গ্রাহকের টাকা দিতে না পারা ব্যাংক এবং এদের রক্ষার উপায়
দেশের বেশ কটি ব্যাংকে তারল্য সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং এই ব্যাংকগুলো গ্রাহকের টাকা ফিরিয়ে দিতে পারছে না। গ্রাহকরা প্রতিদিনই চেক নিয়ে ব্যাংকের দ্বারে ধরনা দিচ্ছেন। ব্যাংক শাখাগুলো ছোট ছোট অঙ্কের চেক পরিশোধ করে কোনোমতে অস্তিত্বের বিষয়ে আমানতকারীদের নিশ্চিত করছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তারা যেমন বিপদে আছেন, তেমনি বিপদে আছেন আমানতকারীরা।
ব্যাংক শব্দের অর্থ বিশ^াস। আমরা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের চেয়েও ব্যাংককে বেশি বিশ^াস করি। আমরা আমাদের টাকা নিশ্চিন্তে ব্যাংকে জমা রাখি। ব্যাংকে কত টাকা জমা আছে তা ব্যাংক কর্মকর্তারা জানেন, পরিবারের সদস্যরা জানেন না। কখনও কখনও আমানতকারী নিজেও জানেন না তার হিসাবে কত টাকা জমা আছে। তিনিও ব্যাংকের কাছেই জানতে চান তার ব্যালেন্স কত? এমন বিশ^স্ত যে ব্যাংক তারাও এখন টাকা দিতে পারছে না। আমানতকারীদের বিশ^াসের মূলে আঘাত পড়েছে। অনেক আমানতকারীর ক্ষেত্রে টাকার ভীষণ প্রয়োজন হওয়া সত্ত্বেও তারা টাকা উঠাতে পারছেন না। চলছে হাহাকার। সিলেটের গ্রাহকরা একটি ব্যাংকে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন।
গ্রামের অনেক গ্রাহক আমাদের কাছে প্রশ্ন করেন, কী হবে এসব ব্যাংকের? ব্যাংকগুলো কী আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে? আমরা কি আমাদের টাকা ফেরত পাব? আমাদের কী হবে?
একটি ব্যাংকে ৪৫ লাখ টাকা স্থায়ী আমানত খাতে জমা রেখেছিলেন আমার গ্রামের এক ভাই। ব্যাংকের এই সমস্যা শুরু হওয়ার পর তিনি টাকা উঠিয়ে ফেলতে গিয়েছিলেন ব্যাংকে। ব্যাংক ম্যানেজার গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থায়ী আমানত ভাঙিয়ে একটি পে-অর্ডার দিয়ে দিলেন। অন্য ব্যাংকের হিসাবে পে-অর্ডার জমা দিলে বারবারই তা প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে আসছে। গ্রাহক এখন হাতে টাকা পাচ্ছেন না; অন্যদিকে স্থায়ী আমানত থাকা অবস্থায় যে সুদ বা মুনাফা অর্জিত হচ্ছিল তাও পাচ্ছেন না। অনেক দেনদরবারের পর দৈনিক পাঁচ হাজার টাকা করে ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন ব্যাংক ম্যানেজার। এই হারে আসল টাকা ফেরত দিতে প্রয়োজন হবে ৯০০ কার্যদিবস। চলতি ২০২৪ সালে নির্বাহী আদেশে প্রদত্ত ছুটিগুলো (ছাত্র-জনতার আন্দোলন চালাকালে এবং পরে দুর্গাপূজা উপলক্ষে ঘোষিত ছুটি) বাদে ব্যাংক খোলা রাখার পরিকল্পনা ছিল ২৪০ দিন। এই হিসাবটি বিবেচনায় নিয়ে গ্রাহক যদি প্রতিদিন নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যাংকে টাকা আনতে যায় তা হলে তাকে ৩ বছর ৯ মাস ধরে প্রতিদিন ব্যাংকে গিয়ে টাকা আনতে হবে।
ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না কেন? আমরা জানি, ব্যাংক টাকার ব্যবসা করে। টাকাই ব্যাংকের পণ্য। কম সুদহারে আমানত নিয়ে অধিক সুদহারে বিনিয়োগ করাই ব্যাংকের কাজ। টাকা ফিরিয়ে দিতে না পারা ব্যাংকগুলো অপাত্রে ঋণদান করেছে। অর্থাৎ তাদের কাছ থেকে যারা ঋণ নিয়েছেন তারা সময়মতো টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছেন না। ঋণখেলাপি হয়ে বুকটান করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেকেই টাকা পাচার করে দিয়ে নিজ পরিবারকেও পাচার করে দিয়েছেন। বাংলাদেশে রয়েছে কেবল লুটপাটের হাতিয়ারগুলো। অনেক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বা পরিচালক নিজেরাই বেনামে ঋণ নিয়েছেন, জাল দলিল বানিয়ে জামানত দিয়েছেন। এরাও টাকা পাচার করে বিদেশে অট্টালিকার মালিক হয়েছেন। ব্যাংকের প্রতি এদের দরদ নেই, থাকার কথাও নয়। সরকারের সহযোগিতায় যারা ব্যাংকের মালিকানা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তারাও মূল কাজ হিসেবে টাকা পাচারের কাজটিই গুরুত্ব দিয়ে করেছেন। তাই এখন ব্যাংকের পাওনাদার আছে, ব্যাংকে টাকা নেই। আইসিইউতে থাকা এসব ব্যাংককে মানুষ আর বিশ^াস করতে পারছে না। তাই কেউ টাকা জমা রাখতে ব্যাংকে যায় না, কেবল টাকা আনতে যায়।
ব্যাংক যখন এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে বা সংকটাপন্ন অবস্থায় উপনীত হয় তখন অন্যান্য দেশে কী করা হয়? সেসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এগিয়ে এসে ব্যাংকের পাশে দাঁড়ায়। যত টাকার প্রয়োজন হয় তত টাকা ঋণ দেয়। ব্যাংকের ওপর আমানতকারীদের বিশ^াস পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলে কর্জ দেওয়া টাকা তারা ফিরিয়ে নেয়। ততদিনে ব্যাংকের কাছে মানুষ কেবল চেক নিয়ে যায় না, টাকা জমা রাখতেও যায়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা কিছু লোক প্রথমে এক-একটি ব্যাংক চেটেপুটে খেয়েছে, এর পর এগুলোকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই উদ্যোগটি নেওয়ার আগে ভাবেনি যে, একটি শূন্যের সঙ্গে আর একটি শূন্য যোগ করলে যোগফল শূন্যই হয়। উদাহরণ হিসেবে বেসিক ব্যাংক বা পদ্মা ব্যাংকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
অর্থনীতির স্বার্থে এবং ব্যাংকে টাকা জমা রাখা আমানতকারীদের স্বার্থে চরম অসুস্থ ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়ে গভর্নর যদি বলেন যে, দেশের ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পথে, তা হলে আমানতকারীদের তো দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হবেই। তারা চেক নিয়ে ব্যাংকের দরজায় দাঁড়াবেন এটাই স্বাভাবিক।
ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকারকে কঠিনভাবে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিগত সময়ে এনসিএল নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের বিপদে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কিছু শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে পরে এটি ব্যাংক হিসেবে লাইসেন্স পেয়েছে এবং এখনও একটি ভালো ব্যাংক বলে স্বীকৃতি পাচ্ছে। গৃহীতব্য পদক্ষেপগুলো নি¤œরূপ হতে পারে।
এক. ব্যাংক যারা পরিচালনা করেছেন এবং নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে খেলাপি তকমা কপালে পরেছেন তাদের দেশে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সব ধরনের সম্পদ বিক্রয় করে প্রাপ্ত টাকা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের কাজে লাগাতে হবে। এসব ঋণের ভাগ যারা পেয়েছেন, আত্মীয়-পরিজনদের সম্পদও ফোর্স সেল পদ্ধতিতে বিক্রি করতে হবে।
দুই. ব্যাংকের ভালো ঋণগুলো (নিয়মিত কিস্তি পরিশোধিত হচ্ছে এমন ঋণ) বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে অন্য ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে একসঙ্গে পুরো বিনিয়োগটি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বিপদগ্রস্থ ব্যাংকে কিছুটা হলেও তারল্য ফিরে আসবে। ঋণগ্রহীতাও ক্ষতির মুখে পড়বেন না, ব্যাংকেরও লাভ হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
তিন. পাচারকৃত টাকা যে কোনো উপায়ে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উঁচু পর্যায়ের লোকদের উদ্যোগে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন হবে। তা ছাড়া দেশের ভেতর আদালত, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার কাজে কোনোরূপ বিলম্ব করা চলবে না। কোনো কেসের উদ্যোগ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের গতিতে সবগুলো সংস্থার কাজ পরিচালিত হলে বিদেশেও টাকা আটক করা এবং ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা চাওয়া যেতে পারে।
চার. বাংলাদেশে অনেক ঋণগ্রহীতা ইচ্ছাকৃতভাবে ছোটখাটো কিছু ঝামেলা সৃষ্টি করে বিষয়টি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয় এবং ব্যাংকের টাকা ফেরত দেওয়ার কাজ থেকে বিরত তাকে। বিচারাধীন বিবেচনায় এরা ঋণখেলাপি বলে চিহ্নিত হয় না। এসব মামলা ইচ্ছা করেই তারা বছরের পর বছর ঘুরাতে থাকে। আদালতে এসব মামলা চিহ্নিত করে দ্রুত সিদ্ধান্ত বা রায় প্রদান করার ব্যবস্থা করতে হবে। আদালতে আটকে থাকা ঋণের টাকা আদায় হলেও ব্যাংকগুলোর হাতে টাকা আসবে এবং তারা গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করতে পারবেন।
পাঁচ. সুষ্ঠুভাবে ব্যাংক পরিচালনার জন্য অনেকগুলো আইনের সংস্কার প্রয়োজন। দেশে বিদ্যমান অনেকগুলো আইন রয়েছে, যেগুলো ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত। ব্রিটিশরা এদেশ থেকে লুটতরাজ করে অর্থ ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়ার কাজে সহায়ক হতে পারে এ ধরনের আইনই প্রবর্তন করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর এসব আইন এরই দুটো দেশে কার্যকর হয়। আবার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর এই আইনগুলোই এ দেশে প্রবর্তন করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১ (অনেক বছর ধরে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যকর হয়নি), বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭ ইত্যাদির কথা বলা যায়। ভারত এবং পাকিস্তানে এসব আইন অনেক আগেই পরিবর্তন করা হয়েছে। অর্থনীতির চাকাগুলো দেশের স্বার্থের অনুকূলে পরিচালনার জন্য আইনগুলোর সংস্কার জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।
ছয়. ব্যাংকগুলোকে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ঋণদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঋণ ও বিনিয়োগের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে হবে। অনেকগুলো ব্যাংকের বিদেশে শাখা বা এক্সচেঞ্জ হাউস রয়েছে; এসব হাউসে কর্মরতদের সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক বেশ ভালো। তারা ইচ্ছা করলে উদ্যোগ নিয়ে টাকা সংগ্রহের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। উপরন্তু বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি মিশন ব্যাংকগুলোর টাকা সংগ্রহে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
সাত. ঋণ প্রদানের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের চাহিদা পূরণ করতে পারে। এতে অবশ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়বে, যা পরবর্তী সময়ে ফিরিয়ে আগের অবস্থানে যাওয়া সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন:
সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে অনীহা ব্যাংকের
বর্তমান সময়ে অর্থনীতির এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকে সঠিক কাজটিই করতে হবে। বর্তমানে তারা যা করছেন সেগুলোর ভেতর অনেকগুলো কাজের চেয়ে অর্থনীতির সুরক্ষা এবং ব্যাংক বাঁচানো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তাই কর্তৃপক্ষ এদিকে কিছুটা বাড়তি নজর দেবেÑ এমনটিই আমরা আশা করি।
মাহফুজুর রহমান : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক