আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বস্তুনিষ্ঠ হোক

মাহমুদ রেজা চৌধুরী
০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বস্তুনিষ্ঠ হোক

গত সেপ্টেম্বর ৩০ তারিখ থেকে অক্টোবরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিলাম। মূলত ঢাকায়। নিজের চোখে দেখা কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু বাস্তবতা, কিছু সন্দেহ, কিছু অমীমাংসিত বিষয়। কিছু অস্থিরতা। কিছু ভয়। কিছু ভয়ের সংস্কৃতি। কিছু আত্মঘাতী বিষয় চোখে পড়ে। এর সঙ্গে অনেকেই ভিন্নমত প্রকাশ করবেন বা দ্বিমত করবেন। এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে নিজের দেখাকেও তো আর অস্বীকার করতে পারি না। সবকিছু মিলে অল্প কয়েকদিনের দেশে থাকার অভিজ্ঞতাকে এক কথায় বলতে হলে বলতে হয়, জানি না, সামনে কী হবে!

সেসব দেখার অভিজ্ঞতার পেছনের ভাবনা সম্পর্কে লেখার চেষ্টা করছি। মনে পড়ে, দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) তার একটা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Critique of Judgment’ বইটার কিছু কথা। ইমানুয়েল কান্ট মূলত অষ্টাদশ শতকের অন্যতম এক দার্শনিক হিসেবে সমাদৃত। তার দর্শনের মূল কথা হলো, নীরবে, নিভৃতে সবকিছুতে অভিনবত্ব ও পরিবর্তন আনাই ‘উদ্ভাবনী চেতনার’ পরিচয়। আর প্রজ্ঞাবানরাই এই চেতনার পরিচয় দিতে পারেন। তার তত্ত্বজিজ্ঞাসা ছিল মূলত জ্ঞানতত্ত্ববিষয়ক সমস্যা সম্পর্কিত। তাই নতুন এক জনতত্ত্বের প্রবর্তক ও উদ্ভাবক হিসেবে দর্শনচর্চার ক্ষেত্রে তিনি সুপরিচিত এবং সমাদৃত। তার সেই জ্ঞানতত্ত্ব হলো বিচারবাদ (critical philosophy)। এটা বুদ্ধিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ ও ভাববাদের সমন্বয়ে একটা স্বতন্ত্র দার্শনিক মতবাদ। কান্ট জনতত্ত্বেtranscendental Idialism-এর সমন্বয় করেছেন।

সম্প্রতি বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কান্টের দর্শন বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হয়। যা হোক এই লেখায় দার্শনিক কান্টের কথা উল্লেখ করার একটা কারণ হচ্ছে, আমাদের অনেক শিক্ষিতজনের মধ্যে কান্টের দৃষ্টিনন্দনতত্ত্ব বিষয়টা লক্ষ করি কম। সবকিছুতে একটা হাঙ্গামা, অস্থিরতা এবং তীব্র নেতিবাচক সমালোচনা বেশি হয় বা অন্ধ তোষামোদিতে ভরা। আমাদের অনেক জ্ঞানী এবং প-িতের দৃষ্টি কোথায় যেন বন্দি থাকে কোনো এক মোহে। বর্তমানে যাই দেখি তা নিকট-অতীতেও যে এক ছিল কমবেশি। ভুলে যাই। সেই সম্পর্কে কথাই বলি না। কেন বলি না, তাও জানি না।

এর শত শত দৃষ্টান্ত আছে। আপাতত একটা ছোট্ট দৃষ্টান্ত নিয়ে কথা বলি। ঘটনাটা ঘটেছে সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমিতে এক নাটক মঞ্চায়ন নিয়ে এবং সেটা পরে মঞ্চস্থ বন্ধ করা প্রসঙ্গে। আমরা একদল এতে খুব উত্তেজিত হয়ে গেছি। হওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু এই আমরা এত দ্রুত ভুলে গেলাম যে, এ রকম অসংখ্য ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সাম্প্রতিককালেও অনেক ঘটেছে বিগত সরকারের আমলেও। দেশের এক কিশোর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এক কার্টুন আঁকায়ও তার সাজা হয়েছে। তাকে বন্দি করে আনা হয়েছে। এটাও তো আরেক ধরনের নাটক, তাই নয় কি! কই তখন তো এটা নিয়ে আমরা এত মাথা উঠাইনি প্রতিবাদে। অসত্য কি! দেশের প্রধানমন্ত্রীর কোনো সমালোচনা করা যাবে না। হলে সেটাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলা হবে। এ রকম শাসনব্যবস্থাও তো আমরা দেখেছি।

অল্প কিছুদিন ঢাকায় প্রায় প্রতিদিন দেখেছি নানান মিছিল, নানান দাবি, নানান আন্দোলনের হুমকি! কেন রে বাবা! বর্তমান সরকার তো নির্বাচিত কোনো সরকার নয়। তাদের কাছে কিসের এত দাবি পূরণের মিছিল! মাত্র তিন মাস গেল।

এর মধ্যে তিন লাখ দাবি ইতোমধ্যে উঠে গেছে নানান মহল থেকে এই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে। কোথায় ছিলেন আপনারা, কোথায় ছিলাম আমরা গত ১৫ বছর! দৃষ্টির ‘নন্দনতত্ত্বের’ দিকেও দৃষ্টি দিন শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট, নেতা, বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানীরা প্লিজ। বর্তমান সরকারের প্রধান কয়েকটা ভুলের কারণে আজকের এই অবস্থা অনেকটাই তৈরি হয়েছে। কী ভুল ছিল!

১. প্রথম ভুল, বিগত সরকারপ্রধানকে এত নিরাপদে দেশ ছেড়ে দিতে সুযোগ করে দেওয়া। সেখানে আরও কিছু রক্ত বয়ে গেলে জাতির জন্য অনেক সংকট ‘সম্ভাবনা’ কমে যেত। এটা আমরা করতে পারিনি, কারণ আমাদের দেশাত্মবোধের অভাব। দাসত্বের প্রতি ভালোবাসার প্রভাব বেশি।

২. দ্বিতীয় ভুল, রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে ক্ষমতায় রেখে শপথ নেওয়া এবং এই ব্যক্তির এখনও ক্ষমতায় থাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ রকম নিম্ন রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব কখনই এই পদে আসেননি।

৩. তৃতীয় ভুল, বিগত সরকারের অনেক ক্রিমিনালকে বিনা বিচারে দেশ ত্যাগ করার পথ সহজ করে দেওয়া। যারা এই কাজটা করেছেন কোনো না কোনো একদিন তাদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

৪. চতুর্থ ভুল, দেশের সংবিধানকে স্থগিত না করে চট করেই এটাকে ‘পরিবর্তন’ করার সিদ্ধান্তে সরাসরি চলে যাওয়া। তবে বর্তমান সংবিধান, যা এক ধরনের ‘হাসিনা বিধান’, এর পরিবর্তন অবশ্যই জরুরি। এই বিষয়টাকেও হালকা করে দেখা যাবে না। এখন একজন প্রজ্ঞাবান এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে সংবিধান পরিবর্তনের যে সুপারিশ কমিটি করা হয়েছে, আমাদের এই সুযোগকে যথাযথ গ্রহণ করতে হবে আগামী বাংলাদেশের জন্য।

৫. সব রাজনৈতিক কর্মকা-, সভা, মিছিল, আন্দোলন, অন্তত দুই বছরের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যৌক্তিক ছিল। এটাও বর্তমান সরকারের আরেক সীমাবদ্ধতা বা ভুল।

৬. সোশ্যাল মাধ্যম ও দেশে সব ধরনের টক শোগুলোর সব রকম প্রচার, আলোচনা এবং বিতর্ক দুই বছরের জন্য বন্ধ করা দরকার ছিল।

৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তাৎক্ষণিক নিয়ন্ত্রণে সামরিক বাহিনীর সরাসরি সহযোগিতা এবং তাদের ভূমিকা আরও বেশি সক্রিয় করা দরকার।

এর বাইরেও আরও কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, নিঃসন্দেহে। আপাতত সংক্ষেপে উল্লেখিত বিষয়গুলোও জরুরি বলে মনে হয়।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের মিডিয়া কথাশিল্পীদের একজন বললেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ব্যাপারে আমাদের অনেকের মধ্যে একটা ‘সস্তা’ দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে, ভারত বিরোধিতা! ভারত বিরোধিতা নাকি সস্তা প্রতিক্রিয়া! টেলিভিশন কথাশিল্পী বোঝাতে চেয়েছেন, ভারতের ব্যাপারে বুদ্ধিমান হতে হবে, রাজনৈতিক ‘কৌশলী’ হতে হবে। ভারত বড় দেশ। ভারতের ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু কম নয়। এটা সস্তা প্রতিক্রিয়া কিনা জানি না, তবে মনে হয় ভারতের ব্যাপারে আমাদের আনুপাতিক শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকা দরকার বেশি। ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের এবং অর্থনীতির সম্পর্ক হবে পারস্পরিক ও আনুপাতিক হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে। কোনো আবেগ বা বিভ্রান্তমূলক প্রচারের মধ্যে নয়। সাম্প্রদায়িকতার কোনো অজুহাতেও নয়। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের মতো ‘অসাম্প্রদায়িক’ রাষ্ট্র ভারত কখনই ছিল না, আর কখনও হবে না।

বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। প্রত্যেকেরই এই দেশ। বাংলাদেশের অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীরা যদি ভারতকে তাদের বন্ধু বলে মনে করেন। সেটাও দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত নয়। ভারতে মুসলমানরা অত্যাচারিত হলে তারা দেশ ছেড়ে সৌদি আরব বা পাকিস্তানে যায় না। তারা ভারতের মধ্যে থেকেই তার প্রতিবাদ করেন। আমাদের রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং ক্ষমতা লোভের কারণে আমরা ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে ভারতপ্রীতি বাড়াতে গিয়ে কেউ, কেউ একে ‘কৌশলী’ বা তথাকথিত ভূরাজনীতি নামেও আখ্যায়িত করতে চাই। এই ভূরাজনীতি কি ভারত রাজনীতি কিনা জানি না। আমাদের সচেতন দেশপ্রেম ও জনমত এই ধরনের ভূরাজনীতির বিপক্ষেই দাঁড়াবে।

ভারত বড় দেশ বলে তাদের কথায় উঠতে-বসতে হবে, এর কোনো বিকল্প হবে না! এই দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য কঠিন দৃষ্টিভঙ্গি ও অনান্দনিক। ভারতকৌশলী ও ভারতপ্রীতি বাড়ালে বুদ্ধিজীবী হওয়া যেতে পারে কিন্তু দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না।

আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং এর প্রকাশে দৃষ্টিনন্দনতত্ত্বের অভাব বাড়ছেই। তাই আমরা ইদানীং বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন, চিন্তা ও মননেও। আমাদের সামনের জেনারেশনের মধ্যেও এর নেতিবাচক প্রভাব বাড়ছে। ওরা বড় হচ্ছে, ওদের বড়দের বলতে আমাদের হিংসা, প্রতিহিংসা, অমানবিকতা, শত্রুতা, ঘৃণা, অসহনশীলতা, অধৈর্য ও পরশ্রীকাতরতা দেখে দেখেও। সেই কারণে আমাদের সব দেখার মধ্যেও একটা নন্দনতত্ত্বের চর্চা থাকা দরকার। আমরা সেটা হারিয়ে ফেলছি।

আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির একটা মাত্রা হলো, নিশ্চয়তার মাত্রা। Modality সম্পর্কিত। এই আকার প্রয়োগ করে আমরা দেখতে পাই, যা সুন্দর তা অনিবার্যভাবে আমাদের সন্তোষের অনুভূতিকে জাগাবে। এটাকে কান্ট ‘Purposefully Purpossiveless’ বলেন। তার ভাষামতে, সুন্দর বস্তু আমাদের সৌন্দর্যমূলক অনুভূতিকে পরিতৃপ্ত করে। তাই এটা উদ্দেশ্যযুক্ত। অন্যদিকে সেই অনুভূতিকে পরিতৃপ্ত করা ছাড়া সুন্দর বস্তুটির কোনো অতিরিক্ত উদ্দেশ্য নেই। আমরা আমাদের ব্যক্তিগত বা দলীয় ক্ষুদ্র শ্রেণির স্বার্থে অনেক কিছুকে সুন্দর হিসেবে দেখতে গিয়ে ‘অতিরিক্ত’ সুন্দর করতে চাই তাকে। তখন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর সুন্দর থাকে না, বস্তুনিষ্ঠ থাকে না। পক্ষপাতিত্বের দিকেও হাঁটে। আপাতত বাংলাদেশ সেই একই পথে হাঁটছে কিনা নতুন পোশাকে! আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে তা বুঝতেও।

পুনশ্চ: ভালো কিছু হতে হলে আমাকেও ‘ভালো’ হতে হয়, আমি কী ভালো হয়েছি, না ভালো হতে চাই, নাকি নিজের বর্ণনায় শুধু অন্যের ‘ভালো’ দেখতে চাই!


মাহমুদ রেজা চৌধুরী : লেখক ও সামাজিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক