সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে অনীহা ব্যাংকের
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার সঞ্চয়পত্র থেকেও কোনো ঋণ পাচ্ছে না সরকার। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যাংকঋণ এবার বাণিজ্যিক ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়েছে। তবে বেশির ভাগ ব্যাংক তারল্য সংকটে থাকায় সরকারকে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দিতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আবার দিলেও বেশি সুদ দাবি করছে। এমনকি তিন মাসের বেশি মেয়াদের ঋণেও ব্যাংকগুলো তেমন সাড়া দিচ্ছে না। ফলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ দৈনন্দিন খরচ মেটাতে শিডিউলের বাইরে গিয়ে আরও কম মেয়াদের ঋণের অকশন করতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে কম মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের হারও বাড়ছে।
জানা গেছে, সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার শিডিউলের বাইরে ১৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের অকশন করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ৫ হাজার ৫২৮ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে সরকার। আর এই ঋণের সুদের হার উঠে ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। সবমিলে চলতি অর্থবছরে শিডিউলের বাইরে গিয়ে মোট চার দফায় ১৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের অকশন করা হয়েছে। এসব অকশন থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৭৩ কোটি
টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত অক্টোবর ও চলতি নভেম্বরে কয়েকটি অকশনে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ না পাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ গত বুধবার ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের অকশন অনুষ্ঠিত হয়। ওই অকশনে ১০ বছর মেয়াদে আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহের কারণে ঋণ নিতে পেরেছে মাত্র ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। এর জন্য সুদ গুনতে হবে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। গত ১৫ নভেম্বর ৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের অকশন করে সরকার ঋণ নিতে চেয়েছিল ৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহে নিতে পারে মাত্র ৮১৩ কোটি টাকা। সুদের হার উঠে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত ৮ নভেম্বর ২ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের অকশন করে ঋণ নিতে চেয়েছিল ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু নিতে পেরেছে মাত্র ১ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। সুদের হার উঠে ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ২৫ অক্টোবর ১৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের অকশন করে এক হাজার কোটি টাকার ঋণ নিতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু নিতে পেরেছে মাত্র ২১১ কোটি টাকা। সুদের হার উঠে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। একই তারিখে ২০ বছর মেয়াদি অকশন করে ৮৫০ কোটি টাকার ঋণ নিতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু নিতে পারে মাত্র ২১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের অকশনে ব্যাংকগুলো সেভাবে সাড়া দিচ্ছে না। আর যেটুকু দিচ্ছে তাতে বাড়তি সুদ দাবি করছে। এর বাইরে সর্বোচ্চ মেয়াদের (৩৬৪ দিন) ট্রেজারি বিলের অকশনেও আশানুরূপ সাড়া দিচ্ছে না ব্যাংকগুলো।
সর্বশেষ গত ২০ নভেম্বর ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের অকশন অনুষ্ঠিত হয়। ওই অকশনে ২ হাজার কোটি টাকার ঋণের চাহিদা দিয়ে সরকার নিতে পেরেছে মাত্র ৫২৬ কোটি টাকা। আর ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের অকশনে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ঋণের চাহিদার বিপরীতে পেয়েছে মাত্র ২৮৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে একই তারিখে ৯১ দিন মেয়াদের অকশনে ৩ হাজার টাকার ঋণ চাহিদার বিপরীতে নিতে সক্ষম হয় ৩ হাজার ২২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ সংকটের কারণে কম মেয়াদের ঋণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেবল আগ্রহ দেখাচ্ছে। ওই দিন ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদ উঠে ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর ১৮২ দিন ও ৯১ দিন মেয়াদি বিলের সুদ উঠে যথাক্রমে ১০ দশমিক ৪০ ও ১০ দশমিক ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, কড়াকড়ি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ পাচ্ছে না সরকার। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি আরও চড়া হওয়ার আশঙ্কায় টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার প্রবাহে লাগাম টানতে নেওয়া হয়েছে সংকোচনমুখী নীতি। আবার ডলার বিক্রির কারণেও বাজার থেকে টাকা উঠে আসছে। এতে ব্যাংক খাতেও নগদ টাকার টানাটানি রয়েছে। এমন বাস্তবতায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি ঋণের অকশনে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
জানা গেছে, এবার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ১৮ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় প্রায় ৬ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। একই সময়ে ভাঙানো হয়েছে ৬ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা। ফলে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১৪৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের আয় কম বলেই ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হলে নতুন টাকা ছাপিয়ে দিতে হয়। এর প্রভাব সরাসরি মূল্যস্ফীতির ওপর পড়ে। এ কারণে এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিচ্ছে না। আবার কড়াকড়িসহ বিভিন্ন কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকেও ঋণ পাচ্ছে না। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকেই সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এতে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার বাড়ছে।
প্রসঙ্গত, প্রতিবছরই বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে বাজেট পেশ করে আসছে সরকার। এই ঘাটতি মেটানো হয় দুটি উৎস থেকে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাত। বৈদেশিক খাত থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা পাওয়া না গেলে অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয় সরকারকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র খাত। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতেই এসব ঋণ নেওয়ার শিডিউল ক্যালেন্ডার ঠিক করা হয়েছে। আর ওই ক্যালেন্ডারে ১৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের কোনো অকশন রাখা হয়নি।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন