সাঁতারের গৌরব ফিরে আসবে কি
বাংলাদেশের বয়স বেশ আগেই পঞ্চাশ পেরিয়ে আরও সামনে। কিন্তু সাঁতার প্রসঙ্গ এলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিংবদন্তি সাঁতারু মোশাররফ হোসেনের নাম। এই নাম আর কেউ পেছনে ফেলতে পারেননি। অনেক দিন ধরে জলরাজ্যে তিনিই ছিলেন রাজা। সেই রাজার রাজত্ব ছিল অটুট, অজেয়। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে সাঁতার প্রতিযোগিতায় সাঁতারের এ রাজা বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। সেবার তিনি একাই ৫টি স্বর্ণ আর ২টি রৌপ্য পদক জয় করেছিলেন দেশের জন্য। এ রকম গৌরব আর কারও নেই, আর কেউ আসেনি। মোশাররফ হোসেনের পর সাঁতারে আরও অনেক প্রতিভার দেখা মিললেও কেউই তার সীমানা পেরোতে পারেননি। আর তাই এখনও মোশাররফ হোসেন এবং সাঁতার নামটি সমান্তরাল হয়ে আছে। মোশাররফের পর সাঁতারে তারকা হয়ে আসেন কারার মিজান, মোখলেসুর রহমান, বজলুর রহমান, আব্দুস সালাম, আব্দুর রফিক, মাহবুবুর রহমান, আবুল হোসেন ঢালি, মাহফুজা শীলা। উল্লিখিতরা সবাই সাফ গেমস থেকে সাঁতারে স্বর্ণ জয় করে নিয়ে আসেন দেশের জন্য।
অনেক দিন ধরেই সাঁতারে অনন্য কোনো প্রতিভার সন্ধান নেই। ২০১৬ সালে মাহফুজা আক্তার শীলা একইদিনে দুটি স্বর্ণ জয়ের মধ্য দিয়ে সাঁতারে নতুনদের জন্য যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, তার প্রমাণ আর মেলেনি। সেভাবে নতুন আর কাউকে পাওয়া যায়নি। পুরনোদের কেউও আর নতুন করে জ্বলে উঠতে পারেননি। সর্বশেষ নেপাল সাফ গেমসেও তাই সাঁতার ছিল স্বর্ণপদকশূন্য। তবে সব পেরিয়ে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন সাঁতারুরা। সম্প্রতি শেষ হওয়া জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতার মাঝে সেই স্বপ্নের প্রতিধ্বনি শোনা গেছে কর্মকর্তা ও সাঁতারুদের মাঝে।
এই তো কদিন আগে (৯-১২ নভেম্বর) জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতার ৩৩তম আয়োজন বসেছিল রাজধানীর মিরপুরের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাঁতার কমপ্লেক্সে। এবার ৩৩তম জাতীয় সাঁতারে বাংলাদেশ নৌবাহিনী দল ৩২টি স্বর্ণ, ২৬টি রৌপ্য ও ১২টি ব্রোঞ্জসহ মোট ৭০টি পদক লাভ করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দল ১০টি স্বর্ণ, ১৫টি রৌপ্য এবং ২৩টি ব্রোঞ্জসহ মোট ৪৮টি পদক লাভ করে রানার্সআপ হয়। মোট ১০টি নতুন রেকর্ড হয়েছে এবার। সেরা সাঁতারু হয়েছেন নৌবাহিনীর দুই সাঁতারু সামিউল ইসলাম রাফি এবং যুঁথী আক্তার। অবশ্য সমসাময়িক সময়ে এ দুজনকেই সাঁতারের প্রতিভাবান জুটি হিসেবে ভাবা হচ্ছে। এ দুজনকে নিয়েই স্বপ্ন বিস্তৃত হচ্ছে। সাঁতার ফেডারেশনের কর্মকর্তারা মনে করছেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ দুজন সামনে সাফ গেমস থেকে স্বর্ণপদক বয়ে আনতে পারবেন। সামিউল ইসলাম রাফি বর্তমানে বিশ্ব সাঁতার সংস্থা ফিনার বৃত্তি নিয়ে থাইল্যান্ডে গেছেন দুই বছর আগে। সেখানকার অনুশীলনের মাঝপথে তিনি বাংলাদেশে এসে ৩৩তম জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন। সামিউল ইসলাম রাফি সর্বশেষ অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু হিটে তিনি ৭৯ জনের মধ্যে ৬৯ হয়েছিলেন। যুঁথী আক্তার সামনে হাঙ্গেরিতে যাবেন বিশ্ব সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এক সময় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাঁতারে আমাদের সাফল্য ক্রীড়ামোদীদের হৃদয়ে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি করত। সাঁতারের তারকাদের সামাজিক কদরও দেখা যেত। কিন্তু এসব এখন ফিকে হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক লেভেল থেকে সাফল্য না আসার কারণে। অনেকেরই মনে আছে মোশাররফ হোসেনের ধারাবাহিকতায় সাঁতারে আলো ছড়িয়েছিলেন মোখলেসুর রহমান। ’৮৯ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে দেশের পক্ষে একমাত্র স্বর্ণপদক জিতেছিলেন তিনিই। ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে (সময় : ১.১০.০৫) সাফ রেকর্ড গড়েছিলেন। এর পর ’৯১ সালে তিনি শ্রীলংকার কলম্বো থেকেও ২০০ মিটারে স্বর্ণপদক জয় করার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। ’৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে ১০০ মিটার থেকে স্বর্ণপদক জয় করে তিনি পরপর তিনবার স্বর্ণপদক জেতার অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে দেশকে সম্মানিত করেছিলেন।
এর পর নব্বই দশকে মোখলেসুরের সঙ্গে পুলে ঝড় তুলেছিলেন আরেক অনন্য সাঁতারু কিশোরগঞ্জের নিকলী থেকে উঠে আসা কারার মিজান। ’৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাফ গেমসে ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে স্বর্ণ জিতেছিলেন তিনি। এর পর ’৯৫ সালে ভারতের মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত ৭ম সাফ গেমসে ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে (২.৩২.০৫) তিনি স্বর্ণপদক জিতে বাংলাদেশের মর্যাদা উঁচুতে তুলে ধরেছিলেন। ’৯৬ সালে অংশ নিয়েছিলেন আটলান্টা অলিম্পিকে। কিন্তু সেই যে গেলেন আর ফিরে এলেন না। সাঁতারু কারার মিজান যুক্তরাষ্ট্রেই থেকে যান।
তবে মেয়েদের সাঁতারে মাহফুজা শীলার মতো কেউই আলো ছড়াতে পারেননি। শীলা এখন প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। ২০১৬ সালে ক্রীড়াভুবনের নতুন সৌন্দর্য হয়ে এসেছিলেন সাঁতারু মাহফুজা আক্তার শীলা। যশোরের এ মেয়েটি সেবার গোহাটি এসএ গেমসে ব্রেস্টস্ট্রোক সাঁতারে পরপর দুটি স্বর্ণজয় করে গোটা দেশকে অন্যরকম এক মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন। গেমসের তৃতীয় দিনে ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে প্রথম স্বর্ণ জয় করেন তিনি। এর পর মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে রেকর্ড গড়ে স্বর্ণ জয় করলে শীলার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। একটু মনে করিয়ে দিই, ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে ’৯৭ সালে শ্রীলংকার রহিমা মাইউমির গড়া রেকর্ড চূর্ণ করেছিলেন মাহফুজা শীলা। আর টানা দশ বছর ধরে সাঁতারে পদক প্রাপ্তির যে বন্ধ্যা চলছিল, সেটাও তিনি ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন সে সময়। সাঁতারে শীলা যে সাফল্য দেখিয়েছিলেন, এর আগে এভাবে তা কেউ করতে পারেননি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
গোহাটিতে শীলা যে সাফল্য পেয়েছিলেন, সেখানে ছিল স্বপ্ন, দীর্ঘ সংগ্রাম আর একদল মানুষের পরিশ্রম। যশোরের নওয়াপাড়ার এ মেয়েটির জন্ম হয়েছিল একটি সাধারণ পরিবারেই। যে পরিবারে অভাব-অনটন ছিল। পরিবারের অনেক চাহিদাই যেখানে অপূর্ণ থাকত। কিন্তু সব বাধার দেয়াল পেরিয়েই উদ্ভাসিত হয়েছিল শীলা। কিন্তু এ রকম প্রতিভার সন্ধান এখন মিলছে না বললেই চলে। সে কথাই বলছিলেন সুইমিং ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক সেলিম মিয়া। তার মতে, ‘২০১৬ সালে এসএ গেমসে সাঁতারে শীলা একই দিনে দু-দুটো স্বর্ণ জয় করে এক নতুন প্রেরণার জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতায় আমরা তেমন নতুন কাউকে আর পাইনি। ফলে নেপাল থেকে খালি হাতেই ফিরতে হয়।’ সেলিম মিয়া জানান, বহুবিধ সমস্যার মধ্য দিয়ে এখন সাঁতার ফেডারেশনকে কাজ করতে হচ্ছে। প্রথমত, অনেকদিন ধরেই স্কোর বোর্ডটি অচল। স্কোর বোর্ড অচল থাকার কারণে হ্যান্ড টাইমিংয়ে রেকর্ড রাখতে হয়। অচল স্কোর বোর্ড সচল করার কোনো উদ্যোগ নেই। এদিকে পুলের লেনগুলোও অকেজো হয়ে গেছে, স্ট্যাটিং ব্লকগুলো নড়বড়ে। তার মতে, এ আধুনিক ডিজিটাল যুগে যদি এ ধরনের সমস্যা বিদ্যমান থাকে, তাহলে সুইমিংয়ে ভালো ফলাফল বয়ে আনা এক কঠিন বিষয়। কেননা এসব দিক দিয়ে সাফের অন্যান্য দেশ অনেক এগিয়ে গেছে।
সামনে সাফ গেমস অনুষ্ঠিত হবে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। বিকেএসপির অধীনে এখন ২৪ জন সাঁতারু নিয়মিত অনুশীলন করছেন। এই গ্রুপে রয়েছেন এবারের দুই তারকা রাফি এবং যুঁথী। এ দুজন এবারের জাতীয় সুইমিংয়ে সবচেয়ে বেশি দ্যুতি ছড়িয়ে সবার নজর কেড়েছেন। দুজনই একাধিক রেকর্ড করেছেন। সুইমিং ফেডারেশনে যুগ্ম সম্পাদক, সাঁতারের জন্য নিবেদিতপ্রাণ সেলিম মিয়া দুই সাঁতারু রাফি ও যুঁথীকে নিয়ে খুবই আশাবাদী সামনের সাফ গেমসে। তার বিশ্বাস, সব ঠিক থাকলে এ দুজন দক্ষিণ এশিয়ার লড়াইয়ে সাঁতারের পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে। কিন্তু সাঁতারের অবকাঠামোর দ্রুত উন্নতি করা না হলে বিপর্যয়কেই বরণ করে নিতে হবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
জাহিদ রহমান : সাংবাদিক ও গবেষক