নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

চপল বাশার
৩০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

কাঁচাবাজারে আগুন জ্বলছেই। নিত্যপণ্য, বিশেষ করে সবজি এখনও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সবজির দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু বাজারে গেলে সেটা বোঝা যায় না। কিছুটা যদি কমেও থাকে, দাম যে পর্যায়ে রয়েছে তা নিম্নআয়ের মানুষের জন্য নয়, মধ্যবিত্তের জন্যও কেনা কষ্টকর। পেঁয়াজের দাম বেড়েই চলেছে। মুরগি, ডিম ও আলুর দামও বাড়তির দিকে।

আমিষ জাতীয় খাদ্য গরু ও খাসির মাংস অনেক আগেই মধ্যবিত্তের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। ভালো মাছ কেনার ক্ষমতাই বা কজনের আছে। নিম্নআয়ের মানুষ আমিষের চাহিদা মেটাতে ডিমের ওপর নির্ভর করতেন। সেই ডিমের দামও এক সপ্তাহ আগে প্রতি ডজন ১৮০ টাকায় উঠেছিল। গত রবিবার (২৭ অক্টোবর) ডিমের দাম খুচরা বাজারে ১৫০ টাকা ছিল, যা সরকার নির্ধারিত দামের বেশি।

নিত্যপণ্যের বাজার সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে হয় না। বাজার এখনও নিয়ন্ত্রণ করে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। গত আড়াই বছর ধরে এই সিন্ডিকেট নিত্যপণ্যের বাজার দখল করে রেখেছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে তারা দুহাতে মুনাফা লুটছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সবাই আশা করেছিলেন অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট এবার ভাঙবে, নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে। কিন্তু তা হয়নি। শক্ত হাতে সিন্ডিকেট দমন করা গেলে কাঁচাবাজার অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে থাকত, স্বস্তি পেত সাধারণ মানুষ তথা জনগণ।

সবজির দাম বেশি কেন? : কাঁচাবাজারে যেসব সবজি পাওয়া যায় তার সবই দেশে উৎপাদিত। ক্ষেতে উৎপাদিত সবজির যে দাম কৃষকরা পান, তা প্রায় দশগুণ বেশি হয়ে যায় শহরের বাজারে। দুই কোটির বেশি লোক বাস করেন রাজধানী ঢাকায়। জনসংখ্যা বেশি, তাই এখানে চাহিদাও বেশি। ঢাকা শহরে কারওয়ান বাজারের মতো বড় পাইকারি বাজার ছাড়াও রয়েছে শতাধিক ছোট-বড় কাঁচাবাজার। এ ছাড়া ভ্যানগাড়িতে করে ঢাকা শহরে সবজি বিক্রি করেন সহস্রাধিক বিক্রেতা।

ঢাকার বাজারে সবজির সরবরাহ প্রচুর। কাঁচাবাজারে গেলে দেখা যাবে সবজিতে বাজার ভর্তি। রাস্তার পাশে ভ্যানগাড়ি সবজিতে ভরা। সব রকমের সবজি পাওয়া যায়। কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু দাম? যাদের ক্রয়ক্ষমতা কম, তারা কম করে কেনেন। অল্প কিছু সবজি দিয়েই তাদের সংসার চলে।

সবজির সরবরাহ প্রচুর, অথচ দাম এত বেশি কেন? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, কৃষকের উৎপাদিত সবজি বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে খুচরা বাজারে এলে দাম বহুগুণ বেড়ে যায়। কৃষক এক কেজি বেগুন বিক্রি করে যদি বিশ টাকা পায়, ঢাকার বাজারে সেটা হয়ে যায় ১২০ টাকা। সিন্ডিকেটের খেলাটা হয় পাইকারি বাজারে। তারা সুযোগ বুঝে একজোট হয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে দুর্ভোগের শিকার হয় ক্রেতা ও ভোক্তারা। তারা বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বেশি দাম দিয়ে সবজি কিনতে বাধ্য হন।

ঢাকার কাঁচাবাজারে নতুন আলু এসেছে, দাম চড়া, ১২০ টাকা কেজি। নতুন আলু এলে পুরনো আলুর দাম কমে। এই নিয়মই এতদিন চলে এসেছে। এবার কিন্তু তা হচ্ছে না। পুরনো আলুর দাম বাড়তির দিকেই রয়েছে। রবিবার থেকে শুরু হওয়া চলতি সপ্তাহে পুরনো আলুর দাম বেড়ে প্রতি কেজি ৬০ টাকা। আরও নাকি বাড়তে পারে।

অন্যান্য সব সবজির দাম প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা। দামে রেকর্ড করেছে বেগুন ১০০ টাকা। টমেটো ২০০ টাকা, গাজর ১৮০ টাকা, শিম ২০০ টাকা। শসাও ৮০ টাকা। বরবটি ১২০ টাকা। কচুরলতিও কম যায় না, ১০০ টাকা কেজি। সবচেয়ে কম দামে একটি সবজিই আছে সেটা কাঁচা পেঁপে। মাত্র ৪০ টাকা কেজি। এটা কাঁচাবাজারে সবজির দরের খণ্ডচিত্র মাত্র। কোনো সবজিই সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নেই।

ডিমের সংকট চলছেই : মাছ-মাংস যেহেতু নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, তারা আমিষের প্রয়োজন মেটাতে মুরগির ডিম কেনেন। এই ডিমও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রায়ই। এক সপ্তাহ আগেও ডিমের দাম প্রতি ডজন ১৮০ টাকা উঠেছিল। সরকার বিদেশ থেকে ডিম আমদানির উদ্যোগ নেওয়ায় দাম কিছুটা কমে এখন ডজন ১৫০ টাকা।

ডিমের দাম বাড়ার জন্য ডিম উৎপাদক বা খুচরা বিক্রেতারা দায়ী নন। ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। বেশি মুনাফার জন্য তারাই ডিমের দাম বাড়িয়ে দেয়। ভোক্তা অধিদপ্তর মাঝে মধ্যেই অভিযান চালায় ডিমের খুচরা বাজারে, বেশি দামের জন্য খুচরা বিক্রেতাদের জরিমানা করে।

পাইকার, বড় ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেটকে ভোক্তা অধিদপ্তর ধরে না, অসাধু ব্যবসায়ীরা অন্তরালে থাকে নিরাপদে। সিন্ডিকেটকে কেন ধরা হয় না বা সিন্ডিকেট কেন ভেঙে দেওয়া হয় না, সেটা একটা রহস্য।

মাংসের দাম কমে না কেন? : আমিষের বড় উৎস গরু-ছাগলের মাংস এবং মুরগি ও মাছ। খাসির মাংস প্রতি কেজি ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা। এটা এখন কেবল উচ্চবিত্ত বা ধনী মানুষের খাদ্য। খাসির মাংসের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের নেই। গরুর মাংস ৮০০ টাকা কেজি। এটাও মধ্যবিত্তের ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। খাসি ও গরুর মাংসের দাম এত কেন, এর কোনো সদুত্তর নেই মাংস ব্যবসায়ীদের কাছে। খোঁড়া যুক্তি হিসেবে তারা বলেন, পশু পরিবহনের খরচ বৃদ্ধি, শহরে আসার পথে চাঁদাবাজি ইত্যাদি। আসলে এ ক্ষেত্রেও রয়েছে সিন্ডিকেটের কারসাজি ও অপতৎপরতা। মাংসের দাম এরাই নির্ধারণ করে দেয়, যেটা খুচরা বিক্রেতারা মেনে চলে।

মাংস ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙাও কঠিন কিছু নয়। পরিবহন খরচ নিয়ন্ত্রণে আনা, চাঁদাবাজি বন্ধের ব্যবস্থা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিলে মাংসের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসতে বাধ্য। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে মাংস আমদানি করা যেতে পারে। ব্রাজিল, ভারত, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কিছু দেশ মাংস রপ্তানি করে। মাংস আমদানির ব্যবস্থা নিলে তার শুভ প্রভাব কাঁচাবাজারে পড়বে, ব্যবসায়ীরা দাম কমাতে বাধ্য হবে।

প্রায় এক মাস ধরে বাজারে উচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগি। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি এখন ১৯০ থেকে ২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাসখানেক আগেও ২০-৩০ টাকা কমে পাওয়া যেত। সোনালি মুরগির দামও এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। ভালো মাছের দাম অধিকাংশ ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। নিম্নআয়ের মানুষ চাষের পাঙ্গাশ ও তেলাপিয়া কিনতেন মোটামুটি সহনীয় দামে। সেই সস্তার মাছও প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় পৌঁছেছে।

বিস্তারিত না বলে এক কথায় কাঁচাবাজার পরিস্থিতিকে অসহনীয় বললে অত্যুক্তি হবে না। ৫০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে প্রয়োজনের অর্ধেক পণ্যও কেনা যায় না।

আড়াই বছর ধরে বাজারে যে আগুন জ্বলছে, সেটা নেভার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ভোক্তা অধিকারসহ তদারকি সংস্থাগুলোর কোনো উল্লেখযোগ্য তৎপরতা চোখে পড়ছে না। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়েই চলেছে। সাধারণ মানুষ তথা জনগণকে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য থেকে বাঁচাতে হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে, কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।


চপল বাশার : সাংবাদিক ও লেখক