ট্রাম্প বনাম কমলা, সমানে সমান
৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। মার্কিন নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র দুই দিন। কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ইতোমধ্যে আগাম ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে গেছে। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের প্রতিটিতে নিজস্ব ভোটিং পদ্ধতি রয়েছে। পোস্টের মাধ্যমে ভোট বা সশরীরে গিয়ে আগাম ভোট, নির্বাচনের দিন ভোটÑ এ তিনটি পদ্ধতিতেই ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক পরিবার আছে যারা আগাম ভোট দেওয়াকে পারিবারিক ঐতিহ্য বলে বিবেচনা করেন। এই নির্বাচনে কে এগিয়ে, কে পিছিয়েÑ অনুমান করাই বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছে গোটা বিশ্ব। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এবারের ভোট বিশ্ব রাজনীতির অনেক কিছুতে প্রভাব ফেলবে। যার মধ্যে রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-হামাস-হিজবুল্লা-ইরান এবং চিন-তাইওয়ান সংঘাত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত কোনো নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। যদি কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হন তা হলে আলান্টিকের পারের দেশটিতে তৈরি হবে নয়া ইতিহাস। ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা বর্তমানে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন। অন্যদিকে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ট্রাম্প ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দেশটির নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন না। তিনি নির্বাচিত হন ইলেকটোলদের ভোটে। সাধারণ নাগরিকরা ইলেকটোরালদের নির্বাচন করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের মোট আসন সংখ্যা ৫৩৮টি। এই নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেকটোরাল আসন অর্জন করতে হবে। প্রতিটি রাজ্যের জন্য ইলেকটোরাল আসন সংখ্যা রাজ্যটির জন্য বরাদ্দকৃত সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের মোট আসন সংখ্যার সমান। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গণনা পদ্ধতি দুটি। একটি হলো মাথাপিছু ভোট, যাকে বলে পপুলার ভোট। অপরটি হলো রাজ্যভিত্তিক ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মার্কিন গণতন্ত্রে পপুলার ভোটের চেয়ে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। একজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সর্বাধিক পপুলার ভোট অর্জন করলেও তাকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না। কিন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট (২৭০) অর্জন করতে সক্ষম হলেই প্রেসিডেন্ট হওয়ার নিশ্চয়তা দান করে। উল্লেখ্য, ২০০০ সালে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী আল গোর ওই সময়ে সর্বাধিক পপুলার ভোট পেয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। কারণ তার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান দলের জর্জ বুশ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়েছিলেন ২৭১টি। অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ১টি বেশি। আর এতেই তিনি আল গোরকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন।
নির্বাচনী প্রচারণার পুরো সময় বেশির ভাগ জরিপেই এগিয়ে ছিলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস। কিন্তু শেষ ভাগের জরিপে দেখা যাচ্ছে ভিন্নচিত্র। ট্রাম্প অভাবনীয় উন্নতি করেছেন। সর্বশেষ জাতীয় জরিপে দেখা যাচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন কমলা হ্যারিস। নির্বাচনের আগের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টায় একের পর এক অভিযোগের পাহাড় ডিঙিয়ে জনপ্রিয়তায় হ্যারিসের কাতারে চলে এসে ট্রাম্প শুধু নিজের অবস্থানই শক্ত করেননি, রিপাবলিকান শিবিরেও নিয়ে এসেছেন স্বস্তির পরশ। তবে জনমত জরিপ যা-ই হোক, নির্বাচনে হোয়াইট হাউসের গদি দখল করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না দুই প্রার্থীর কেউই। প্রচারণার শেষ সময়টায় দোদ্যুলমান রাজ্যগুলোর ভোটার টানতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। এবারের নির্বাচনী প্রচারে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস নিজের প্রস্তাবিত অর্থনীতির রূপরেখাকে বলেছেন ‘অপরচুনিটি ইকোনমিক্স’ বা ‘সুযোগের অর্থনীতি’। সেখানে মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধের কথা আছে, আছে ওষুধের দামের ঊর্ধ্বসীমার কথা, গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সুবিধাদায়ী ব্যবসাকে সাশ্রয় দেওয়ার কথা। আর আছে অতিধনীদের কর বাড়ানোর দুঃসাহসী প্রস্তাব। এবং পুরোটাই যেন অনুদানের রাজনীতির মোড়কে পোরা। যেমন, প্রথমবার বাড়ি কেনার জন্য আমেরিকানদের চার বছরের মধ্যে ২৫,০০০ ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন হ্যারিস। ২০২১-এ বাইডেন তার প্রস্তাবিত আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যানের অঙ্গ হিসাবে ঘোষণা করেন চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট। তার পাশাপাশি শিশুর জন্মের প্রথম বছরে পরিবারকে অতিরিক্ত ৬,০০০ ডলার কর ছাড় দিতে চাইছেন কমলা। হ্যারিসের আর্থিক প্রতিশ্রুতির লক্ষ্য প্রধানত শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্তরা, বিশেষত যেসব তরুণ উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাননি, তারা। তাদের মধ্যে রয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গরা, হিসপ্যানিকরা। তারাই প্রধানত ডেমোক্র্যাটদের ভোটব্যাংক। তাই ভোটের মুখে হ্যারিসের প্রস্তাব যে সুনির্দিষ্টভাবে নিজেদের ভোটব্যাংককে সন্তুষ্ট করতেই, সে বিষয়ে সন্দেহ কম। কিন্তু কমলার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য যে বিপুল বাজেট ঘাটতি হবে, সেটি কীভাবে সামলাবেন, সেই উত্তর দেননি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
তবে অতীতে নির্বাচনী বিতর্ক সভ্যতার মোড়কে বিভিন্ন নীতি নিয়ে আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন তা অনেকাংশেই মিথ্যাচারণ, অসংলগ্নতা, রুক্ষ চিৎকার ও অপরিণতমনস্কতার প্রতিফলন। লাল (রিপাবলিকান) ও নীল (ডেমোক্র্যাট), দুই দলেরই মানুষের করের টাকা সামাজিক সুরক্ষা, কড়া বন্দুক আইন প্রণয়ন, শিশুসুরক্ষা, স্বাস্থ্যবিমা এবং সীমান্ত সুরক্ষায় ব্যয় করা উচিত। কিন্তু সেই আলোচনাটা এবার তেমনভাবে লক্ষ করা যায়নি।
জনমত জরিপগুলোতে দেখা গেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর কমলা হ্যারিসের জনপ্রিয়তা প্রায় সমান। প্রশ্ন ওঠে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা নিয়ে। যে ব্যক্তি চৌত্রিশটি ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তার প্রতি এহেন জনসমর্থন কেন?
এর কারণ খুঁজতে হবে আমেরিকার গত সত্তর বছরের ইতিহাসে। ১৯৫০ থেকে আমেরিকার ভারী শিল্পে মন্দা শুরু হলো। যেসব প্রদেশ এসব ভারী শিল্পে পারদর্শী ছিল, সেগুলো মূলত আমেরিকার উত্তর-পূর্ব, মধ্য-পশ্চিম আর দক্ষিণে অবস্থিত। এর মধ্যে আছে পেনসিলভানিয়া, নিউইয়র্ক প্রদেশের আপস্টেট নিউইয়র্ক অঞ্চল, ওহাও, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ইন্ডিয়ানা, মিশিগান ইত্যাদি। এই অঞ্চলগুলোর মূলতন্ত্রী ছিল ইস্পাত আর গাড়ি তৈরির শিল্প। সেজন্যই এই প্রদেশগুলোর নামকরণ হয়েছিল ইস্পাত-বেল্ট। এর পর আমেরিকার বাজারে এলো জাপানি গাড়ি ছিমছাম, তুলনায় কম-তেলে-চলা হুন্ডা আর টয়োটা এসে আমেরিকার ফোর্ড আর জেনারেল মোটরসের বাজার দখল করতে শুরু করল। আমেরিকার ইস্পাতশিল্প বড় ধাক্কা খেল।
আমেরিকার ভারী শিল্পের এই পতনকে ‘আমেরিকার অবশিল্পায়ন’ বলে চিহ্নিত করা হয়। প্রচুর মানুষ চাকরি হারালেন। যারা কর্মচ্যুত হলেন, তারা মূলত আমশ্রমিক শ্রেণি। একই সঙ্গে আমেরিকায় অভিবাসন বাড়তে শুরু করল। আশির দশকে ভারত, চীন, ইউরোপ থেকে অনেক ছাত্রছাত্রী আমেরিকায় লেখাপড়া করতে এলেন। নব্বইয়ের দশকে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব এলো। এতে জাতীয় আয়ে আঁচ না লাগলেও ইস্পাত-বেল্টের মানুষ কর্মহীন হলেন। বেশ কিছু মানুষ অভিবাসীদের দোষ দিলেন তাদের কর্মহীনতার জন্য।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ডোনাল্ড ট্রাম্প এই মানুষদের কাছে ঈশ্বর। একটি স্বপ্ন বিক্রি করছেন তিনি একটি স্লোগানের মাধ্যমেÑ ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’! কীভাবে আমেরিকা আবার কল্লোলিনী হবে? বাইরে থেকে জিনিসপত্রের আমদানিতে শুল্ক বসাও, যাতে দেশের শিল্পকে বাঁচানো যায়। অভিবাসন কমাও। মেক্সিকো থেকে বেআইনি অভিবাসন রুখতে প্রাচীর তোলো। এ কথা ঠিক যে, আমেরিকাতে ২০১৯ থেকে বেআইনি অনুপ্রবেশ বেড়েছে, জো বাইডেন বিশেষ কিছু করতে পারেননি। ট্রাম্প এই কথাটিকে বিলক্ষণ নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। বলছেন, এই বেআইনি অনুপ্রবেশকারীরা খুনি, ধর্ষণকারী।
ট্রাম্পের দেখানো স্বপ্ন আদৌ কি বাস্তবায়ন করা সম্ভব? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, না। কেননা এতে অর্থনীতি নেতিবাচক দিকে ধাবিত হবে। যা ম্যানেজ করা সহজ নয়।
আমেরিকার নির্বাচনের ফলাফল শুধু ভোটের সংখ্যা থেকে নির্ধারিত হয় না। সে দেশে কয়েকটি প্রদেশের ভোটের ভিত্তিতে প্রার্থীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হতে পারে। কিছু প্রদেশ চিরকালই রিপাবলিকানদের পক্ষে ভোট দেয়, কিছু প্রদেশ ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে। এবং কিছু এমন প্রদেশ আছে, যেখানকার ভোটাররা যে কোনো দিকেই হেলতে পারেন। সেগুলোকে বলা হয় সুইং স্টেট বা ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট। এ রকম চার-পাঁচটি রণভূমি প্রদেশের মধ্যে তিনটি হলো পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিন আর মিশিগান। এই তিন প্রদেশের ভোটের হাওয়া কোন দিকে বইবে, প্রশ্ন থাকছেই।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক