ডায়াবেটিস ও আর্থিক অসচ্ছলতা
আর্থিক অসচ্ছলতার সংজ্ঞা ও শ্রেণি-বিন্যাস বিভিন্ন সংস্থা (যেমন- বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ ইত্যাদি) কর্তৃক বিভিন্নভাবে দেওয়া হয়েছে, যা স্থান-কালভেদে পরিবর্তনশীল। আর আর্থিক কথাটির সঙ্গে আর্থ-সামাজিক কথাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যা কখনো কখনো সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বিভিন্ন গবেষণালব্ধ তথ্যের মাধ্যমে জানা যায়, আর্থিক অসচ্ছলতার সঙ্গে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কিত। আবার যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হওয়া এবং ডায়াবেটিসের জটিলতাগুলো আর্থিক অসচ্ছল অবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এখানে এসব তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে আর্থিক অসচ্ছলতার সঙ্গে ডায়াবেটিসের বহুমাত্রিক সম্পর্কগুলো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হলো।
বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৫৪ কোটি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি আছেন। এদের ৮০%-এর বেশি আক্রান্ত ব্যক্তি হচ্ছেন মধ্যম এবং নিম্নআয়ের দেশগুলোতে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, অতি নিম্নআয়ের জনসংখ্যার ডায়াবেটিসের হার মধ্যম আয়ের জনসংখ্যার চেয়ে প্রায় ৫০% বেশি। শিশু-কিশোরদের মধ্যেও যাদের পরিবারের আয় অতি নিম্ন থেকে মধ্যম শ্রেণির, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি দেড় থেকে দুই গুণ বেশি। উচ্চ আয়ের পশ্চিমা বিশ্বেও জনগণের যে অংশের আয় নিম্নতর তাদের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। একই সঙ্গে দেখা গেছে, আর্থ-সামাজিক পশ্চাদপদতার কারণে ডায়াবেটিসের জটিলতা, মৃত্য্যুর হার এবং অকাল মৃত্যুও বেড়ে যায়। অবশ্য এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, নিম্নতর আয়ের দেশগুলোর পরিসংখ্যান সব সময় সঠিকভাবে পাওয়া যায় না।
অনির্ণীত ডায়াবেটিস : পৃথিবীতে যত ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তি আছেন তাদের প্রায় ৪৫% ব্যক্তি (প্রতি দুজনের মধ্যে প্রায় একজন) জানেন না যে তার ডায়াবেটিস আছে। অর্থাৎ তারা ডায়াবেটিস চিকিৎসা সেবার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন, যা ভবিষ্যতে বড় বোঝা তৈরি করতে পারে। যেসব দেশের আর্থ-সামাজিক সামর্থ্য এবং সুযোগ কম সেসব দেশেই অনির্ণীত বা ঁহফরধমহড়ংবফ ডায়াবেটিসের হার বেশি। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে এই হার যেখানে ৩০%-এর কম, সেখানে নিম্নআয়ের দেশগুলোতে এই হার ৫০%-এর উপরে। বাংলাদেশেও প্রায় ৪৪% লোক জানেন না তার ডায়াবেটিস আছে। আর্থিক সমস্যার কারণে সময়মত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয় না, ফলে ডায়াবেটিস নির্ণয় হতেও দেরি হয়।
খাবারের সমস্যা : খাবারের অনেক বিষয়ই আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ খাবারের অভাব, খাবারের স্বল্পতা বা ক্যালোরির অভাব, প্রয়োজনীয় খাবারের উপাদানগুলোর অভাব, অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ খাবারের সহজ প্রাপ্যতা, খাবার পছন্দ করার ক্ষেত্র সীমিত হওয়া ইত্যাদি ডায়াবেটিসকে অনিয়ন্ত্রিত করতে পারে। অনিরাপদ এবং অস্বাস্থ্যকর খাবারের রোগ-প্রতিরোধী ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ায় এবং বিভিন্ন ধরনের হরমোনের নিঃসরণ বৃদ্ধির মাধ্যমেও ইনসুলিন রেজিস্টেন্স ও ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। একই সঙ্গে এগুলো ডায়াবেটিসকে অনিয়ন্ত্রিত করতে পারে এবং জটিলতার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। আবার সহজলভ্য সস্তা অত্যধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার খেয়ে অনেকেরই স্থূলতা দেখা দেয়, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বাধা দেয়, একই সঙ্গে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ আর্থিক অসচ্ছলতা একদিকে পুষ্টিহীনতা, আরেক দিকে স্থূলতার দ্বৈত বোঝা সৃষ্টি করে।
গর্ভকালীন অপুষ্টি বা শৈশবের অপুষ্টি ওই শিশুদের ভবিষ্যতে স্থূলতার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় এবং প্যানক্রিয়াসের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যা ভবিষ্যতে তাদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
ব্যায়াম না করার সমস্যা : বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মধ্যম বা নিম্নআয়ের লোকদের বাসস্থান বা এর আশপাশে ব্যায়াম করার সুযোগ-সুবিধা কম থাকে। পেশাগত কারণে তারা ব্যায়াম করার সময়ও কম পান। কোনো জিমে গিয়ে বা ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি কিনে ব্যায়াম করারও কোনো সুযোগ তাদের নেই। এই অসুবিধাগুলো তাদের ডায়াবেটিসকে অনিয়ন্ত্রিত করে। একই সঙ্গে ওজন বৃদ্ধিরও ঝুঁকি থাকে। সবকিছু মিলে তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। তবে যারা পেশাগতভাবে ভারী পরিশ্রমের কাজ করেন (যেমন দিনমজুর, খেলোয়াড় ইত্যাদি) এই অসুবিধাগুলো তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সমস্যা : ওষুধপত্র, চিকিৎসা ও পরীক্ষার সরঞ্জাম (যেমন- ইনসুলিন, সিরিঞ্জ, গ্লুকোমিটার ইত্যাদি), নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপ ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, জটিলতার পরীক্ষা ও চিকিৎসা, হাসপাতালে ভর্তি ইত্যাদি সবই বেশ ব্যয়বহুল, যা অনেকের পক্ষেই বহন করা কঠিন। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে চিকিৎসার অত্যন্ত জরুরি এই উপাদানগুলো মাঝে-মধ্যে বা নিয়মিতভাবে বাদ পড়তে থাকলে একদিকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ যেমন কঠিন হয়ে যায়, অন্যদিকে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতাগুলো সময়মতো ধরা পড়ে না। আর যখন জটিলতাগুলো ধরা পড়ে তখন সেগুলোর চিকিৎসা ব্যয় মেটানো আরও কঠিন হয়ে যায়।
শিক্ষার অভাব : আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে শিক্ষাও অনেকাংশে ব্যাহত হয়। শিক্ষার অভাবেও ডায়াবেটিস সম্বন্ধে জ্ঞান, ধারণা, সচেতনতা, সক্রিয়তা ইত্যাদি কমে যায়। এসবের নেতিবাচক প্রভাবে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। শিক্ষার অভাব ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।
বাসস্থান এবং পরিবেশগত সমস্যা : আর্সেনিকযুক্ত পানি এবং বায়ু দূষণকে আজকাল ডায়াবেটিসের কারণ হিসেবে বেশ জোরালোভাবে দায়ী করা হচ্ছে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস আর্সেনিকযুক্ত পানির ব্যবহার এবং বায়ু দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। তদুপরি বাসস্থান এবং পরিবেশগত সমস্যা স্বাস্থ্যকর খাবারের যোগান এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার জন্যও অনুকূল নয়। এই সবকিছুই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য অনুকূল নয়।
মানসিক সমস্যা : মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, বিষণ্নতা ইত্যাদি আর্থিক অবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত আরও কিছু বিষয়, যেমন খাবার ও বাসস্থানের সমস্যা এবং পেশাগত সমস্যাও এসব মানসিক সমস্যাকে প্রকট করে তুলতে পারে। মানসিক বিভিন্ন সমস্যা প্রভাবিত করার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকে যেমন বিপন্ন করে তেমনি নতুন করে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিও অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
নগরায়ণজনিত সমস্যা : দ্রুত নগরায়ণের ফলে নিম্ন অর্থবিত্তের জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে তাদের খাবার দ্রুতই অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ে (যেমনÑ ফাস্টফুড খাওয়া); শারীরিক পরিশ্রম কমতে থাকে (যেমনÑ সিঁড়ির বদলে লিফট-এর ব্যবহার); একই সঙ্গে যোগ হতে পারে বাসস্থান এবং পেশা পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। ধূমপান/তামাক গ্রহণের উচ্চহারও এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়। এগুলো তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি, রক্তের গ্লুকোজ অনিয়ন্ত্রিত হওয়া এবং স্থূল হওয়ার প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করে।
টাইপ ১ ডায়াবেটিসের সমস্যা : শৈশবে বিভিন্ন ভাইরাস সংক্রমণ টাইপ ১ ডায়াবেটিস অথবা অন্যান্য বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। আর্থিক অসচ্ছলতার সঙ্গে এসব সংক্রমণের নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও টাইপ ১ ডায়াবেটিসের সঙ্গে আর্থিক অসচ্ছলতার কোনো যোগসূত্র এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উন্নত বিশ্বেও টাইপ ১ ডায়াবেটিক শিশু-কিশোরদের একটি মারাত্মক আকস্মিক জটিলতা ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২ গুণের বেশি বেড়ে যায়; শিশু-কিশোরদের মধ্যে ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস নিয়ে নতুন ডায়াবেটিস ধরা পড়ার প্রবণতা ৪১% বেশি।
সামাজিক বৈষম্য এবং অসামঞ্জস্য : আর্থিক তথা আর্থ-সামাজিক অবস্থা ভেদে ডায়াবেটিস চিকিৎসা সেবাতেও যে তারতম্য হয় তা অনস্বীকার্য। এর ফলে চিকিৎসা উপকরণের বৈষম্য, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অসামঞ্জস্য, হাসপাতালে ভর্তিতে সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণগুলো থেকে উদ্ভূত মানসিক সমস্যা বা বিষণ্নতা, যার সবকিছু মিলে ডায়াবেটিস নির্ণয়, নিয়ন্ত্রণ এবং জটিলতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর ডায়াবেটিসের প্রভাব : ওষুধপত্র, চিকিৎসা ও পরীক্ষার সরঞ্জাম নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপ এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, জটিলতার পরীক্ষা ও চিকিৎসা, হাসপাতালে ভর্তি ইত্যাদি সবই বেশ ব্যয়বহুল যা অনেকের পক্ষেই বহন করা সহজ নয়। এসব কারণে পরিবারে একজন লোকেরও যদি ডায়াবেটিস থাকে তা পরিবারের আর্থিক বোঝা অনেক বাড়িয়ে দেয়। আবার কেউ যদি ডায়াবেটিসের কারণে ঘন ঘন অসুস্থ হন, অথবা ডায়াবেটিসের জটিলতার শিকার হন (যেমনÑ অন্ধত্ব বা পঙ্গুত্ব) তবে সেটা তার পেশার উপর তার উৎপাদনশীলতার উপর এবং তার আয়ের উপরে প্রভাব ফেলে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারীভাবে পরিবারের উপর এবং একই সঙ্গে সমাজের উপর পড়ে।
সারা বিশ্বে সব স্বাস্থ্যসেবা খাতে যত খরচ হয় তার প্রায় ১২% খরচ হয় ডায়াবেটিসজনিত কারণে। বাংলাদেশেও জনপ্রতি ডায়াবেটিসজনিত বাৎসরিক খরচ ৯০০০ টাকার বেশি।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, ডায়াবেটিসের জটিলতা প্রতিরোধ- ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই অনুন্নত আর্থিক তথা আর্থ-সামাজিক অবস্থা প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। এ অবস্থার উন্নতি করা একটি বেশ কঠিন এবং জটিল কাজ। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ সমন্বিতভাবে কাজ করলে এই অবস্থা অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
ডা. তারীন আহমেদ : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), ডিসট্যান্স লার্নিং প্রোগ্রাম (ডিএলপি), বাডাস