী দাখিল কিছু প্রসঙ্গকথা

মাহফুজুর রহমান
২০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
আয়করের ই-বিবরণী দাখিল কিছু প্রসঙ্গকথা

আয়করের বার্ষিক বিবরণী দাখিলের সময় এসেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। অনেকটা ঈদুল ফিতরের ‘চাঁনরাতের’ মতো। গ্রামে সারা বছর স্বাভাবিক গতিতে চলা গৃহিণীও ঈদের আগের রাতে উৎসাহ নিয়ে প্রচুর কাজ করেন। কারণ পরের দিন ঈদ হবে। ঠিক তেমনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা অক্টোবর-নভেম্বরে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্দেশ্যে উৎসাহ নিয়ে কাজ করেন। যারা কর পরিশোধ করেন, তাদের জন্যও সময়টা অতি গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো কর বিবরণী জমা দিতে না পারলে বিপদ হতে পারে- এ কথা কারও অজানা নয়। তাই উৎসাহ নিয়েই তাদের করসংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সংগ্রহ করতে এবং বিবরণী জমা দিতে দেখা যায়। কয়েক বছর বিভিন্ন স্থানে করমেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা গেছে। এসব মেলায় অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে করদাতাদের তাদের বাৎসরিক বিবরণী দাখিল করতে দেখা যেত।

এবার বিবরণী প্রদানের পদ্ধতি বদলে গেছে। হঠাৎ করেই ২২ অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একটি আদেশ জারি করে কতিপয় করদাতার জন্য ই-রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে। এই আদেশের আওতায় আছেন ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ পৌর করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় কর্মরত সব শ্রেণির সরকারি কর্মচারীরা। এ ছাড়া দেশের সব স্থানে, সব পর্যায়ে কর্মরত কতিপয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা; এগুলোর ভেতর আছে সব তালিকাভুক্ত ব্যাংক, সব মোবাইল টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, বাটা সু কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড, নেসলে বাংলাদেশ পিএলসি নামের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আশা করছে যে, এ পদ্ধতির মাধ্যমে করদাতারা অতিসহজে কর ফরম পূরণ করতে পারবেন এবং এনবিআরের ওয়েবসাইট ব্যবহার করে কর বিবরণী অতিসহজেই দাখিল করতে পারবেন। তারা ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেমস ব্যবহার করে সহজেই কর পরিশোধ করতে পারবেন। অতিসহজে তারা কর বিবরণী দাখিলবিষয়ক সার্টিফিকেটও পেয়ে যাবেন এবং প্রিন্ট করতে পারবেন।

কর বিবরণী দাখিলে ভুলভ্রান্তি হলে বা কর কম প্রদান করা হলে শাস্তি এবং জরিমানা গুনতে হতে পারে এবং কর অধিক পরিমাণে পরিশোধ করা হলে তা আর ফেরত পাওয়া যায় না- এ কথা সবারই জানা। ওপরে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং কম্পিউটার ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। সরকারি অফিস, ব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানিতে যারা শ্রমিক, ড্রাইভার, সহায়ক ইত্যাদি পদে কাজ করেন এবং যাদের দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটার ব্যবহার করতে হয় না তারা ই-রিটার্ন জমা দেওয়ার কাজটি নিয়ে অকূল পাথারে পড়েছেন। কেবল তাদের কথাই বা বলি কেন, ব্যাংকের বেশ কজন অফিসারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তারাও রিটার্ন প্রস্তুত করতে গিয়ে নাকানি-চুবানি খাচ্ছেন। আগের বছরগুলোতে অনেকেই কর বিবরণী প্রস্তুত ও দাখিলের বেলায় পেশাদার আয়কর উপদেষ্টাদের সহযোগিতা গ্রহণ করতেন। এ বছর পেশাদার আয়কর উপদেষ্টারাও অনলাইনে কাজ করতে পারেন না বলে অনেক ফাইল ফিরিয়ে দিচ্ছেন।

আয়কর রিটার্ন প্রস্তুত করা এবং সঠিক নিয়ম মেনে জমা দেওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব। দাখিলকৃত বিবরণীতে ভুল পাওয়া গেলে বা পূরণ করার নিয়ম সঠিকভাবে অনুসৃত না হলে ভবিষ্যতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষ থেকে নোটিশ পাওয়া যেতে পারে, চা পানের দাওয়াত আসতে পারে এবং শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে। আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তিত হলে বিরোধী দলের সমর্থকদের আয়কর বিবরণী ঘাঁটাঘাঁটি করে ভুল বের করার ঘটনা তো উদাহরণ হিসেবে রয়েছেই। এসব কারণে সবাই সঠিক এবং ভবিষ্যতে নিরাপদে থাকার নিশ্চয়তা থাকে এমনভাবেই কর বিবরণী দাখিল করতে আগ্রহী থাকেন। এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং অতিশয় টেকনিক্যাল একটি কাজ করার জন্য হঠাৎ করেই অনলাইনে বিবরণী দাখিলের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আদেশ দিয়েছে এবং বাধ্যতামূলক করেছে! অনুমান করছি, এই নির্দেশনাটি এসেছে ডিজিটাল ব্যক্তিত্ব প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে। সর্বক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন অবশ্যই একটি চমৎকার আইডিয়া। কিন্তু এ কাজটি সুষ্ঠুভাবে করার মতো পরিবেশ প্রস্তুতের পর কাজটি বাধ্যতামূলক করা হলে সবার জন্য তা স্বস্তির হবে এবং দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। অন্যথায় ব্যাপক পরিমাণে ভুল রিটার্ন দাখিল হবে এবং করদাতাদের জন্য বড় ধরনের অস্বস্তির সৃষ্টি করবে। তারা কর প্রদানে নিরুৎসাহিত হবেন এবং সরকারের কর-আয় কমে যাবে। বিগত সরকারের সময়কালে যেমন প্রধানমন্ত্রীকে তোষণ করে কাজ করার প্রবণতা ছিল, এখনও সম্ভবত সে কাজটাই চলছে।

ডিজিটাল পদ্ধতিতে কর বিবরণী দেওয়ার পথে আর একটি বড় ধরনের বাধা হলো নিজ নামে রেজিস্ট্রিকৃত মোবাইল সিমের মাধ্যমে ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) পাঠানোর বাধ্যবাধকতা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সিদ্ধান্ত জানিয়েছে যে, রেজিস্ট্রিকৃত সিমটি করদাতা স্বয়ং নিজ বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রির মাধ্যমে মোবাইল ফোনের কোম্পানি থেকে গ্রহণ করা হতে হবে। অন্যথায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক প্রেরিত ওটিপি যাবে না। ফলে তিন মিনিটের মধ্যে ওটিপি জানানো যাবে না বলে বিবরণী দাখিল করার কাজটি বাতিল হয়ে যাবে। পরপর তিনবার ওটিপি পাঠানোর পরও সঠিকভাবে তা প্রত্যর্পিত না হলে করদাতাকে ব্লক করে দেওয়া হবে। ফলে সে আর রিটার্ন জমা দিতে পারবে না। ফলে সে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সরকারকে করের টাকা দিতে পারবে না। তাকে তখন জরিমানার জন্য দিন গুনতে হবে।

আমাদের দেশে অনিবার্য কারণেই এযাবৎকালে পরিবারের অনেক সদস্য কর্তৃক ব্যবহৃত মোবাইল সিম এক ব্যক্তির আইডি ব্যবহার করে কেনা হয়েছে। যেহেতু পরিবারের সদস্যদের কাছে নিজ নামে কেনা সিম হস্তান্তর করতে আপাতদৃষ্টিতে কোনো বাধা নেই সুতরাং অনেকেই তা করেছেন। কিন্তু উপার্জনক্ষম প্রত্যেকের নামেই তারা কর বিবরণী দাখিল করে চলেছেন। বর্তমান বছরে এসব নিয়মিত করদাতারা কর বিবরণী ও করের টাকা জমা দিতে পারবেন না। কারণ এসব সিমের মালিকানা পরিবর্তন করা একান্তই জটিল বিষয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে অসম্ভব। করদাতাদের এখন একটি নতুন সিম কিনে তাদের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরের সঙ্গে যুক্ত করে রেজিস্ট্রি করার পর বিবরণী দাখিলের চেষ্টা করতে হবে; অবশ্য ততদিন যদি বিবরণী দাখিলের সময় থাকে।

এদিকে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকসহ অতি উৎসাহী আরও দু-একটি প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিয়েছে যে, ২০ নভেম্বরের মধ্যে কর বিবরণী জমা দিয়ে জমা স্লিপ অফিসে জমা দিতে হবে। অবশ্য ই-বিবরণী প্রস্তুতের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সহযোগিতামূলক কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

বাংলাদেশে কোনো কাজই সহজসাধ্য নয়। সিম নিজ নামে রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে বা নতুন সিম কিনতে গিয়ে সুদীর্ঘ লাইন পেরিয়ে হয়তো জানা যাবে যে, জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে জন্মনিবন্ধন পত্রের পুরোপুরি মিল নেই। একটিতে লেখা ‘মোহাম্মদ’ অন্যটিতে ‘মোঃ’ হয়ে গেছে। এই দুই বানানের মোহাম্মদ যে একই ব্যক্তি তার জন্য চেয়ারম্যান বা কমিশনারের প্রত্যয়ন লাগবে এবং নোটারি পাবলিকের একটা স্বাক্ষর লাগবে। দৌড়াদৌড়ি করে এগুলো এনে দাখিল করার পর হয়তো জানা যাবে যে, যিনি নোটারি পাবলিক হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন তিনি তিন বছর আগে তার পদ হারিয়েছেন বা তিনি সাড়ে তিন বছর আগে মারা গিয়েছেন। এখন এখানে বহাল নোটারি পাবলিকের স্বাক্ষর আনতে হবে এবং সেটি আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কর্তৃক প্রতিস্বাক্ষরিত হতে হবে।

কর বিবরণী জমা প্রদানের তারিখ ছিল ৩০ নভেম্বর। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই সময়সীমা বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর করেছে। তাদের এই সিদ্ধান্তটি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। নানা কারণে এ বছর কাগজপত্র সংগ্রহ করতে অনেকেরই বিলম্ব হয়েছে। রাজস্ব বোর্ড অবশ্য সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী জমা প্রদানের শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বরই রেখেছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রচলিত শর্ত অনুসারেই প্রতিবছর তাদের সম্পদের বিবরণী কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হয়। বিগত সময়ে যদি তারা এই নির্দেশটি সঠিকভাবে পালন করে থাকেন এবং অফিসের পক্ষ থেকেও এর বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে তা হলে সম্পদের বিবরণী জমা প্রদানের এই নির্দেশনা পালনে তাদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সম্পদের বিবরণী প্রদানের বেলায় সমস্যায় পড়বেন যারা সরকারি চাকরির সুবাদে অবৈধভাবে টাকা উপার্জন করে সম্পদের পাহাড় বানিয়েছেন।

কিছু লোক ইতোমধ্যে অনলাইনে বিবরণী দাখিল করেছেন। এটা খুব স্বাভাবিক। সারাদেশে কিছু লোক আইন জানবেন, কারিগরি জ্ঞানে এগিয়ে থাকবেন এবং সহজেই কর বিবরণী দাখিল করতে পারবেন- এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তবে এটা উদাহরণ নয়। আমাদের শঙ্কা হচ্ছে, এ বছর কর বিবরণী জমা প্রদানের কাজটিতে একটি হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হবে। সরকারের তহবিলে যথেষ্ট পরিমাণে কম কর জমা হবে। বছরের বাকি সময়টুকু করদাতা ও রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের ভেতর নানা ধরনের মিঠে-কড়া যোগাযোগ চলবে।

সরকারের উচিত ছিল, বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সহজ সমাধান নিশ্চিত করা এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে কর বিবরণী প্রস্তুত, কর বিষয়ে বিদ্যমান আইন, করের হার, রেয়াত পাওয়ার খাত ইত্যাদি সব বিষয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এর পরও নতুন পদ্ধতিতে বিবরণী দাখিলের বিষয়টি চট করে বাধ্যতামূলক না করে কমপক্ষে তিন বছর ঐচ্ছিক রাখা। এর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা করা এবং সব পক্ষের সম্মতিক্রমে তা চালু করা।

সরকার সব ক্ষেত্রে সংস্কার কাজ শুরু করার দায়িত্ব নিয়েছে। এই সংস্কার আমাদের জন্য ‘আশার’ হবে নাকি ‘হতাশার’ হবে তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এই উদ্যোগ দেখে বুঝতে পারছি না। তবে আমরা আশাবাদীদের দলে, আশায় বুক বেঁধেই আমরা অপেক্ষা করব। ডিজিটালি কর বিবরণী দাখিলের বর্তমান আদেশটির সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে এবার এটি ঐচ্ছিক করা হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


মাহফুজুর রহমান : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক